ঢাকা শুক্রবার, ০৩ জানুয়ারি, ২০২৫

সোনালি আঁশে সুদিন ফেরানোর চেষ্টা

রূপালী প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৩১, ২০২৪, ০৫:৪২ পিএম

সোনালি আঁশে সুদিন ফেরানোর চেষ্টা

ছবি: সংগৃহীত

সোনালি আঁশের সোনালি দিন ফেরাতে বিশেষ কার্যক্রম হাতে নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এজন্য পাটশিল্পের বকেয়া ঋণ পরিশোধে বিশেষ সুবিধা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে পলিথিনের বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে পাটপণ্য ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। পরিবেশ রক্ষায় পর্যায়ক্রমে পলিথিনের ব্যবহার শূন্যে নামানোর পরিকল্পনা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে পাটের পাশাপাশি অন্য শিল্প খাত যেমন কাগজশিল্প ও সিমেন্ট খাতের যেসব কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে সেগুলো পুনরায় চালু করার জন্যও সরকারি ও ব্যাংকিং-সংক্রান্ত সহায়তা জরুরি বলে মনে করেন শিল্পসংশ্লিষ্টরা। অন্যথায় সামষ্টিক অর্থনীতির চাকা সচল রাখা দুরূহ হয়ে পড়বে। এদিকে বিশ্বে পাটের চাহিদা বাড়ায় ২০২০-২১ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি থেকে রেকর্ড ১ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার আয় করে বাংলাদেশ। দেশবিদেশে পাটের বহুমুখী ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। সোনালি আঁশে আবার সোনালি দিন ফেরার স্বপ্ন দেখছেন কৃষক। শীতপ্রধান দেশগুলোয় প্রায় ৫০ ধরনের পাটের কাপড় রপ্তানি হয়। জানা গেছে, নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে গত কয়েক বছরে শত শত পাটকল বন্ধ হয়ে গেছে। একই সঙ্গে ডলারের দাম বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক অচলাবস্থার কারণে দেশের কাগজ, সিমেন্ট ও ইস্পাতশিল্পেও নেমে এসেছে মন্দা পরিস্থিতি। ডলারের দাম ৮০ থেকে ১২২ টাকায় উঠে যাওয়ায় এসব শিল্পের কাঁচামাল আমদানির খরচ বেড়ে গেছে। এ ছাড়া বেড়েছে উৎপাদন খরচও। অথচ দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার অবনতির কারণে নির্মাণ খাতে এসব পণ্যের চাহিদা কমেছে; যার ফলে এসব শিল্পের বহু কারখানা রুগ্ন হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক শিল্পমালিক ব্যাংক ঋণের কিস্তি নিয়মিতভাবে পরিশোধ করতে না পারায় খেলাপি হয়ে গেছেন। এমনকি কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন অনেকেই। ফলে অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের গতি স্বাভাবিক রাখতে এসব রুগ্ন শিল্প আবারও চালু করার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন শিল্পোদ্যোক্তারা। জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ১৪ নভেম্বর এ-সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে। যার মাধ্যমে পাট খাতের বকেয়া (অনিয়মিত) ব্যাংক ঋণ ব্লক হিসেবে স্থানান্তর করে ১০ বছরের পরিশোধ সুবিধা দিতে বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ন্যূনতম দেড় শতাংশ ডাউন পেমেন্ট আদায় নিশ্চিত করতেও বলা হয়েছে। পাশাপাশি এক বছরের জায়গায় গ্রেস পিরিয়ড দুই বছর করা হয়েছে। এসব সুবিধা নিশ্চিত করতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা দিয়েছে। এর আগে চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে আরেকটি আদেশ জারি করে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পাট খাতে গত বছরের জুন পর্যন্ত ঋণ আদায়ের সুদ ও আসল পৃথক ব্লক হিসেবে স্থানান্তর করতে বলা হয়েছে। এসব ঋণ পরিশোধে ১০ বছর সুবিধা পাবে। তবে ঋণ পরিশোধ পুনর্নির্ধারণের ক্ষেত্রে গ্রেড পিরিয়ড এক থেকে দুই বছরে উন্নীত করা হয়েছে। এ ছাড়া ঋণ ব্লক সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে ন্যূনতম ১ দশমিক ৫ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট আদায় নিশ্চিত করতে হবে। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতেও শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো।

