ঢাকা সোমবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২৫

ব্যবসার উচ্চ খরচে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাচ্ছে বাংলাদেশ

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: এপ্রিল ১৩, ২০২৫, ১০:৫২ এএম
প্রতীকি ছবি

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর একটি কম্বোডিয়া। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এ দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার এখনো ৫০ বিলিয়ন ডলারেরও কম। আকারে এত ছোট অর্থনীতির দেশ হওয়া সত্ত্বেও গত বছর প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আকৃষ্ট করতে পেরেছে। এক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে তাদের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, বিনিয়োগবান্ধব নীতি, অবকাঠামো খাতে ব্যাপক উন্নয়ন, সুশাসন ও নামমাত্র সুদহার। বর্তমানে কম্বোডিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদহার ১ শতাংশেরও কম। গত মাসে উচ্চ প্রবৃদ্ধির দেশটির মূল্যস্ফীতির হারও ছিল ১ শতাংশের নিচে।

বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্টের ক্ষেত্রে সামনের সারিতে রয়েছে একই অঞ্চলের আরেক দেশ থাইল্যান্ড। ২০২৪ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটি ১ দশমিক ১৪ ট্রিলিয়ন বাথ (প্রায় ৩৩ বিলিয়ন ডলার) বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছে। গত বছর তাদের এফডিআই বেড়েছে প্রায় ৩৫ শতাংশ, যা ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী থাইল্যান্ডের নীতি সুদহার ও মূল্যস্ফীতি ২ শতাংশের ঘরে।

কেবল থাইল্যান্ড কিংবা কম্বোডিয়া নয়, বরং প্রতিদ্বন্দ্বী কিংবা এ অঞ্চলের বড় অর্থনীতির প্রতিটি দেশের নীতি সুদহার ও মূল্যস্ফীতি এখন বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত নীতি সুদহার (রেপো রেট) ১০ শতাংশ। অন্যদিকে, প্রতিবেশী দেশ ভারতের নীতি সুদহার ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ, নেপালের ৬ দশমিক ৫ ও শ্রীলংকার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে কেবল পাকিস্তানের নীতি সুদহার (১২ শতাংশ) এখন বাংলাদেশের তুলনায় বেশি। যদিও এক বছর আগে ছিল ২৩ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসার সঙ্গে সঙ্গে নীতি সুদহারও কমিয়ে এনেছে পাকিস্তান।

বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী অর্থনীতির দেশ ভিয়েতনামের নীতি সুদহার এখন ৩ শতাংশ। বৃহৎ অর্থনীতির দেশ চীনের সুদহার তিন দশমিক ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রও সুদহার কমিয়ে চার দশমিক ৩৩ শতাংশে নামিয়ে এনেছে।

বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২০ সালে করোনা মহামারি শুরুর পর প্রায় সবকটি দেশের নীতি সুদহার কমিয়ে আনা হয়। কিন্তু ২০২১ সালের শুরুর দিকে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেলে আবার তা বাড়ানো হয়। এরপর গত দুই বছরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এলে সুদহার কমিয়ে দেয় দেশগুলো। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ করেছে ঠিক তার উল্টো।

অর্থনীতিবিদরা বলেন, বাংলাদেশে কেবল নীতি সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়েছিল। এ কারণে মূল্যস্ফীতি না কমে অর্থনীতিতে নেমে এসেছে স্থবিরতা। দেশে মূল্যস্ফীতি বাজারে সরবরাহ সংকট, সিন্ডিকেট ও মাফিয়াতন্ত্রের কারণে বেড়েছে । শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরও সে সংকটগুলো বহাল রয়েছে। এ কারণে প্রত্যাশা অনুযায়ী মূল্যস্ফীতি কমানো যাচ্ছে না। আবার বিনিয়োগ খরায় গতিও বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না অর্থনীতির। ব্যবসার পরিচালন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাচ্ছে বাংলাদেশ।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, বিশ্বের প্রায় সব দেশ যখন নীতি সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নিয়েছে,তখন সময়ক্ষেপণ করেছে  বাংলাদেশ ব্যাংক। এ কারণে অন্য দেশগুলোয় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এলেও আমাদের আসেনি। আবার একসময় আমাদের নীতি-নির্ধারকরা সুদহার বাড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু বাজারে সরবরাহ নিশ্চিত করা, বাজার ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনা এবং সিন্ডিকেট ভাঙায় মনোযোগ দেয়া হয়নি।

আইএফসির প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে জিডিপির অনুপাতে বিদেশি বিনিয়োগ মাত্র দশমিক চার শতাংশ (২০২৩)। আবার যে বিনিয়োগ আসছে, তা মূলত দেশে ব্যবসারত বিদেশি কোম্পানিগুলোই করছে। নতুন কোম্পানি কম আসছে।

বিদেশি বিনিয়োগ জরিপের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে রেগুলেটরি বা নিয়ন্ত্রণমূলক সমস্যা রয়েছে। এর মধ্যে আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা, নীতির ঘন ঘন পরিবর্তন, সুশাসনের অভাব, আইনের জটিলতা, প্রাতিষ্ঠানিক অদক্ষতা ও সমন্বয়ের অভাবের মতো বিষয়গুলো রয়েছে।

উচ্চ সুদহারের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বর্তমানে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতিই সবচেয়ে বেশি। অথচ মার্চে শ্রীলংকায় এ হার ছিল ঋণাত্মক ২ দশমিক ৬০ শতাংশ। যেখানে দুই বছর আগেও নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করা দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্রটির মূল্যস্ফীতি ৭০ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছিল। শ্রীলংকার মতোই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নজিরবিহীন সাফল্য পেয়েছে পাকিস্তান। মার্চে দেশটির মূল্যস্ফীতি দশমিক ৭০ শতাংশে নেমেছে, যা এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। অথচ এক বছর আগেও পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতি ছিল ২০ শতাংশের বেশি। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়া এ দুটি দেশের মতো দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মূল্যস্ফীতির হারও বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম। এর মধ্যে গত মাসে ভারতের মূল্যস্ফীতি ছিল ৪ দশমিক ৩১ শতাংশ।

বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ  বলেন, দেশে ব্যাংক ঋণের সুদহার এখন ১৫ শতাংশের বেশি। এখানে এত সুদ দিয়ে বিনিয়োগ করবে কে? উচ্চ সুদ ছাড়াও আমাদের বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবহন ব্যয়ও প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর তুলনায় বেশি। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কথা না হয় বাদই দিলাম। এ অবস্থায় বিদেশিরা এখানে কেন বিনিয়োগ করতে আসবে?

তিনি বলেন, বিদেশিরা বাংলাদেশের ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয় না। স্থানীয় বিনিয়োগকারীরাই অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্র থেকে ঋণ নেয়। তবে বিদেশিরা তখনই বিনিয়োগ করে, যখন স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে আসে। স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা এখন নানা কারণে বিনিয়োগ করতে চাচ্ছে না। আমরা যদি না করি, তাহলে বিদেশিরাও আগ্রহী হবে না।