ঢাকা শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪

২১ অক্টোবর আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভা

মো. সায়েম ফারুকী

প্রকাশিত: অক্টোবর ২, ২০২৪, ০৭:১৮ পিএম

২১ অক্টোবর আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভা

ফাইল ছবি

আগামী ২১ অক্টোবর থেকে ওয়াশিংটন ডিসিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং বিশ্বব্যাংকের (ডব্লিউবি) বার্ষিক সভা শুরু হবে। অক্টোবরে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক গ্রুপের আসন্ন বার্ষিক সভার সময় আরও আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা ঋণদাতা সংস্থাগুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।

তিনি বলেছেন,

সরকার বিভিন্ন চলমান ও ভবিষ্যৎ কর্মসূচির জন্য বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তা চেয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আবারও সমর্থন জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটির ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের ঢাকা সফর শেষে বিবৃতিতে এই সমর্থন জানিয়েছে। বিশেষত ব্যাংকখাতের সংস্কার, পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধার, আয়কর ও ভ্যাট আদায় বৃদ্ধিসহ কর সংস্কারের মতো ক্ষেত্রে সহায়তা চাইছে সরকার। ড. সালেহউদ্দিন বলেন, বিভিন্ন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সংস্কার সাধনের জন্য সরকারের সম্পদের প্রয়োজন। সহায়তার জন্য আইএমএফকে অনুরোধ করা হলেও, পুনরাবৃত্তি এড়াতে অন্যান্য উন্নয়ন অংশীদারদের সঙ্গেও সমন্বয় করছে সরকার।

আইএমএফ বলেছে, বাংলাদেশের আর্থিক খাতের দুর্বলতা আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে আর্থিক কৃচ্ছ্র সাধন এবং এখন প্রয়োজন নেই এমন খরচকে সমন্বয় করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রচেষ্টাকে আমরা সমর্থন করি।

এদিকে, বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন, বাংলাদেশের সংস্কার উদ্যোগে সহায়তা করতে বিশ্বব্যাংক ৩.৫ বিলিয়ন ডলার দেবে। এর মধ্যে ২ বিলিয়ন ডলার নতুন ঋণ এবং ১.৫ বিলিয়ন ডলার বিদ্যমান কর্মসূচি থেকে পুনঃনির্ধারণ করা হবে। নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে বাঙ্গা এ ঘোষণা দেন।

বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠালগ্ন (১৯৪৬) থেকেই গরিবী দূর করা ও উন্নয়নের কথা বলে আসছে। এখন তার সাথে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি। কাজেই উন্নয়নের কথা বলার পাশাপাশি বাসযোগ্য পৃথিবীর কথা যুক্ত করা হয়েছে। বলাবাহুল্য, বিশ্বব্যাংক এবং তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বীকার করতে হচ্ছে যে পৃথিবী আর বাসযোগ্য নেই।

এই সভা বিশ্বব্যাংক ও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠান, যাদের একযোগে  বলা হয় ‘ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপ (ডব্লিউবিজি)’– তাদের বিশ্বময় কার্যকলাপের আলোচনা ও পর্যালোচনা করা হয়। বিশ্বব্যংক এই সম্মেলনে বাসযোগ্য পৃথিবীতে দারিদ্র খতম করার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছে।

সম্মেলন স্থানটির নাম বাব ঈগ্লী (Bab Ighli); শহর থেকে একটু বাইরে প্রায় ৩০০ হেক্টর জমির ওপর এক বিশাল অস্থায়ী স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। এই স্থাপনায় বেশির ভাগ সাদা রংয়ের কাঠ ব্যবহার হয়েছে। সম্মেলন স্থলের একটি স্টলের দায়িত্বে থাকা মরক্কোর এক তরুণী বললেন, এই কাঠের নাম বোয়িস রোউগ। স্থাপনাটি এমনভাবে বানানো যে, বাইরে তীব্র গরম থাকলেও ভেতরে তেমনটি বোঝা যায় না; প্রত্যেকটা মিটিং রুম এসি লাগানো ছিল এবং বেশ ঠাণ্ডা। এভাবে শত শত রুম তৈরি করা হয়েছে ।

বিশ্বব্যাংকের শর্ত এবং নয়া উদারবাদী অর্থনৈতিক নীতির কারণে বিভিন্ন দেশে ধনী-গরিব ব্যবধান বাড়ছে। দারিদ্র বিমোচনের জন্য নানা ধরনের অর্থনৈতিক কর্মসূচি নেওয়া হলেও গরিবের হার নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। তাই বিশ্বব্যাংকের সমালোচনা হচ্ছে প্রচুর। এশিয়া, লাতিন আমেরিকা, এবং বিশেষ করে আফ্রিকার দেশগুলোতে বিশ্বব্যাংকের স্ট্রাকচাররাল অ্যাডজাস্টমেন্ট পলিসি বা কাঠামোগত সংস্কারের নীতি মারাত্মক ক্ষতি করেছে। বাংলাদেশেও এই নীতি অনুসরণ করা হয়েছে। কিন্তু এর ফলাফল ভাল হয়নি। তাই প্রতিবাদ হচ্ছে।

