ঢাকা মঙ্গলবার, ০৪ মার্চ, ২০২৫

অর্ধেকে নামল বইমেলায় বই বিক্রি, নেপথ্যে কী?

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: মার্চ ৪, ২০২৫, ০৯:১৬ এএম
ছবি: সংগৃহীত

মাসজুড়ে চলা অমর একুশে বইমেলা শেষ হয়েছে গত শুক্রবার। প্রকাশকরা জানিয়েছেন, গত বছরের তুলনায় এবার প্রায় অর্ধেকে নেমেছে তাদের বিক্রি। লেখক-প্রকাশকসহ খাতসংশ্লিষ্টরা মেলায় বিক্রি এতটা কমার পেছনে অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিভিন্ন দাবিতে মেলা প্রাঙ্গণের আশপাশে সভা-সমাবেশ, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও আয়োজকদের অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করছেন।

লেখক-প্রকাশকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এবারের বইমেলায় নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন তারা । বড়-ছোট সব ধরনের প্রকাশক এবার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন মেলা নিয়ে। খোদ মেলার আয়োজক বাংলা একাডেমিসহ বড় প্রকাশকদের বিক্রিও নেমেছে প্রায় অর্ধেকে।

বাংলা একাডেমি সূত্র জানিয়েছে, সদ্য শেষ হওয়া বইমেলায় প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি করেছে ৬১ লাখ টাকার বই। গত বছর বিক্রি হয়েছিল ১ কোটি ৩৬ লাখ টাকার। সে হিসেবে এবার গত বছরের তুলনায় অর্ধেকেরও কম বই বিক্রি হয়েছে।

খোদ বাংলা একাডেমির বই বিক্রির এমন করুণ অবস্থা কেন জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব সরকার আমিন বলেন, ‘‌এবার মেলায় বিক্রি কম হয়েছে এটা সত্য। এখন আমাদের বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে, কেন কম হয়েছে? এ নিয়ে আলোচনা করে কারণ বের করতে হবে।’

তবে ভিন্ন একটি কারণ বলেছেন, প্রতিষ্ঠানটির বিক্রয়, বিপণন ও পুনর্মুদ্রণ বিভাগের পরিচালক ডা. কেএম মুজাহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘বাংলা একাডেমিতে গত ১৭ বছর অতিমাত্রায় দলীয় বই প্রকাশ হয়েছে। কোনো এক প্রতিষ্ঠান এসে ৫০ হাজার কপি বঙ্গবন্ধুর জীবনী বা অন্য দলীয় বই কিনে নিত। এটা এবার হয়নি। ফলে বিক্রি অনেকটা কমে গেছে। এটা অন্য প্রকাশনীর বেলায়ও হয়েছে। বাংলা একাডেমির মতো একটা প্রতিষ্ঠানকে এভাবে দলীয়ভাবে ব্যবহার করা উচিত নয় বলে মনে করি।’

দেশের বড় প্রকাশনা সংস্থাগুলোর বিক্রির অবস্থাও বেশ খারাপ এবার। এবারের মেলায় দেশের অন্যতম বৃহৎ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান প্রথমা প্রকাশনের বই বিক্রি কমেছে গত বছরের তুলনায় প্রায় ৬০ শতাংশ। তবে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে এবারের বইমেলায় বই বিক্রির মোট পরিমাণের তথ্য পাওয়া যায়নি।

এবারের মেলায় পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স বই বিক্রি করেছে ৬৫ লাখ টাকার। গত বছর বিক্রি হয়েছিল ৯৫ লাখ টাকার। আদর্শ প্রকাশনী বই বিক্রি করেছে ৩০ লাখ টাকার, গত বছরে যা ছিল ৬০ লাখ টাকা। দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের (ইউপিএল) এবারের বিক্রি ৩০ লাখ টাকা। গত বছর ছিল ৬০ লাখ টাকা। বাতিঘরের এবারের বিক্রি ৩৭ লাখ টাকা। গত বছর ছিল ৩৯ লাখ টাকা। অ্যাডর্ন পাবলিকেশন্সের এবারের বিক্রি ৬ লাখ টাকা, গত বছর হয় ১১ লাখ টাকা। জিনিয়াস পাবলিকেশন্সের এ বছরের বিক্রি ৮ লাখ, গত বছর হয় ১৫ লাখ টাকার। কাকলী প্রকাশনীর এ বছরের বিক্রি ২৬ লাখ টাকা, গত বছর ছিল ৪৬ লাখ। সালাউদ্দিন বইঘরের এবারের বিক্রি ৪ লাখ টাকা, গত বছর ছিল ১০ লাখ। ইত্যাদি প্রকাশনী ৫০ শতাংশ কম বিক্রি করেছে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।

