নানা সংকটে থাকা ১১টি সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকের মধ্যে ছয়টি এরই মধ্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। গত ছয় মাসে আমানত সংগ্রহ ও গ্রাহকদের আস্থা পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে এসব ব্যাংক এই অগ্রগতি অর্জন করেছে। গত বছরের আগস্টে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব গ্রহণের পর বাংলাদেশ ব্যাংক ১৪টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে।
এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক এটির তারল্য সহায়তা কর্মসূচির আওতায় ৩০ হাজার কোটি টাকা নতুন অর্থ সরবরাহ করে পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া শুরু করে। ঘুরে দাঁড়ানো ছয়টি ব্যাংক হলো- ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল), এক্সিম ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি), আইএফআইসি ব্যাংক ও আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক। তবে বাকি পাঁচটি ব্যাংক এখনো পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।
জানা যায়, গত বছরের সেপ্টেম্বরে গ্যারান্টি প্রকল্পের অধীনে সাতটি সংকটাপন্ন ব্যাংককে ২৫ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল, যার মধ্যে এখনো ৭ হাজার কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। ফলে গ্যারান্টি প্রকল্পের আওতায় অন্য কোনো ব্যাংক এখন এসব সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংককে ঋণ দিতে আগ্রহী নয়। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এরই মধ্যে এই প্রকল্প বন্ধের পরামর্শ দিয়েছে, কারণ এটি ব্যাংক খাতকে উচ্চ ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই পাঁচ ব্যাংকের পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ বলে মনে করছে। ঋণ কার্যক্রম স্থগিত থাকায় এসব ব্যাংকের স্বাভাবিক কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। আমানত উত্তোলন পরিচালনার জন্য এগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থের ওপর নির্ভর করছে, কারণ এই ব্যাংকগুলো এখনো গ্রাহকদের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে পারেনি।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক একীভূতকরণ ও অধিগ্রহণ সহজ করতে আগামী জুলাইয়ের মধ্যে ব্যাংক রেজল্যুশন আইন চূড়ান্ত করার কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। ‘ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ’, ২০২৫-এর চূড়ান্ত খসড়া এরই মধ্যে অনুমোদনের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
এ অধ্যাদেশ বাংলাদেশ ব্যাংককে অকার্যকর ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা দেবে। এর আওতায় অস্থায়ী প্রশাসক নিয়োগ, নতুন বা বিদ্যমান শেয়ারহোল্ডারদের মাধ্যমে মূলধন সংগ্রহ, তৃতীয় পক্ষের কাছে শেয়ার, সম্পদ ও দায় হস্তান্তর, গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি সেতু ব্যাংক প্রতিষ্ঠা এবং ব্যর্থ ব্যাংক বিক্রির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে গভর্নর মন্তব্য করেন, সব ব্যাংক টিকে থাকবে না। তিনি আরও বলেন, কিছু ব্যাংকের টিকে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। কিছু ক্ষেত্রে ব্যাংকের ৮৭ শতাংশ আমানত মাত্র একটি পরিবারের কাছে দেওয়া হয়েছে। এ পাঁচ ব্যাংকের মধ্যে চারটি আগে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এসব ব্যাংকের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত, কারণ এগুলোর ৮০ শতাংশেরও বেশি আমানত ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ এক ব্যাবসায়িক গোষ্ঠীর কাছে কেন্দ্রীভূত ছিল।
এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ সরে যাওয়ার পর দেশের বৃহত্তম বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক আমানতকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে। পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠনের পর ব্যাংকটি গত ছয় মাসে ১৭ হাজার কোটি টাকা নতুন আমানত সংগ্রহ করেছে।
গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে ব্যাপক আমানত উত্তোলনের চাপে পড়েছিল ব্যাংকটি, যার ফলে গ্রাহকদের চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে তারল্য সহায়তা নিতে হয়। তবে বর্তমানে এই পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, কারণ রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ার ফলে ব্যাংকটি পুনরায় স্থিতিশীল হতে শুরু করেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্যারান্টি স্কিমের আওতায় ৫ হাজার কোটি টাকা তারল্য সহায়তা পায়। তবে, আমানতের ধারাবাহিক প্রবাহ বজায় থাকায় সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ব্যাংকটির আর তারল্য সহায়তার প্রয়োজন হয়নি।
এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ থেকে ব্যাংক মুক্ত হওয়ার পর চেয়ারম্যান নিযুক্ত ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ জানান, গত ছয় মাসে ব্যাংকটিতে সাড়ে ১২ লাখ নতুন অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। তিনি ব্যাংকের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়ায় সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকাকে কৃতিত্ব দিচ্ছেন। তিনি আরও জানান, ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার মূল্যায়নের জন্য একটি অডিট ফার্ম নিয়োগ করা হয়েছে এবং অতীতের অনিয়মের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
এদিকে ঝুঁকিপূর্ণ পাঁচটি ব্যাংকের মধ্যে চারটি আগে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতির অভিযোগে আলোচিত। এসব ব্যাংক হলো বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক এবং ইউনিয়ন ব্যাংক। পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠনের পরও ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থার উন্নতি হতে সময় লাগছে।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এস আলম ব্যাংকটির আমানতের ৮০ শতাংশ বেনিফিশিয়ারি। অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তিনটি ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংকের জন্য তারল্য সহায়তা বন্ধ করে দিয়েছে, কারণ এগুলো পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা খুবই কম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, এসব ব্যাংকের আমানত ভান্ডার তুলনামূলক ছোট হওয়ায় এগুলো বড় দুর্নীতির ধাক্কা সামলাতে পারছে না। গত ১৫ বছর ধরে সিকদার পরিবারের নিয়ন্ত্রণে থাকা ন্যাশনাল ব্যাংকও আমানতকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারে লড়াই করছে। দীর্ঘদিন ধরে লুটপাট চলতে থাকলেও অতীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।