বিশ্ব অর্থনীতি নানামুখী টানাপোড়েন আর অনিশ্চয়তায় ভরা। তবুও নতুন করে অর্থায়ন এবং দেশ থেকে পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে নিতে বিশেষ সহযোগিতার আশ্বাস পেয়েছে বাংলাদেশ। ভেঙে পড়া আর্থিক খাত চাঙ্গা করতে, সংস্কার ও কারিগরি পরামর্শের বিষয়েও সম্মত হয়েছে উন্নয়ন অংশীদার প্রতিষ্ঠানগুলো।
তবে এবারে বাংলাদেশ বিশেষভাবে গুরুত্ব পায় আইএমএফ বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভায়। শনিবার শেষ হয়েছে বিশ্বের উন্নয়ন অংশীদার প্রতিষ্ঠানগুলোর বার্ষিক সভা। নোবেল জয়ী ড. ইউনূসের উপস্থিতিতে সভায় ভিন্ন সেশনে পরিবেশ, জলবায়ু, সন্ত্রাসী অর্থায়ন, পাচার ও বৈষম্যসহ অসংখ্য বিষয় আলোচিত হয়।
সভার দ্বিতীয় দিন যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় গত মঙ্গলবার বিশ্ব অর্থনীতির ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি নিয়ে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক রিপোর্ট প্রকাশ করে আইএমএফ। যাতে সংস্থাটি বলেছে, এ বছর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হতে পারে সাড়ে ৪ শতাংশ। তবে, পরিবর্তিত প্রেক্ষাপট ও নতুন এক বাস্তবতায়, বাংলাদেশের জন্য এবারের সভা অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যা ধারাবাহিক বৈঠকে তুলেও ধরছেন অর্থ উপদেষ্টার নেতৃত্বে কয়েক সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের কমিটি।
গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্টে বলা হয়, এখনো বহু দেশে অনিশ্চয়তা রয়েছে মুদ্রা ব্যবস্থাপনা ও চড়া সুদহার নিয়ে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। বাংলাদেশকে এ খাতে স্থিতিশীলতা ফেরাতে সহায়তা দেবে আইএমএফ। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের উন্নতির ধারাবাহিকতার স্বীকৃতি পেল আরও একবার বিশ্বমঞ্চে।
যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বব্যাংক গ্রুপের বৈঠকে আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা সামষ্টিক অর্থনীতি ও মানব সম্পদ উন্নয়নে বাংলাদেশের প্রশংসা করেন। নতুন অর্থায়ন ছাড়াও, দেশ থেকে পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে নিতে বিশেষ সহযোগিতার কথা বৈঠকে তুলে ধরে বাংলাদেশ। ভেঙে পড়া আর্থিক খাত সংস্কার করে উন্নয়ন ও কারিগরি পরামর্শের বিষয়টিও তুলে ধরা হলে দুই ঋণদাতা সংস্থা প্রদানে সম্মত হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবির কাছ থেকে ব্যাংকিং এবং অন্যান্য খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য সংস্কার কার্যক্রমের জন্য আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৪ বিলিয়ন থেকে ৫ বিলিয়ন বা ৫০০ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তা আসতে পারে। ঋণদাতারা এ জন্য বেশ কয়েকটি শর্ত আরোপ করতে পারে। এর মধ্যে থাকতে পারে রাজস্ব, সরকারি ব্যয় এবং তথ্য সংক্রান্ত কিছু বিষয়।
এ ছাড়া গত বছরের জানুয়ারিতে অনুমোদন হওয়া ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ছাড়াও আইএমএফের একটি পৃথক কর্মসূচির আওতায় ৩ বিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন হতে পারে। আগের অনুমোদন হওয়া ঋণ মোট সাত কিস্তিতে আগামী ২০২৬ সাল পর্যন্ত দেওয়ার কথা রয়েছে। এরই মধ্যে তিন কিস্তির ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ।
নতুন ঋণ কী শর্তে কত কিস্তিতে দেওয়া হবে, সে রূপরেখা বার্ষিক সভার ফাঁকে বৈঠকে চূড়ান্ত হবে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংক চলতি অর্থবছরে নতুন করে দেড় থেকে দুই বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দেবে বলে আশা করছে সরকার। এর মধ্যে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে এক বিলিয়ন পাওয়ার কথা রয়েছে।
