ঢাকা শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

স্বস্তি নেই নিত্যপণ্যে, সিন্ডিকেট কি এখনো বহাল!

এফ এ শাহেদ

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৬, ২০২৪, ০৩:০৭ পিএম

স্বস্তি নেই নিত্যপণ্যে, সিন্ডিকেট কি এখনো বহাল!

ছবি: রুপালী বাংলাদেশ

বিগত ১৫ বছর স্বৈরাচারী শাসকের সময় অসাধু সিন্ডিকেট এবং ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে বাড়তি দাম ছিল চাল, আলু, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ, ডিম, মাছ থেকে শুরু করে সকল পণ্যে  । অভিযোগ ছিল, দেশে গড়ে উঠছে পণ্যভিত্তিক অসাধু ব্যবসায়ীদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট। সাধারণ ভোক্তারা ওই চক্রের কাছে জিম্মি হয়ে ছিল। যে কারণে প্রতিনিয়ত বেড়েছিল নিত্যপণ্যের দাম।

গত ৫ আগস্ট গণআন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাঁচই অগাস্টের ওই ঘটনার তিনদিন পর শপথ গ্রহণের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণ করে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার। আন্দোলনের সময় বেশকিছু পণ্যের দাম বেড়েছিল। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য চাল। তবে, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর সাধারণ মানুষ আশার আলো দেখেছিল, বুক বেধেছিল নতুন স্বপ্নে। কিন্তু একমাস কেটে যাওয়ার পরও কমেনি নিত্যপণ্যের দাম বরং নতুন করে চালের দাম বাড়ার শঙ্কার কথা বলছেন ব্যবসায়ীরা।

প্রশ্ন উঠেছে জনমনে। তবে কি সিন্ডিকেট কি এখনো বহাল ? না কি বর্তমান সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে না নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে। সময় যাচ্ছে তবে স্বত্বি কি ফিরছে বাজারে। সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজির অতিরিক্ত খরচ গুনতে না হওয়ায় স্বস্তি ফিরে আশার সম্ভবনা ছিল সবজির বাজারে। নাগালের মধ্যেই পাওয়া যাওয়ার আশা ছিল সব ধরনের সবজি।

উল্লেখ্য, ১২ আগস্ট ছাত্রদের সরব উপস্থিতিতে রাজধানীর কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা যায়, ৩০ থেকে ৫০ টাকার মধ্যেই বেশির ভাগ সবজি বিক্রি হতে। সেসময় বিক্রেতারা জানিয়েছেন, আরো কমবে সবজির দর। তবে সময় যত গড়িয়েছে দাম কমেনি বেড়েছে ।

চালের দাম বাড়ার শঙ্কা
চাল প্রধান এই খাদ্যপণ্যটির চড়া দাম নিয়ে বিপাকে নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ। নতুন সরকার অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম কমাতে যেমন উদ্যোগ নিচ্ছে, চালের ক্ষেত্রেও তেমনটা প্রয়োজন বলে মনে করেন, সাধারণ মানুষ। তারা বাজারে গিয়ে চাল কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, পুরান ঢাকার নবাবগঞ্জ বাজার ঘুরে কথা হয় অনেক সাধারণ ক্রেতার সাথে । তন্ময় কুমার নামের একজন শিক্ষার্থী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন। আমরা ছাত্ররা যারা ঢাকাতে মেচে থেকে চাকরির জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করি। তারা বেশিরভাগই টিউশনি করে নিজেদের খরচ বহন করি। দেশে সরকার পরিবর্তনের যে আন্দোলন তার সাথে সরাসরি জড়িত ছিলাম এবং পরিবর্তনের পর ভেবেছিলেন, জনগণের এই সরকার দ্রুত সকল সিন্ডিকেট ভেঙে নিত্যপণ্যে সাধারণের নাগালের মধ্যে আনতে পারবে। তবে হতাশাজনক বিষয় হল, আমাদের যেটা মনে হচ্ছে একমাস পার হলেও সরকার হয়তো সমস্যা চিহ্নিত করতে ব্যর্থ অথবা সিন্ডিকেট এখনো বহাল। না হলে কৃষক যে দামে পণ্যে বিক্রি করছে তা ঢাকাতে আসতে আসেত ৪ থেকে ৫ গুন হয় কিভাবে। এর দ্রুত সমাধান প্রয়োজন।

বাজার ঘুরে দেখাযায়, দাম বেড়েছে চাল, ডিম ও সবজির দাম। দফায় দফায় বাজার মনিটরিং হলেও বাজারে কোনো প্রভাব পড়ছে না। মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা এবং চিকন চাল ৭০ থেকে ৭৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে।  দেশি ডাল বিক্রি হচ্ছে সর্বনিু মূল্য কেজিপ্রতি ১৩০ টাকায়। মোট ডাল বিক্রি হচ্ছে কেজি প্রতি ১০০ টাকায়।

ক্রেতারা বলছেন, আবারও দাম বাড়তে শুরু করেছে। যদিও এটাকে পণ্যে সংকটের ফলে স্বাভাবিক বৃদ্ধি বলে দাবি করছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। তবে বাজারে কোন পণ্যের যোগান কম দেখা যায়নি।

আব্দুর বশির মিয়া নামের একজন রিক্সাচালক বলেন, ’নতুর সরকার নতুন দ্যাশ, ভেবেছিলাম চোর বাটপাড় সব শ্যাষ। তয়, কিছুই বুঝতাছি না চালের দাম বাড়ছে। নুন-ত্যাল কিছুর দামই কমেনি। কেমতে কি মিয়া-বাই? খাওয়নের টেকা জোগাইতেই জান শ্যাষ । আমাগের আগের টা পরের টা সবাই হমান-হমান। দাম কুমলে আরাম লাগে। গ্রামে আমার বাপে খ্যাত খামারি করে মালের বেচতে গেলে টেকা নেয় । আর অহন ঢাহা-শহরে কিনতে পারিনে আমাগো পকেটে টেকা নেয় ।    