ঐতিহ্য প্রকাশনীর বিক্রয় ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা আমজাদ হোসেন খান কাজল বলেন, ‘‌এবার মেলায় শেষ দিকে দর্শক ও ক্রেতার সংখ্যা দুটোই কমেছে। আমাদের বিক্রি প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। আয়োজকদের পক্ষ থেকে সহযোগিতা পেয়েছি অনেক। তবে কিছু বিশৃঙ্খলাও ছিল। মেলার পেছনের দিকে অনেক খাবারের দোকান বসানো হয়। এত খাবারের দোকান আগে দেখা যায়নি। তা ছাড়া এবার মেলায় হকার ও টোকাইদের উৎপাত ছিল বেশ, যেটা আগে ছিল না। মেলার নিয়ম আছে, স্টলে কেউ রাতে থাকতে পারবে না। কিন্তু খাবারের দোকানের লোকেরা সারা রাত দোকানে ছিল। আমরা রাত ৯টায় বন্ধ করে দিয়ে যাওয়ার সময়ও খাবারের দোকান চলতে দেখি। এ বিষয়গুলো আয়োজকরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি।’

এবারের মেলায় আয়োজকদের অনেক সিদ্ধান্তই হঠাৎ করে নেয়া ছিল বলে মন্তব্য করেন বিক্রেতারা। এতে বেচাকেনায় প্রভাব পড়েছে। তাছাড়া ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২১ ফেব্রুয়ারি ও শবেবরাত এবার শুক্রবার হওয়ায় বিক্রি অনেকটা কমে গেছে বলেও জানিয়েছেন তারা।

এবারের মেলায় তুলনামূলক ভালো বই বিক্রি করেছে বাতিঘর প্রকাশনী। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী দীপংকর দাশ বলেন, ‘‌বড় প্রকাশকদের মধ্যে আমাদের অবস্থা তুলনামূলক ভালো। অনেকেই গত বছরের চেয়ে অর্ধেকও বিক্রি করতে পারেনি। এমনও প্রকাশনী আছে ১ লাখ টাকার বইও বিক্রি হয়নি। এটা হয়েছে আসলে বাংলা একাডেমির পুরস্কার ঘোষণার পর থেকেই। একবার পুরস্কার বাতিল করা হয়েছে, স্টল বন্ধ হয়েছে, লেখক গ্রেফতার হয়েছে—সবকিছুর প্রভাব গিয়ে পড়েছে মেলায়। ফলে এবারের মেলা ছিল প্রকাশকদের জন্য খুব খারাপ অভিজ্ঞতার।’

বইমেলায় এখনো প্রচুর বিক্রি হয় প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস। কাকলী প্রকাশনী থেকে তার বেশকিছু বই বের হয়েছে। প্রকাশনীটি গতবারের চেয়ে এবার প্রায় অর্ধেক মূল্যের বই বিক্রি করতে পেরেছে।

কাকলী প্রকাশনীর কমিউনিকেশন কর্মকর্তা মো. ইমরান আহমেদ বলেন, ‘‌এবার যে যেভাবে চেয়েছে, বাংলা একাডেমি স্টল দিয়েছে। এবার মেলার নামে সব হয়েছে, শুধু মেলা হয়নি। ফুটপাতে যারা কপি করে বই বিক্রি করেন, তাদেরও এবার স্টল দেয়া হয়েছে। এতে আমাদের মতো বড় প্রকাশকরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন।’

