ঢাকা বুধবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫

বাংলাদেশে বিনিয়োগের সুবিধা ও ঝুঁকি কতটা, আইন যা বলছে

রূপালী প্রতিবেদক

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৪, ২০২৫, ১১:১০ পিএম

বাংলাদেশে বিনিয়োগের সুবিধা ও ঝুঁকি কতটা, আইন যা বলছে

ফাইল ছবি

বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। বর্তমান দেশের অর্থনীতির আকার এক হাজার বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি, যার গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ আসে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (Foreign direct investment) বা এফডিআই থেকে।

বাংলাদেশ বর্তমানে দেশি বা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে উঠেছে। এর কৌশলগত অবস্থান, ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি এবং সরকারের প্রণোদনা বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করছে।

বিনিয়োগ

সাধারণত ভবিষ্যতে মূল্য বৃদ্ধি পাবে এমন আশায় নিজ অর্থ কোনো কিছুতে খাটানোকে বিনিয়োগ বলে। বিনিয়োগ হচ্ছে, সম্পদ সুরক্ষিত ও বৃদ্ধি করার কৌশল।

বিনিয়োগকে অধিক রাজস্ব উৎপন্ন করার একটি প্রক্রিয়া হিসেবেও দেখা যায়। তবে প্রক্রিয়াটি হতে হবে দেশি-বিদেশি কোনো সংস্থা বা সরকারের মালিকানায়। বিনিয়োগের একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো- এটি আর্থিক সংস্থাগুলোকে অধিক উৎপাদনশীল ব্যবহারের জন্য সম্পদ পুনঃবন্টনকে সহজ করে।

সাধারণত একটি দেশে নিজ দেশের পাশাপাশি বিদেশিরাও বিনিয়োগ করে থাকে একারণে বিদেশ থেকে ব্যক্তি পর্যায়ে, প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে, বহুজাতিক কোম্পানি রুপে ও সরাসরি বিদেশি সরকার ও তাদের এজেন্ট কর্তৃক কোন দেশে বিনিয়োগ কার্যক্রম পরিচালিত হলে তাকে বৈদেশিক বিনিয়োগ বলে।

বাংলাদেশে বিনিয়োগ রিপোর্ট

বিনিয়োগকারী বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর (সংস্থা) বাংলাদেশে নিয়ে আসা বিনিয়োগ বা অর্থ সংক্রান্ত জরিপ প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সর্বশেষ এই জরিপের রিপোর্ট প্রকাশ হয় ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের শুরুতে।

রিপোর্টে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে নিট এফডিআই প্রবাহ ছিলো ৩২৪ কোটি ৯৬ লাখ ৮০ হাজার ডলার। অথচ আগের বছর অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থ বছরে এই পরিমাণ ছিলো ৩৪৩ কোটি ৯৬ লাখ ৩০ হাজার ডলার। হিসাব বলছে, গত বছরের ব্যবধানে নিট এফডিআই প্রবাহ কমেছে ৫.৫২ শতাংশ।

নিট প্রবাহের এই চিত্রের বিপরীতে বিদেশি নতুন বিনিয়োগকারীরা এই অর্থ বছরে নতুন মূলধন এনেছে অনেক কম। ২০২১-২২ অর্থ বছরে নতুন মূলধন বিনিয়োগের পরিমাণ ১৩৪ কোটি ৬৯ লাখ টাকা হলেও গত অর্থ বছরে তা কমে দাড়ায় ৭৯ কোটি ৫৯ লাখ ডলারে। এ হিসেবে নতুন বিদেশি মূলধনি বিনিয়োগ কমেছে ৪০ দশমিক ৯১ শতাংশ।