সারাবিশ্বে এখন এগ্রোইকোলজি বা প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর কৃষির প্রয়োজনীয়তার কথা উঠেছে। কারণ জলবায়ু বিপর্যয়ের জন্য দায়ী কার্বন নির্গমন কৃষিখাত থেকেই বেশি হচ্ছে। কিন্তু এই কৃষি ক্ষুদ্র কৃষকদের কৃষি নয়, এই কৃষি হচ্ছে জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর ইন্ডাস্ট্রিয়াল কৃষি। যেখানে শুধু মাংস উৎপাদনের জন্য ব্রাজিলে বন ধ্বংস করে দেওয়া হয়, বাণিজ্যিক চাষাবাদের সুবিধার জন্য একাট্টা ফসল উৎপাদন করে বৈচিত্র্য নষ্ট করা হচ্ছে। সার কীটনাশকের ব্যবহার কমানোর চেয়ে  বাড়ানো হচ্ছে। নতুন নতুন ক্ষতিকর প্রযুক্তি জোর করে প্রবর্তন করা হচ্ছে।

বিশ্বব্যাংক গ্রুপের সম্মেলন কেন্দ্র বাব ঈগলীর বাইরে শহরের ভেতরে মেদিনায় আরো একটি আয়োজন ছিল, তার নাম ছিল কাউন্টার সামিট। এখানে অনেক দেশের এক্টিভিস্টরা এসেছিলেন। বিশ্বব্যাংকের নীতি দ্বারা যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তারা তাদের কথা বলেছেন। একটি প্রতিবাদ মিছিলও তারা করেছেন। এই সম্মেলনেও আমি যোগ দিয়েছি। দেখা হয়েছে সম্প্রতি প্রকাশিত The World Bank: A Critical History এর লেখক Eric Toussaint এর সাথে। বইটি তার কাছ থেকে নিয়েছি।

দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর নয়া বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্যে ব্রেটন উডস সম্মেলন থেকে যে দুটি মহা শক্তিশালী আর্থিক প্রতিষ্ঠান– বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ গড়ে উঠেছে, তার পুরো ইতিহাস তিনি লিখেছেন। গত ৩০ বছর ধরে তিনি এই দুটি প্রতিষ্ঠানের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করছেন। বইটি লেখা শুরু হয় ২০০৪ সালের মার্চ মাস থেকে। এই বইতে যেসব তথ্য দেওয়া হয়েছে তা বিশ্ব ব্যাংকেরই দলিলপত্র, প্রায় ১৫,০০০ (পনের হাজার) পৃষ্ঠা তাকে পড়তে হয়েছে।

এছাড়াও, তিনি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে কথা বলেছেন এবং তাদের দলিলপত্র সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করেছেন। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যে জনগণের পক্ষে যাচ্ছে না, তা বোঝার জন্য বিশ্বব্যাংকের দেওয়া বিভিন্ন দেশের মধ্যে সম্পদ ও আয়ের বৈষম্য দেখলেই বোঝা যায়। পুঁজি সারাবিশ্বে ছড়িয়ে গেছে, যেখানে একটি ক্ষুদ্র পুঁজিপতি অংশ ফুলে ফেঁপে ধনী হচ্ছে, আর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ গরিব হতে থাকছে। বিশ্বের ১০% মানুষ মোট সম্পদের ৫২.১% ভোগ করেন, আর ৫০% গরিবরা ভোগ করেন ৯.৭%। এই তথ্য নেওয়া হয়েছে ওয়ার্ল্ড ইনইক্যুয়ালিটি ডেটাবেজ থেকে।

বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ উন্নয়নে সহযোগিতা দেবে এটাই তাদের কাজ; কিন্তু যেসব নীতি তারা চাপিয়ে দিচ্ছে, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো এখন আর তা নিতে পারছে না। আমরা আশা করবো বিশ্বব্যাংক জনগণের কথা শুনবে এবং জনগণের পক্ষে কাজ করবে।

১৯৭২ সালের ১৭ আগস্ট বাংলাদেশে আইএমএফে যোগদান করে এবং ১৯৯৪ সালের ১১ এপ্রিল আর্টিকেল ৮-এর ধারা ২, ৩ ও ৪-এর অধীনে বাধ্যবাধকতায় সম্মত হয়। আইএমএফ ঋণ দেয় তার নিজস্ব সম্পদের বিশেষ হিসাব থেকে, যাকে স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস বা এসডিআর বলা হয় (১ এসডিআর সমান প্রায় ১ দশমিক ৩৫৩৫৫০)। আইএমএফে বাংলাদেশের কোটা আছে ১ হাজার ৬৬ মিলিয়ন এসডিআর। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ নিট ঋণ ছিল ৬৩০ দশমিক ৮২ মিলিয়ন।

আরবি/এফআই

Link copied!