জানা গেছে, পাটপণ্যের রপ্তানি বাড়াতে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এ খাতের নারী উদ্যোক্তাদের দক্ষতা বাড়িয়ে দেশি ও আন্তর্জাতিক বাজারে পাটপণ্যের বিপণন বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এজন্য ৩১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এদিকে সিমেন্ট শিল্পের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি বছরের ৫ আগস্টের পর ইউনিয়ন থেকে শুরু করে সিটি করপোরেশন, কিংবা বড় বড় স্থাপনার কাজ বন্ধ রয়েছে। ফলে যেখানে বছরে শিল্পের প্রবৃদ্ধি ছিল ১০-১২ শতাংশ, সেখানে গত চার মাসে ৪-৫ শতাংশে নেমে এসেছে।

বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএমএ)-এর তথ্যমতে, দেশে ৩০টি বড় কোম্পানি রয়েছে। এসব কোম্পানির ৪০টি কারখানা রয়েছে। চলতি বছর কারখানাগুলো ৪ কোটি টন সিমেন্ট উৎপাদন করেছে। বিপরীতে এ সময়ে চাহিদা ছিল ৩ কোটি ১১ লাখ টন। এক বছর আগে অর্থাৎ ২০২৩ সালে কোম্পানিগুলোতে সিমেন্ট উৎপাদিত হয়েছিল ৩ কোটি ৮৫ লাখ টন; গত জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত একই সময়ে হয়েছে ৩ কোটি ১৮ লাখ টন। অর্থাৎ ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালের একই সময়ে সিমেন্ট বিক্রি কমেছে ২ দশমিক ৫০ শতাংশ। তবে কোম্পানিগুলোর পরিসংখ্যানমতে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ২ কোটি ৭২ লাখ ৬৮ হাজার ৪২ টন সিমেন্ট বিক্রি হয়েছে; যা ২০২৩ সালে ছিল ৩ কোটি ৮৩ লাখ ৫৪ হাজার ৫১৬ টন। অর্থাৎ প্রায় এক-তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে সিমেন্ট বিক্রি। ২০২২ সালে ছিল ৩ কোটি ৮৫ লাখ ৯৩ হাজার ৭৭১ টন এবং ২০২১ সালে ছিল ৩ কোটি ৯১ লাখ ৭৬ হাজার ৪৩৮ টন। প্রায় একই অবস্থা বিরাজ করছে ইস্পাতশিল্পের ক্ষেত্রেও। বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএসএমএ) সূত্র বলছেন, বাংলাদেশে ইস্পাতের কাঁচামালের যে চাহিদা, তার ২০ থেকে ৩০ শতাংশ অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে পাওয়া যায়। বাকি চাহিদা মেটানোর জন্য ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। আর এ আমদানির উৎস ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ। তবে ডলারের অব্যাহত দর বৃদ্ধি ও চীনের বাজার অস্থিতিশীলতার ধারাবাহিকতায় এখন এসব দেশ থেকেও বাড়তি দামে পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। এতে বেড়েছে উৎপাদন খরচ। অথচ সারা দেশে নির্মাণকাজ প্রায় বন্ধ থাকায় বিক্রি অর্ধেকে নেমেছে; যার ফলে অনেক শিল্পোদ্যোক্তাই ব্যাংক ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছেন। অনেকে কারখানা টিকিয়ে রেখেছেন কোনোরকমে। এ খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, স্বল্পমেয়াদি ঋণ দীর্ঘমেয়াদি ঋণে রূপান্তর করা জরুরি হয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে কোম্পানির ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে ঋণপত্রের সুবিধা ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি করার পাশাপাশি এ শিল্পের সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকারি নীতিসহায়তা উচিত বলে তারা মনে করেন।

আরবি/জেডআর

Link copied!