আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করাকে প্রধান অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করছে সরকার। চলমান বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সংকট, রাজস্ব আদায়ের ধীরগতি এবং বৈদেশিক ঋণদাতাদের সতর্ক পূর্বাভাসের প্রেক্ষাপটে এবারের বাজেট হবে তুলনামূলকভাবে সংযত ও বাস্তবভিত্তিক।
বাজেটের আকার ও কাঠামো
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী বাজেটের আকার হবে প্রায় সাত লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের মূল বাজেট (সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা) থেকে সামান্য কম। বাজেট ঘাটতি সীমিত রাখতে এবং মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে এই সংযমী বাজেট পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
মূল্যস্ফীতিই প্রধান চ্যালেঞ্জ
বর্তমানে দেশে মূল্যস্ফীতির হার রয়েছে ৯.৩৫ শতাংশে (মার্চ ২০২৫, বিবিএস)। সরকার আগামী অর্থবছরে এটি সাড়ে ছয় শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করছে। অথচ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) পূর্বাভাস দিয়েছে, মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি কমানোর লক্ষ্যেই আমরা উচ্চাভিলাষী প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য থেকে সরে এসেছি। জিডিপির প্রবৃদ্ধি কম রাখলে অভ্যন্তরীণ ঋণ কমে, যা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হতে পারে।’
প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য পুনর্বিন্যাস
সরকার আগের পরিকল্পনায় ছিল ৬ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে, তবে এখন সে অবস্থান থেকে সরে এসেছে। নতুন লক্ষ্যমাত্রা হতে পারে সাড়ে পাঁচ শতাংশ, যা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পূর্বাভাসের কাছাকাছি। উদাহরণস্বরূপ, এডিবি আগামী অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫.১ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের মতে, দক্ষিণ এশীয় গড় প্রবৃদ্ধির তুলনায় বাংলাদেশের জন্য ৬ শতাংশ একটি উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা।
রাজস্ব সংগ্রহ ও বাজেট ঘাটতি
রাজস্ব আদায়ে ধীরগতি এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর পরামর্শ অনুযায়ী বাজেট ঘাটতি দুই লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার নিচে রাখার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে করে সরকারকে ব্যাংক খাত থেকে বেশি ঋণ নিতে হবে না, ফলে তা মুদ্রাস্ফীতি বাড়াবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে।
উন্নয়ন ব্যয় ও বার্ষিক কর্মসূচি
বাজেটের মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার নির্ধারণ করা হয়েছে দুই লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। উল্লেখ্য, চলতি অর্থবছরে মূল এডিপি ছিল দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা, যা পরে সংশোধন করে কমিয়ে দুই লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা করা হয়।
বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা
অর্থনীতি বিশ্লেষকদের মতে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা বাস্তবভিত্তিক। তবে তারা সতর্ক করেছেন যে, বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ বাজারের অস্থিরতা, জ্বালানি মূল্য, আমদানি ব্যয় এবং রপ্তানি আয়ের ওপর নির্ভর করে বাস্তব চিত্র নির্ধারিত হবে।
বাজেট প্রস্তুতির অন্যতম নেতৃত্বদানকারী অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত রাজস্ব সমন্বয় পরিষদের বৈঠকে এসব বিষয় নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়।
সংযত বাজেট প্রণয়নের মাধ্যমে সরকার একদিকে যেমন মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে চায়, অন্যদিকে উন্নয়ন ব্যয়কে কার্যকরভাবে ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার লক্ষ্যেও কাজ করছে। তবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হলে এই পরিকল্পনা ব্যাহত হতে পারে- এমন মতামতও উঠে আসছে বিভিন্ন মহল থেকে।