ঔপন্যাসিক হরিশংকর জলদাস বলেন, ‘‌আমার দীর্ঘ জীবনে এ রকম মেলা আর দেখিনি। এখানে না ছিল নিরাপত্তা ব্যবস্থা, না ছিল শৃঙ্খলা। এটা কি মেলা নাকি খাবারের রেস্টুরেন্ট এরিয়া, বোঝার সুযোগ ছিল না। ফকির (ভিক্ষুক), হকারের কারণে হাঁটার সুযোগ ছিল না। বয়স্কদের বসার জায়গা ছিল না। দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা নেই। এটাকে কোনোভাবেই মেলা বলা যায় না। আমি কয়েকটা দেশের মেলা দেখেছি। এ রকম বিশৃঙ্খল অবস্থা দেখিনি।’

প্রকাশকরা জানিয়েছেন, এবারের মতো অব্যবস্থাপনা এর আগে দেখা যায়নি। মেলায় বিশাল অংশজুড়ে খাবারের দোকান বরাদ্দ করে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ। ফলে একে বইমেলার চেয়ে রেস্টুরেন্টের মেলা বললেই যথার্থ হয় বলে মন্তব্য লেখক-প্রকাশকদের।

কথা প্রকাশনার কমিউনিকেশন কর্মকর্তা মো. জাফিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের এবার বিক্রি হয়েছে ৩০ লাখ টাকার মতো। গতবার বিক্রি হয়েছিল ৪২ লাখ টাকার। এবার লাভের পরিমাণ খুবই সামান্য। এ বছর আমরা নতুন বই এনেছি একশরও বেশি। আর নতুন বই সবসময় ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ। স্টল খরচ, লেখকদের সম্মানী সবকিছু দিয়ে আমরা অন্যবারের মতো লাভজনক অবস্থানে নেই। আর মেলার পরিবেশ নিয়ে বলতে বললে আমরা পুরোপুরি হতাশ। বিপুল পরিমাণ খাবারের স্টল ছিল। ছিল স্টলের সামনে অসংখ্য হকার। এভাবে অনিয়ন্ত্রিত হকার এর আগে আমরা কখনো দেখিনি। বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষকে এবার মেলা নিয়ে সিরিয়াস ভূমিকায় দেখিনি। এটা আমরা কোনোভাবেই বাংলা একাডেমির কাছে প্রত্যাশা করি না।’

অন্যান্য বছর মেলার একদিন পরই পুরো মেলায় বিক্রির হিসাব দিয়ে দিত বাংলা একাডেমি। কিন্তু এ বছর এখনো মেলায় মোট কত বিক্রি হয়েছে সে হিসাব দিতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। মেলার শেষ দিন বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে ৬১ লাখ টাকার বই বিক্রির একটি হিসাব দিয়েছে। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যঙ্গ করে প্রচার করছে, এবার পুরো মেলায় বিক্রি হয়েছে ৬১ লাখ টাকার বই। অথচ গত বছর মেলায় বিক্রি হয় ৬০ কোটি টাকার বই।

প্রকাশকরা বলেন, প্রতিদিন মেলায় কত টাকার বই বিক্রি হয় এটার হিসাব বাংলা একাডেমিকে দেয়া হয়। তারা চাইলে এটা ২৮ তারিখেই জানিয়ে দিততে পারত। কিন্তু এখন পর্যন্ত মেলায় কত টাকার বই বিক্রি হয়েছে, তা দেশবাসীকে না জানানো বাংলা একাডেমির প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা।

এ সম্পর্কে জানতে চাইলে মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব সরকার আমিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌আমরা হিসাব করে দেখছি। হিসাব শেষ হলে জানিয়ে দেয়া হবে।’

সার্বিক বিষয়ে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম বলেন, ‘‌নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে প্রকাশকদের বক্তব্য সঠিক। এবার আমরা হকার ব্যবস্থাপনা করতে পারিনি। বারবার বলা সত্ত্বেও তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। আর খাবারের দোকান বেশি থাকলেও তাদের মেলা থেকে দূরে এক পাশে দেয়া হয়। এখন সবাই যদি বলে মেলায় খাবারের দোকান থাকবে না, তবে আমরাও রাখব না। কিন্তু সবাইকে এক হয়ে বলতে হবে।’