ঢাকা শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

আইএফআইসি ব্যাংকে শীর্ষ পদে দুর্নীতি

শাহীনুর ইসলাম শানু

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৬, ২০২৪, ০৬:৩৭ পিএম

আইএফআইসি ব্যাংকে শীর্ষ পদে দুর্নীতি

ছবি: সংগৃহীত

বেসরকারি আইএফআইসি ব্যাংকের শীর্ষ পদেই ব্যাপক দুর্নীতি। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) পদে থেকেই ‘কৌশলগত উপদেষ্টা’ হয়েছেন শাহ আলম সারওয়ার। সাবেক গভর্ণরের বিশেষ ভুমিকায় এমডির সব সুবিধা গ্রহণসহ বেতন নিতেন তিনগুণ। যার শুরু হয়েছিল সাবেক গভর্ণরের হাতে এবং প্ররোচনায় ছিলেন ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান।

বাংরাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুসারে, কোনো ব্যাংকের এমডি বা পরের দুই পদ পর্যন্ত কর্মকর্তারা অবসরের পাঁচ বছর পার না হওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে উপদেষ্টা বা পরামর্শক হতে পারবেন না। তবে তিনি পেরেছিলেন।

একইসঙ্গে ব্যাংকের বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) ঘিরেও ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানকে ঘিরে রয়েছে ব্যাপক সমালোচনা। এজিএমে ‘এজেন্ডা উত্থাপন’ -এর আগেই অর্থাৎ তিন মিনিটেই সব ‘এজেন্ডা পাশ’ করে রাইট শেয়ার অনুমোদসহ বিভিন্ন বিতর্কে জড়ান চেয়ারম্যান। তিনি দেশের শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্থ, পুঁজিবাজার লুণ্ঠনকারী এবং ঋণ খেলাপিরজনক হিসেবে অনেকেই তাকে অভিহিত করেন। অন্যদিকে বে´িমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান তিনি।

চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান বাদ
২০০৯ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান আইএফআইসি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেন। এরপরে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। আওয়ামী সরকারের পতনের পর ব্যাপক আলোচনায় আসে আইএফআইসি ব্যাংক। পুঁজিবাজার লুণ্ঠনকারী এফ রহমান চেয়ারম্যান এবং ছেলে আইএফআইসি ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ শায়ান ফজলুর রহমান। দলীয় প্রভাবে এসেস ফ্যাশন লিমিটেডের নামে জনতা ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করেন। পরে সেই ঋণ খেলাপির দায়ে ব্যাংকের পরিচালক পদ থেকে বাদ পড়েন শায়ান। সরকার পতনের আগে বাবাÑছেলে মিলে চালাতেন বেসরকারি ব্যাংকটি। একইদিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ১৩ আগস্ট আটক হন দুর্নীতিবাজ বাবা এফ রহমানও।

ইতোমধ্যে সালমান পরিবারের রাহুমুক্ত হয়েছে আইএফআইসি ব্যাংক। নানা কৌশলে তার পরিবার এই ব্যাংক থেকে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার নামে বেনামে ঋণ নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক গত মঙ্গলবার চেয়ারম্যান বাদ দিয়ে ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে দিয়েছে।

‘কৌশলগত উপদেষ্টা’ আলম সারওয়ার
বেসরকারি আইএফআইসি ব্যাংকের ‘কৌশলগত উপদেষ্টা’ পদে আলম সারওয়ারের প্রতি মাসে বেতন অনুমোদন করা হয়েছিল প্রায় ১৫ লাখ টাকা। যা অন্যকোন ব্যাংকের এমডি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ পদে থাকা ব্যক্তিদের বেতনের কয়েকগুণ বেশি। এদিকে, ‘কৌশলগত উপদেষ্টা’ হওয়ায় এমডি থাকার সময় যে সুবিধা পেয়েছিলেন, তাও বহাল থাকবে। সরকার পতনের পরে  সম্প্রতি তার এই নিয়োগ বাতিল করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আওয়ামী সরকার পতনের পর তিনি আর অফিসে আসেননি।

শাহ আলম সারওয়ার ২০১২ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ১৩ মে পর্যন্ত আইএফআইসি ব্যাংকের এমডি ছিলেন। ব্যাংকের এমডির মেয়াদ শেষ হয় ১৩ মে এবং তার দুদিন আগেই ১১ মে তিনি একই ব্যাংকের উপদেষ্টা পদে নিয়োগ পান। এরপরে ২৬ মে থেকে ব্যাংকটির ‘কৌশলগত উপদেষ্টা’ হিসেবে যোগ দিয়ে আগের মতো একই কক্ষে বসে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

তবে আওয়ামী সরকার পরিবর্তনের পর তিনি আর অফিসে আসেননি। তবে একই দিন অর্থাৎ ১৩ মে বেসরকারি আইএফআইসি ব্যাংকের নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন সৈয়দ মনসুর মোস্তফা। ২০১৫ সালে সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে আইএফআইসি ব্যাংকে যোগদান করেন তিনি।

দেশে-বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংকে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকায় শাহ আলম সারওয়ারকে ২০০৫ সালে আইপিডিসি ফাইন্যান্স কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে নিয়োগ দেয়। এরপর ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক ও ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। পাশাপাশি তিনি ২০১১-২০ সাল পর্যন্ত সরকার মনোনীত প্রতিনিধি হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালকও ছিলেন।

অনিয়মের শুরু ও শেষ
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০২১ সালে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, কোনো ব্যাংকের এমডি বা পরের দুই পদ পর্যন্ত কর্মকর্তারা অবসরের পাঁচ বছর পার না হওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে উপদেষ্টা বা পরামর্শক হতে পারবেন না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বিশেষ ক্ষমতাবলে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে ব্যাংকটির উপদেষ্টা পদে তাকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। নিয়ম হলো কোনো ব্যাংকের এমডি অবসরে যাওয়ার ৫ বছর পর্ণ হতে হবে। তার আগে তিনি একই ব্যাংকের উপদেষ্টা হতে পারবেন না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, সাবেক গভর্নরের বিশেষ বিবচেনায় ব্যাংকের নিয়ম ভেঙে শাহ আলমকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এমনকি ব্যাংক খাতে উপদেষ্টাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেতন পেতেন তিনি। যেখানে উপদেষ্টাদের বেতনের কাঠামো সাড়ে পাঁচ লাখ টাকার মত, সেখানে তাকে দেওয়া হত এর কয়েকগুণ।

তবে এসব অভিযোগে বিসয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার এ প্রতিবেদক তার মোবাইলে ফোন দিলে বন্ধ পাওয়ার যায়। হোয়্যাটসঅ্যাপে যোগাযোগ করা হলেও কোন উত্তর মেলেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেক কর্মকর্তা বলেন, গত জানুয়ারিতে ন্যাশনাল ব্যাংক তাদের অবসরে যাওয়া এমডি মেহমুদ হোসেনকে তাদের ব্যাংকেরই উপদেষ্টা পদে নিয়োগের জন্য আবেদন করে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক সেই আবেদন অনুমোদন করেনি। তবে প্রভাবশালীদের চাপে ঠিকই শাহ আলমের নিয়োগ অনুমোদন করে। বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমানের বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সেগুলোতে তাকে তিন দফায় রিমান্ডেও নেওয়া হয়েছে।

২০০৯ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান আইএফআইসি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেন। ২০১০ সালে তিনি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হন। তখন তার হাতে ছিল ব্যাংকের ৩০ শতাংশ শেয়ার।

আরবি/জেডআর

Link copied!