খেলাপি ঋণের কারণে দেশের আর্থিক খাত উল্লেখযোগ্য মাত্রার ঝুঁকিতে রয়েছে। ২০২৩ সালের জুনে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ গত রোববার প্রধান উপদেষ্টার কাছে দেওয়া ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি: সাম্প্রতিক চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ করণীয়’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১১ সালে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মোট ঋণের ৬ দশমিক ১২ শতাংশ। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে এ খাতে ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। বিগত সরকারের সময় আর্থিক কাজের অব্যবস্থাপনার কারণে অন্তত ১০টি ব্যাংক তীব্র ঝুঁকির মুখে রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
২০২২ সালের মার্চ থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২২ সালের মার্চে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪১ কোটি, জুনে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি, সেপ্টেম্বরে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি, ডিসেম্বরে ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা।
২০২৩ সালের মার্চে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২১ কোটি, জুনে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি, সেপ্টেম্বরে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৮ কোটি ও ডিসেম্বরে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের মার্চে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি, জুনে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯২ কোটি ও সেপ্টেম্বরে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা।
ক্লাস ফোর্স গঠন করে ব্যাংকের ঝুঁকি ও প্রকৃত অবস্থা সঠিকভাবে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী নিরূপণের লক্ষ্যে অ্যাসিড কোয়ালিটি রিভিউ সম্পাদনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বমানের অ্যাকাউন্টিং ফার্ম এবং কে পি এম জি মোট ছয়টি ব্যাংকের অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ সম্পাদন কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
যার কোয়ালিটি অ্যাসুরান্স নিশ্চিত করার জন্য একটি ফার্ম ডিলইটিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকের সুশাসন নিশ্চিত করতে সরকারি-বেসরকারি ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন ও ব্যবস্থাপনা পরিবর্তন আনা হয়েছে।
আইনি প্রক্রিয়ায় ব্যাংকের লুণ্ঠিত সম্পদ উদ্ধারে ব্যাংকের আইন বিভাগ শক্তিশালী করার লক্ষ্যে নীতিমালা জারি করা হয়েছে। সংকট উত্তরণে এবং গ্রাহকদের আস্থা অটুট রাখতে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
প্রতিবেদনে অধিকতর করণীয় সম্পর্কে বলা হয়, দ্রুত অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ সম্পাদন করে ব্যাংকের প্রকৃত অবস্থা যাচাই করা। এস এফ কোয়ালিটি রিভিউ সম্পন্ন হওয়ার পর ব্যাংকের ঝুঁকি বিবেচনায় প্রয়োজনে মার্জার ও একিউজেশনের মতো পদক্ষেপ নেওয়া।
এ লক্ষ্যে ব্যাংক রেজোভেশন অর্ডিন্যান্স জারিসহ প্রয়োজনে আইন ও বিধিবিধান প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া। অর্থ পাচারকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক তৎপরতা জোরদারের ওপরও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
এদিকে দেশে খেলাপি ঋণের মোট ঋণের ৩০ শতাংশ অতিক্রম করে যেতে পারে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে দেশের আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হতে পারে। এ পরিস্থিতিতে ব্যাংকিং খাতের ওপর মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে বেশ কিছু জরুরি ব্যবস্থা নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
খেলাপি ঋণের বাড়বাড়ন্ত মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে বলে গত রোববার মুদ্রানীতির ঘোষণায় জানানো হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক মূলত নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা জোরদার, ব্যাংকিং খাতের সুশাসন নিশ্চিত ও যথাযথভাবে সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার ওপর জোর দিয়েছে। তারা মনে করছে, এর মধ্য দিয়ে মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।
খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি ব্যবহার করছে, যেমন এক্সপেকটেড ক্রেডিট লস মেথডলজি; ২০২৭ সালের মধ্যে এটি চালু করা হবে। আন্তর্জাতিক ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে এ পদ্ধতি চালু করা হবে। সে জন্য কী কী করতে হবে, সে বিষয়েও বিস্তারিত বলা হয়েছে।
বলা হয়েছে, সে জন্য ব্যাংকের ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, ঋণ ব্যবস্থাপনা রীতি-সম্পর্কিত ভবিষ্যদ্বাণী এসব অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ধারণা করা হচ্ছে, এ মডেলের মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে ঋণের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমানো সম্ভব হবে।
সেই সঙ্গে বাণিজ্যিক ব্যাংকের আইন বিভাগগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিশেষ করে যেসব ঋণ অর্থঋণ আদালত ও উচ্চ আদালতে ঝুলে আছে, সেগুলোর জট ছাড়াতে।
ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা উন্নত করা ও এই খাতের সামগ্রিক দক্ষতা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি কিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এসব ঝুলে থাকা বিষয়ের জট ছাড়াতে আইন বিভাগের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
আপনার মতামত লিখুন :