যেকোনো দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী হিসেবে ধরা হয় ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সীদের। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা যেভাবে বেড়েছে, নতুন কর্মসংস্থান বেড়েছে তার তুলনায় একেবারেই সামান্য। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংকের এক পর্যালোচনায় উঠে এসেছে, ২০১৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এক দশকে দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী বেড়েছে গড়ে দেড় শতাংশ হারে। যদিও একই সময়ে কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি হয়েছে দশমিক ২ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতি বছর দেশে বিপুলসংখ্যক তরুণ কর্মক্ষম হয়ে উঠলেও তাদের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক কর্মসংস্থান তৈরি করা যায়নি। এমনকি বিভিন্ন খাতের সবচেয়ে উৎপাদনশীল প্রতিষ্ঠান বা ফ্রন্টিয়ার ফার্মগুলোও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। বরং অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক নানা দুর্বিপাকে চাকরি হারিয়েছেন অনেকে। এতে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী ও নতুন কর্মসংস্থানের গড় প্রবৃদ্ধিকেও ছাড়িয়ে গেছে কর্মহীনতা বৃদ্ধির গড় হার।
বিশ্বব্যাংকের ভাষ্যমতে, ২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রকৃত জিডিপির গড় প্রবৃদ্ধির হার দেখানো হয়েছে (৬ দশমিক ৪ শতাংশ) বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে বেশি। এমনকি দারিদ্র্যের হার নব্বইয়ের দশকের ৩০ শতাংশের বেশি হার থেকে কমিয়ে এনে ২০২২ সালে ৫ শতাংশ দেখানো হয়েছে। এসব পরিসংখ্যান কাজে লাগিয়ে ২০২৬ সালে বাংলাদেশকে অনুন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে নিয়ে আসা হচ্ছে। কিন্তু এসব পরিসংখ্যানের প্রতিফলন দেশে নতুন কর্মসৃজনের তথ্যে দেখা যাচ্ছে না।
ব্রেটন উডস সংস্থাটির গত মাসে প্রকাশিত ‘ফ্রন্টিয়ার ফার্মস অ্যান্ড জব ক্রিয়েশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এমন পর্যালোচনা উঠে আসে। প্রতিবেদনের ভাষ্যমতে, ২০১৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর হার বেড়েছে গড়ে দেড় শতাংশ করে। যদিও নতুন কর্মসংস্থানে প্রবৃদ্ধির গড় হার ছিল মাত্র দশমিক ২ শতাংশ।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক এবং ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির ধারা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে যতই সময় যাবে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়বে। আবার অর্থনীতির নানা বৈশিষ্ট্য এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা প্রবৃদ্ধির ধারার ওপর নির্ভর করছে কর্মসংস্থান কোন পথে বাড়বে। দুটো পরিসংখ্যান সামগ্রিকভাবে বিশ্লেষণে দেখা যাবে কর্মক্ষমদের একটি অংশ কর্মসংস্থানে নিয়োজিত হতে পারেননি। আমাদের এখানে সমস্যা হলো শোভন কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র গড়ে ওঠেনি, খুব কম। প্রাতিষ্ঠানিক বা আনুষ্ঠানিক খাতগুলোয় কর্মসংস্থানের সুযোগ খুব কম সৃষ্টি হয়। সৃষ্ট কর্মসংস্থানের বড় অংশটিই হলো অপ্রাতিষ্ঠানিক। এসব খাতে মজুরি খুব কম। সবকিছু ছাপিয়ে শোভন কর্মসংস্থানের ঘাটতি একটা বড় কারণ। এটা অর্থনীতির একটা কাঠামোগত সমস্যা। এর কারণে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতটিই এখন পর্যন্ত বড়। আবার প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের খাতও বাড়তে পারছে না। শুধু আমাদের না, বেশির ভাগ স্বল্পোন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের কাঠামোগত সমস্যা রয়েছে, ফলে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের আধিক্য রয়ে গেছে। এসব কারণে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোয় শোভন কর্মসংস্থান অনুপস্থিত।
বিগত বছরগুলো দেশে তরুণ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা তুলনামূলক স্থিতিশীল থাকলেও সংকুচিত হয়েছে তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ। ২০১৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হয়েছে ৩ দশমিক ৪ শতাংশ হারে। এতে দেশে তরুণ বেকারত্বের হার ১০ শতাংশ থেকে বেড়ে পৌঁছেছে ১৬ শতাংশে।
বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) একেএম ফাহিম মাসরুর বলেন, স্বাভাবিকভাবে বছরে নতুন যে ২৪-২৫ লাখ শ্রমশক্তি বাজারে আসে, তাদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট বিশেষ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বিভিন্ন কলেজ থেকে পাস করা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেকারত্ব খুবই বেশি। কারণ তারা গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর কৃষি, কারখানাসহ নিম্ন আয়ের কাজ করতে চায় না। আগে মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র সাড়ে ৩ শতাংশ গ্র্যাজুয়েট ছিল। এখন তা ১০ শতাংশ। গ্র্যাজুয়েশন করে তারা অন্যান্য কাজে আগ্রহী হচ্ছে না। আমাদের কৃষি ও শিল্প কারখানায় গ্র্যাজুয়েটের চাহিদার চেয়ে নন-গ্র্যাজুয়েটদের চাহিদা বেশি। ফলে এখানে পেশা নির্বাচনে সামাজিক অগ্রাধিকারে পরিবর্তন আসছে, যা তরুণ ও সামগ্রিক বেকারত্বের একটা বড় কারণ।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আমাদের অন্যতম বৃহৎ তরুণ জনগোষ্ঠী রয়েছে। যারা আমাদের মূল কর্মশক্তি। নানাবিধ কারণে এদের জন্য আমরা পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে পারছি না। অন্যতম কারণ হলো আমাদের প্রকৃত উদ্যোক্তা যারা রয়েছেন, তারা সেভাবে বড় হতে পারেন নি। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে যারা প্রতারণা করেছে, তাদের প্রবৃদ্ধি বেশি হয়েছে। আমরা শিল্পায়নকে যথাযথ সহায়তা করিনি। আমরা শিল্প প্রবৃদ্ধিরও রাজনৈতিকীকরণ করেছি। আমরা সংকোচন করে মাফিয়া চক্র বানিয়েছি। দেশের এমন একটি পরিস্থিতিতে অবাধ প্রবৃদ্ধি কীভাবে হবে? তাছাড়া সরকার তো কর্মসংস্থান করে না। কর্মসংস্থান করে সিভিল খাত। সরকার চাকরিদাতা না। সরকার একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে যা লাগে, তাই করে। আজকের দুনিয়ায় কোনো কিছুই সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই। উদাহরণস্বরূপ আমাদের পর্যটন খাতের কথা বলা যায়। খাতটিকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিলে এখানে হাজার হাজার তরুণের কর্মসংস্থান হতে পারে। বিশ্বের অনেক দেশেই এটা হচ্ছে। কিন্তু আমরা খাতটিকে বিকশিত করতে পারিনি। এটা করার জন্য প্রয়োজনীয় কোনো ধরনের উদ্যোগও আমরা নিতে পারিনি।
আপনার মতামত লিখুন :