কর ব্যবস্থার দক্ষতা ও স্বচ্ছতা বাড়াতে বিশ্বের অনেক দেশই কর নীতি ও কর সংগ্রহ কার্যক্রমকে আলাদা করার পথে হেঁটেছে। বাংলাদেশেও এ উদ্যোগ শুরু হয়েছিল ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে। যদিও তা পরে আর আলোর মুখ দেখেনি।
দায়িত্ব গ্রহণের পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও রাজস্ব কার্যক্রম সংস্কারের আওতায় কর নীতি ও কর সংগ্রহ কার্যক্রমকে আলাদা করার উদ্যোগ নিয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের মতো বহুজাতিক দাতা সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকেও এটি বাস্তবায়নের চাপ রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ নামে দুটি স্বতন্ত্র বিভাগ গঠনের প্রস্তাব সংবলিত একটি অধ্যাদেশের খসড়া প্রণয়ন করেছে সরকার।
তবে এ উদ্যোগের কার্যকারিতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে প্রশাসনিক সংস্কারের নামে অতীতে বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থা গঠন করা হলেও সেক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল আসেনি। ফলে কর ব্যবস্থায় বিদ্যমান দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, ডিজিটালাইজেশনের অভাবের মতো বিষয়গুলোর সমাধান না করে শুধু জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কার্যক্রমকে দুটি আলাদা বিভাগের ওপর ন্যস্ত করা হলেই রাজস্ব আহরণ বাড়বে কিনা, সে বিষয়ে সন্দেহের বড় ধরনের অবকাশ রয়েছে।
রাজস্ব ব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে দেশে রাজস্ব আহরণ বাড়ছে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের ভাষ্যমতে, মূলত প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণেই কর আহরণ বাড়ানো যাচ্ছে না। এখনো দেশের অর্থনৈতিক ইউনিটগুলোর মধ্যে বৃহদংশই সরকারের করজালের বাইরে। আবার অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির আকারও ক্রমেই বাড়ছে। এর ধারাবাহিকতায় বিশ্বের অন্যতম নিম্ন কর-জিডিপি আহরণের দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। ব্যক্তি পর্যায়ে আয়কর ছাড়াও সেলফোনে কথা বলা থেকে শুরু করে কেনাকাটা, হোটেলে খাওয়া, সিনেমা দেখাসহ দৈনন্দিন লেনদেনে ভোক্তা ও গ্রাহকরা কোনো না কোনোভাবে করজালের আওতায় রয়েছেন।
কয়েক বছর ধরেই দেশে জিডিপির অনুপাতে কর আহরণের হার কমছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৮৮১ কোটি ৮০ লাখ টাকা রাজস্ব আহরণ করে এনবিআর। সে সময় কর-জিডিপির হার ছিল ১০ দশমিক ২২ শতাংশ। সেবার বাড়লেও পরে তা কমতে থাকে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২ লাখ ১৭ হাজার ৬০১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা আহরণ করে সংস্থাটি। কর-জিডিপির হার ছিল ৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ। এর পর কর-জিডিপির অনুপাত কখনই সাড়ে ৭ শতাংশ অতিক্রম করতে পারেনি। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থছরেও কর-জিডিপির অনুপাত ছিল ৭ দশমিক ৩২ শতাংশ। রাজস্ব আহরণ হয়েছে ৩ লাখ ৬১ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গত বছরের ৯ অক্টোবর রাজস্ব নীতি সংস্কারবিষয়ক একটি পরামর্শক কমিটি গঠন করে। কমিটির প্রধান করা হয় এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদকে। এছাড়া এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. নাসির উদ্দীন আহমেদ, সাবেক সদস্য মো. দেলোয়ার হোসেন, ফরিদ উদ্দীন ও আমিনুর রহমানকে এ কমিটির সদস্য করা হয়।