বিশ্বব্যাংক অর্থনৈতিক সুশাসন ও সংস্কার কর্মসূচি জোরদার করতে ৭৫-১০০ কোটি ডলার দেবে। আরও ২৫ কোটি ডলার অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য দেওয়া হবে। এডিবি থেকে সরকার চলতি অর্থবছরের শেষ নাগাদ ১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার আশা করছে।
অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এবং সুশাসন জোরদার করার জন্য একটি কর্মসূচির জন্য ডিসেম্বরের মধ্যে ৬৫ কোটি ডলার পাওয়া যাবে। অন্তর্র্বতী সরকার ব্যাংকিং খাতের জন্য এডিবির কাছে ১ বিলিয়ন ডলার এবং জ্বালানি খাতে আরও ১ বিলিয়ন ডলার চেয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংকিং খাতে ১ বিলিয়ন ডলার পাওয়ার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। বিগত সরকারের সময় বিদেশে পাচার করা টাকা দেশে ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও উন্নয়ন সহযোগীর সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ। সভার শেষদিন গতকাল শনিবার যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে বিভিন্ন সংস্থা ও উন্নয়ন সহযোগীর সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল। বৈঠকে পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশ ও সংস্থাগুলোর সহযোগিতা চাওয়া হয়।
সূত্র জানায়, পাচার করা টাকা দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশের এখন জরুরি প্রয়োজন কারিগরি ও আইনগত সহায়তা। এজন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা চাওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে কোনো দেশে পাচার হওয়া টাকা কীভাবে ফেরাতে হবে, কাদের কাছে করতে হবে, এ বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষ কারা-এসব তথ্য জানতে ইতোমধ্যে বিএফআইইউ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হবে। পাশাপাশি এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা পেলে দ্রুত পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। বৈঠকে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিনিধি এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ থেকে পাচারের অর্থ ফেরাতে কারিগরি ও নীতিগত সার্বিক সহায়তা দেওয়ার ইতিবাচক আশ্বাস পুনর্ব্যক্ত করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংক। সেই সাথে, আর্থিক খাতে সংস্কার ও ঋণ সহায়তা নিয়েও পাওয়া গেছে ব্যাপক সাড়া। বিশ্বব্যাংক সদর দপ্তরে ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, ব্যাংক থেকে ঠিক কী পরিমাণ অর্থ লোপাট হয়েছে, শিগগির তার হিসাব জানা যাবে।
বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বার্ষিক সভায় অংশগ্রহণ করে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রায় ৫০০ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তা পাওয়ার ব্যাপারে সর্বোচ্চ জোর দিচ্ছেন। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে এই সহায়তা পাওয়ার জন্য অর্থমন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ থেকে ৩ বিলিয়ন ডলার এবং বিশ্বব্যাংক থেকে দেড় থেকে দুই বিলিয়ন ডলার আসতে পারে।
জানা গেছে, বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বার্ষিক সভায় অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে আরও অংশগ্রহণ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর, অর্থসচিব, অর্থমন্ত্রণালয় ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। প্রতিনিধি দলটি নতুন অর্থায়ন পদ্ধতি এবং সংস্কারের শর্ত নিয়ে আলোচনা করতে মূল অনুষ্ঠানের ফাঁকে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বসে।
ইতোমধ্যে অন্তর্র্বতী সরকারের সংস্কার কার্যক্রমকে সমর্থন জানিয়ে প্রয়োজনীয় তহবিল সরবরাহের আশ্বাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ।
আপনার মতামত লিখুন :