হাজারীবাগ, ধানমন্ডি ও নিউমার্কেট এলাকায় আধিপত্য বিস্তার থেকে শুরু করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে ছিলেন ঢাকা-১০ আসনের সাবেক এমপি ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন। তাকে ধরার পর গোয়েন্দা পুলিশ এসব তথ্য জানায়।
পুলিশ বলছে, এমপি মহিউদ্দিন ৫ আগস্টে ছাত্র হত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এই আন্দোলনের সময় তিনি বিভিন্ন তথ্য দক্ষিণ সিটির সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসকে দিতেন এবং তার কথামতো ছাত্র আন্দোলনের সময় গুম, খুন ও হত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত। অভিযোগ আছে, তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর ভাড়াটে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের দিয়ে হাজারীবাগ, ধানমন্ডি ও নিউমার্কেটসহ বেশকিছু এলাকায় গুলি চালান। তা ছাড়া দীর্ঘদিন শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন দখল করে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করে দেশ-বিদেশে পাচার করেছেন। সম্প্রতি তিনি গ্রেপ্তারের পর সরকারি বিভিন্ন সংস্থা তার দুর্নীতির আমলনামা নিয়ে কাজ শুরু করে। ইতিমধ্যে তারা বেশকিছু তথ্য-প্রমাণও পেয়েছেন।
গতকাল বুধবার সকালে রাজধানীর উত্তরার ১৩ নম্বর রোডের ৪নং সেক্টর থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এই বিষয়ে উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি মো. হাফিজুর রহমান জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে আমরা জানতে পারি, তিনি উত্তরার একটি বাসায় আত্মগোপনে থেকে দেশদ্রোহী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এরপর তার অবস্থান জেনে উত্তরা পশ্চিম থানা-পুলিশ ওই বাসায় অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করে।
জানা যায়, শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন ২০২০ সালে ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। মূলত তিনি আওয়ামী লীগপন্থি একজন ব্যবসায়ী নেতা এবং এফবিসিসিআই ও বিজিএমইর সাবেক সভাপতি হওয়ায় দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন।
বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন এবং বিজিএমইএ (বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি) সূত্র জানায়, সম্প্রতি দেশের পোশাকশিল্পে অস্থিরতার পেছনের চাবিকাঠি নেড়েছেন ফ্যাসিবাদের দোসর এই মহিউদ্দিন। তা ছাড়া, বিগত সরকারের সময় দেশের পোশাকশিল্পে চলমান অস্থিরতা ও শ্রমিক অসন্তোষের পেছনেও ছিলেন তিনি।
পোশাকশিল্প দেশের রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে বড় ও একক খাত। এই খাত ধ্বংসের পেছনে ফ্যাসিবাদের দোসর মহিউদ্দিনের নাম বারবার উঠে আসছে। আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকারের গত ১৬ বছর বিজিএমইএ-তে ভোটবিহীন আওয়ামী নেতাদের পুনর্বাসন ও লুটপাটের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা হয়; আর এ সবের পেছনে ছিলেন সাবেক এই এমপি।
সূত্র জানায়, এমপি মহিউদ্দিন মূলত আওয়ামী লীগ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণপন্থি একজন ব্যবসায়ী নেতা। তিনি এফবিসিসিআই ও বিজিএমইর সাবেক সভাপতি হওয়ার সুবাদে আওয়ামী লীগের অনেক এমপি-মন্ত্রীদের ডোনার ছিলেন।
অভিযোগ আছে, শুধু এমপির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি বিগত ১৬ বছর শেখ ফজলে নূর তাপস ও শেখ ফজলে শামস পরশের ছত্রছায়াই বেপরোয়া ছিলেন। কাউকে মানতেন না। ঠিক এই সময়টাতে টাকার কুমির হয়েছিলেন এমপি মহিউদ্দিন।
হাজারীবাগ, ধানমন্ডি ও নিউমার্কেটের সবকিছু ছিল তার দখলে। তা ছাড়া প্রতিটা সেক্টর থেকে মহিউদ্দিনকে দিতে হতো টাকা। এমনকি পুলিশ কর্মকর্তাদেরও ছাড়েননি তিনি। নিজ এলাকায় ওসিদের বহাল রাখতে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, মহিউদ্দিন দেশেই আত্মগোপনে থেকে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র করত। তা ছাড়া সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র ছিল তার মূল টার্গেট। বিষয়টি গোয়েন্দারের নজরে আসলে পুলিশ সতর্ক হয় এবং গোপন তথ্যের ভিত্তিতে তাকে গ্রেপ্তার করে।
এ বিষয়ে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এর আগেও নানা অপকর্মের কারণে সাবেক এমপি মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের অভিযোগ পড়ে। ফ্যাসিবাদের দোসর হওয়ায় কিছুই হয়নি মহিউদ্দিনের। এ ছাড়া মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগও কম না। ফ্যাসিবাদের আমলে দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা পাচার করেছে এবং লুটপাট করেছে। এসব অভিযোগের সবকিছু আমলে নিয়ে পুলিশ তদন্ত করছে বলে সূত্র জানায়।
জানতে চাইলে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স) ইনামুল হক সাগর রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘দেশদ্রোহী ও সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র যারাই করবে পুলিশ সেসব ষড়যন্ত্রকারীকে প্রতিরোধ করবে এবং আইনের আওতায় আনবে।
এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা (ওসি) মো. মহিববুল্লাহ জানান, ‘৫ আগস্টে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ও হত্যা মামলায় এমপি মহিউদ্দিনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে সব অপরাধের তদন্ত চলছে। বেশকিছু তথ্য পাওয়া গেছে। সেগুলো নিয়ে পুলিশ কাজ করছে। তা ছাড়া তাকে দিনব্যাপী জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে এবং আগামীকাল আদালতে নিয়ে রিমান্ড চাওয়া হবে।’
আপনার মতামত লিখুন :