কমিটি গত বছরের ২২ ডিসেম্বর সরকারের কাছে একটি অন্তর্বর্তী সুপারিশ জমা দিয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি রাজস্ব আহরণ কার্যক্রমের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও গতিশীলতা বাড়াতে বিদ্যমান কাঠামো পুনর্গঠন করে রাজস্ব নীতি বিভাগ এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ গঠনের উদ্দেশ্যে একটি অধ্যাদেশের খসড়া তৈরি করেছে সরকার। এজন্য রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা (পৃথক্করণ) অধ্যাদেশ ২০২৫ শীর্ষক খসড়ায় রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নামে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের অধীনে দুটি বিভাগ গঠনের কথা বলা হয়েছে। বিসিএস (শুল্ক ও আবগারি) এবং বিসিএস (কর) ক্যাডারের ন্যূনতম ২০ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে পালাক্রমে এ দুই বিভাগের সচিব বা সিনিয়র সচিব নিয়োগ করা হবে। এ দুই বিভাগের অধীনে থাকা বিভিন্ন অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব, উপসচিব, সিনিয়র সহকারী সচিব ও সহকারী সচিব পদসহ সমপদমর্যাদার পদগুলোও বিসিএস কাস্টমস ও বিসিএস কর ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে পূরণ করা হবে।
এনবিআরের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেন, সরকারের রাজস্ব নীতি প্রণয়ন কার্যক্রম এবং রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পৃথক্করণের মূল উদ্দেশ্য হলো রাষ্ট্রীয় স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে এমন একটি কর কাঠামো প্রণয়ন করা, যাতে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করার মাধ্যমে বিপুল কর্মক্ষম জনগণের জন্য কর্মসংস্থান করা যায়। বাংলাদেশে আয়কর, মূসক এবং কাস্টমসসংক্রান্ত আইন এবং সংশ্লিষ্ট বিধি-বিধান এমন হতে হবে, যাতে বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্য আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর কর কাঠামোর তুলনায় আমাদের কর কাঠামো বেশি আকর্ষণীয় হয়। দেশী-বিদেশী ব্যবসা বাণিজ্যবান্ধব কর কাঠামো প্রণয়নের জন্য যে ধরনের বিচার-বিশ্লেষণ এবং গবেষণার প্রয়োজন এবং এ কাজগুলোর জন্য যে ধরনের জনবল কাঠামো প্রয়োজন, বিদ্যমান ব্যবস্থায় তার সংস্থান নেই। রাজস্ব নীতি বিভাগ স্বতন্ত্র একটি বিভাগের অধীন হলে সারা বছর বিভিন্ন খাতের ব্যবসা-বাণিজ্যের পর্যাপ্ত বিচার-বিশ্লেষণ এবং গবেষণালব্ধ তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন করা সম্ভব হবে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. নাসির উদ্দীন আহমেদ বলেন, কর নীতি ও কর সংগ্রহ কার্যক্রম আলাদা হলে রাজস্ব আহরণ কী পরিমাণ বাড়বে, এ ধরনের কোনো মডেলিং আমরা করিনি। ফলে সুনির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয় যে এতে রাজস্ব আহরণ কী পরিমাণ বাড়বে। তবে অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে এর ফলে বিচ্যুতি থাকবে না, সমঝোতামূলক সিদ্ধান্ত হবে না, অটোমেশন হবে এবং এনবিআর কর সংগ্রহের দিকেই বেশি মনোযোগী হবে। অন্যদিকে রাজস্ব নীতি প্রণয়নের দায়িত্বে যারা থাকবেন তাদের পরামর্শ অনুসারে নীতি প্রণয়ন করা হবে। শুধু একটি বা দুটি বিষয় নয়, সবগুলো বিষয় একসঙ্গে কাজ করলেই রাজস্ব আহরণ বাড়ানো সম্ভব হবে। দেশের অর্থনীতি যদি সমৃদ্ধ না হয়, ব্যবসা-বাণিজ্য যদি না বাড়ে তাহলে কর কোথা থেকে আহরণ হবে? তবে এটি একটি ভালো পদক্ষেপ।
উল্লেখ্য, বিশ্বের অধিকাংশ দেশের কর নীতি ও সংগ্রহ কার্যক্রম পৃথক করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ইন্টারনাল রেভিনিউ সার্ভিস (আইআরএস) প্রাথমিকভাবে কর সংগ্রহ করে থাকে। আর দেশটির কংগ্রেস কর নীতির বিষয়টি দেখভাল করে। কানাডাতে কানাডা রেভিনিউ এজেন্সি (সিআরএ) কর সংগ্রহ করে এবং দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার করনীতি নির্ধারণ করে দেয়া। ইউরোপের বেশির ভাগ দেশেই এ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে।
আপনার মতামত লিখুন :