মার্চ শেষ হতে আরও কয়েক দিন বাকি। তার আগেই একক মাস হিসেবে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স আসার নতুন রেকর্ড তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চলতি মাসে প্রবাসী বাংলাদেশিরা গত বুধবার পর্যন্ত দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ২৯৪ কোটি ৫০ লাখ বা ২ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এর আগে দেশের ইতিহাসে এক মাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আসার রেকর্ড হয়েছিল গত ডিসেম্বরে। ওই মাসে মোট ২৬৩ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল বাংলাদেশে।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, রমজান ও ঈদকে কেন্দ্র করে সবসময়ই রেমিট্যান্স প্রবাহে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে। তবে এবারের মতো এত বেশি প্রবৃদ্ধি অতীতে কখনই দেখা যায়নি। এবার রমজান ও ইংরেজি মার্চ মাস প্রায় একই সময়ে শুরু ও শেষ হচ্ছে। এ কারণে মাসের পুরো সময়েই প্রবাসীরা বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। এরপরও রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে মাসে ৩ বিলিয়ন ডলারের রেকর্ড গড়া দেশের অর্থনীতির জন্য একটি বড় অর্জন। কারণ এ উল্লম্ফনে দেশ থেকে অর্থ পাচার ও হুন্ডির তৎপরতা কমে যাওয়ারও বড় প্রভাব রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. আরিফ হোসেন খান বলেন, চলতি মার্চের ২৫ ও ২৬ তারিখে মাত্র দুইদিনে রেমিট্যান্স এসেছে ১৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার। আর ১ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত রেমিট্যান্স এসেছে ২৯৪ কোটি ৫০ লাখ বা ২ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার। এর আগে, ২০২৪ সালের মার্চের প্রথম ২৬ দিনে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৬১ কোটি ৪০ লাখ ডলার। সে হিসাবে চলতি মাসে রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮২ দশমিক ৪ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরে ২৬ মার্চ পর্যন্ত (১ জুলাই থেকে ২৬ মার্চ) দেশে মোট রেমিট্যান্স এসেছে ২১ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ২ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা । গত অর্থবছরের একই সময়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৬ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরে প্রবাসীরা ৪ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার বেশি পাঠিয়েছেন। এক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ২৮ দশমিক ৪ শতাংশ।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, দেশ থেকে বিদেশে হুন্ডির চাহিদা তৈরি হয়। বাংলাদেশীদের পাচারকৃত অর্থের বড় অংশ সংগ্রহ করা হয় বিদেশে প্রধান শ্রমবাজারগুলো থেকে। গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশ থেকে টাকা পাচারের পথ অনেকটাই সংকুচিত হয়ে এসেছে। এর ফলে বিদেশে হুন্ডি কারবারিদের চাহিদাও কমেছে। কালোবাজারে চাহিদা কমলে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ে। বর্তমানে ব্যাংক খাতে রেমিট্যান্স প্রবাহে যে উল্লম্ফন আমরা দেখছি, এটি তারই প্রভাব।
তিনি বলেন, রেমিট্যান্সের বিদ্যমান প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে টাকা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আরো কঠোর হতে হবে। টাকা পাচার বন্ধ হলে হুন্ডির তৎপরতাও কমে যাবে। প্রবাসী বাংলাদেশীরা বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে আরো বেশি উৎসাহিত হবেন। আর যে প্রবাসীরা অর্থনীতিতে এত বড় ভূমিকা রাখছেন, তাদের জন্যও সরকারের দিক থেকে সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে।
এদিকে, রেমিট্যান্সের ওপর ভর করে গত এক সপ্তাহে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় ৩৩ কোটি ডলার বেড়েছে। গত ২০ মার্চ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী (বিপিএম৬) দেশের রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। গতকাল ২৭ মার্চ এ রিজার্ভের পরিমাণ বেড়ে ২০ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে।
ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) এ নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, রেমিট্যান্সের বেশির ভাগই প্রবাসী পরিবারের ভোগে ব্যয় হয়ে যায়। যেটুকু উদ্বৃত্ত থাকে সেটি দিয়েও বাড়ি নির্মাণ বা জমি কেনা হয়। দেশে যদি প্রবাসীদের বিনিয়োগের ভালো কোনো ক্ষেত্র থাকত, তাহলে রেমিট্যান্সের অর্থ দেশের অর্থনীতিতে আরো জোরালো ভূমিকা রাখতে পারত।
তিনি বলেন, প্রবাসীদের জন্য ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড আছে। কিন্তু এ বন্ডের বিষয়ে প্রবাসীদের মধ্যে তেমন কোনো প্রচারণা বা সচেতনতা নেই। যেসব প্রবাসীর কাছে বিনিয়োগের মতো সঞ্চয় আছে, তারা দেশে বিনিয়োগের কোনো খাত খুঁজে পান না। এখানে পুঁজিবাজার বলে তেমন কিছু অবশিষ্ট নেই। সরকার যদি প্রবাসীদের জন্য বিনিয়োগের ক্ষেত্র তৈরি করে দিতে পারত, তাহলে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট অনেকাংশেই কেটে যেত।