চাল বিক্রেতা আনসার মিয়া বলেন, চালের দাম বাড়তি বন্যার কারনে চালের দাম বাড়ার আভস পাচ্ছি। তবে আমরা যদি কম দামে কিনতে পারি কম দামে বেচতে পারবো। না হলে আমাদের কিছু তো করার নাই।

শাহ আলম নামের একজন ক্রেতা বলেন, গরুর গোস্তের দাম কমবে ভাবছিলাম নতুন সরকারের আমলে । কারণ এক খলিল সিন্ডিকেট ভেঙে গরুর গোস্ত ৫৮০ টাকা থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি করছে । আমার প্রশ্ন আপনাদের কাছে এখন তো সিন্ডিকেট নায় তবে কেন গোস্তের দাম কমবে না?

নিত্যপণ্যের দাম
পুরান ঢাকার নবাবগঞ্জ, ছাপড়া মসজিদ, লালবাগ সহ অন্তত ৬টি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সবকয়টিতেই ৭৫০ টাকা থেকে ৭৮০ টাকা কেজি দরে গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে। ।  ব্রয়লারের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৭০ থেকে ১৯০ টাকা। পাশাপাশি সোনালি মুরগি কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ২৭০ টাকা দরে। এছাড়া ডিমের ডজন বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায়।

স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত মাছের দামও কমেনি। রুই মাছ বিক্রি হচ্ছে ৩৫০-৪০০ টাকা কেজি। কাতল ৩০০-৪০০, ভেটকি ৭০০-১০০০ টাকা।  পাঙাশ বিক্রি হচ্ছে ১৮০-২২০ টাকা কেজি দরে, তেলাপিয়া প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৫০-২০০ টাকা করে।

প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়। এছাড়া দেশি পেঁয়াজ ১১০ থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।

মাছ কিনতে আসা রবিন বলেন, আমরা ঢাকার মেচে থাকি। আমাদের আমিষের ঘাটতি পুরণের জন্য পাঙাশ মাছই শুধু কিনতে পারি। তবে, সব কিছুর দাম যেমন কমেনি একইভাবে পাঙাশের দামও কমেনি মাঝে মাঝে বাড়তিও দেখি। দেশিয় উৎপাদিত মাছের দাম কেন বাড়ে আমাদের জানা নেই। তবে এভাবে চলতে থাকলে, আমাদের মতো মেচে থাক শিক্ষার্থীদের কপালে আর আমিষ জুটবে না।

নিত্যপণ্যের দাম কেন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না এ বিষয় জানতে ’কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)’ ওয়েবসাইটে দেওয়া নাম্বারে কল করা হলে তা রিসিভ হয়নি।

গরুর মাংসের দাম এখনো কেন চড়া এ বিষয়ে মতামত নিতে মাংসবিক্রেতা খলিলকে কল করা হলে নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া যায়।

নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে রূপালী বাংলাদেশকে মতামত জানান গণঅধিকার পরিষদের যুগ্ম সদস্য সচিব মো. তারেক রহমান। তিনি বাজার নিয়ন্ত্রণে না আসার বিভিন্ন কারণের মধ্যে ভোক্তা অধিকারের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ।

তিনি বলেন, ‘ভোক্তা অধিকার এখন একটি ব্লগিং সেল হিসাবে নিজেদের পরিচয় দিচ্ছে। তাদের কাজ বাজারের আসল সমস্যা খুজে বের করা এবং তার যৌক্তিক সমাধানের চেষ্টা করা। তারা সেটা না করে ব্যবসায়ীদের ভোগান্তি বাড়ানো ছাড়া আসল জায়গাতে কখনো হাত দেয়নি। তাদের ব্লগিং ছেড়ে ভোক্তার অধিকার আদায়ে  কাজ করতে হবে।

প্রান্তিক কৃষক এবং বাজারে সবজির দামের বিশাল পার্থক্যের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘উত্তর বঙ্গে যে ধনিয়া পাতা কৃষক ৫ টাকায় বিক্রি করে তা ঢাকা আনতে রাস্তায় চাঁদা দিতে হয়। পরিবহনের জন্য ফ্রিজিং ব্যবস্থা করতে হয়, পরিবহনে দির্ঘ সময়ের ফলে পণ্য পচন ধরে।  এতে পণ্যোর দাম ভেক্তার কাছে পৌঁছানোর আগে এমনিতেই বেড়ে যায়। সেক্ষেত্রে উত্তর বঙ্গ, দক্ষিণ বঙ্গ সহ যে সকল স্থানে ট্রেন ব্যবস্থা আছে সেখানে খাদ্য পণ্য আনায়নের জন্য স্পেশাল কিছু বগি যুক্ত করে সমস্যা সমাধান করা যায়।

দেশের আর্থিক খাতে দীর্ঘদিন ধরেই শৃঙ্খলা অনুপস্থিত। গত দেড় দশক সুশাসনের অভাবে বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে বিভিন্ন দুষ্টচক্রের উত্থান ঘটেছে। নিত্যপণ্যের বাজার সাধারণ মানুষদের নাগালের বাইরে। একই সাথে প্রান্তিক কৃষক পণ্যের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত। এদিকে ব্যাংকগুলোর অবস্থাও নাজুক। ব্যাপক গণআন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হলে বাজারে স্বস্তি ফিরবে এমন আশা জন সাধারণের।

আরবি/এস

Link copied!