বিশ্ব অর্থনীতি ও বাণিজ্যের গবেষণা প্রতিষ্ঠান আঙ্কটাডের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ২০১৪ সালে এফডিআইয়ের প্রবাহ ছিলো ২৫৬ কোটি ডলার, ২০১৫ সালে ২২৩ কোটি, ২০১৬ সালে ২৩৩ কোটি, ২০১৭ সালে ২১৫ কোটি, ২০১৮ সালে ৩৬১ কোটি, ২০১৯ সালে ২৮৭ কোটি, ২০২০ সালে ২৫৬ কোটি, ২০২১ সালে ২৮৯ কোটি। আবার ২০২২ সালে রেকর্ড ৩৪৮ কোটি ডলার আসলেও ২০২৩-এ এসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩২৪ কোটি ৯৬ লাখ ডলারে।

এদিকে, ইউএনসিটিএডি‍‍`র ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট ২০২৩ অনুসারে- দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়া সত্ত্বেও মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) শতাংশ হিসাবে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের দিক থেকে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ চতুর্থ।

২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে বার্ষিক গড় এফডিআই এসেছে ২৯২ কোটি ডলার।

২০২২ সালে মালদ্বীপ সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছে ৭২ কোটি ২০ লাখ ডলার। এটি দেশটির জিডিপির প্রায় ১১ দশমিক ৭০ শতাংশ। একই সময়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে পড়া শ্রীলঙ্কা পেয়েছে ৮৯ কোটি ৮০ লাখ ডলার। এটি দেশটির জিডিপির এক দশমিক ২০ শতাংশ।

ডলারের হিসাবে বাংলাদেশ এই দুই প্রতিবেশীর তুলনায় বেশি-বিদেশি বিনিয়োগ পেলেও জিডিপির শতাংশ হিসাবে উভয় দেশই বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে গেছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের এফডিআই জিডিপির শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ।

বাংলাদেশে বিনিয়োগের খাত

বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য ৭টি খাতে উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখছে বিশ্বব্যাংকের সহযোগী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি)। খাতগুলো হলো- পরিবহন ও লজিস্টিকস, জ্বালানি, আর্থিক সেবা, হালকা প্রকৌশল, কৃষি বাণিজ্য, স্বাস্থ্যসেবা এবং ওষুধ।

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) বলছে, বিনিয়োগের জন্য সম্ভাবনাময় ১১টি খাত চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- অবকাঠামো, পুঁজিবাজার ও ফাইন্যান্সিয়াল সেবা, তথ্য-প্রযুক্তি, ইলেক্ট্রনিকস উৎপাদন, চামড়া, স্বয়ংক্রিয় ও হালকা প্রকৌশল, কৃষিপণ্য ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, স্বাস্থ্যসেবা ও ঔষধ, পাট-বস্ত্র, এবং ব্লু-ইকোনমি।

অন্যদিকে, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের জন্য ২০২৩ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত‌ ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ করছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশে বিনিয়োগের সুবিধা

অর্থনীতির বিবেচনায় সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ। একদিকে জনশক্তির প্রচুর মানবসম্পদ অপরদিকে রয়েছে নিজস্ব বিশাল বাজার। এ ছাড়া বাংলাদেশ থেকে ভারত, চীনসহ বিভিন্ন দেশে পণ্য রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। এসব বিবেচনায় বাংলাদেশে বিনিয়োগ অত্যন্ত লাভজনক। এখানে বিনিয়োগ করলে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত হবে। নিম্নে বাংলাদেশে বিনিয়োগের সম্ভাবনাগুলো তুলে ধরা হলো-

অবকাঠামোগত উন্নয়নঃ বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগকে উৎসাহীত করতে অবকাঠামোগত উন্নয়নের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। বর্তমান বাংলাদেশের অবকাঠামো আশানুরুপ নয় বলে বিদেশিরা সহজে এই গুরুত্বপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ করতে পারে। ইতি মধ্যে অনেক দেশে বাংলাদেশের অবকাঠামোখাতে বিনিয়োগ শুরু করে দিয়েছে যা বাংলাদেশের জন্য বিশাল সম্ভাবনা।

মানব সম্পদ উন্নয়নঃ বিশাল জনগোষ্ঠীর এই দেশে বেশীর ভাগ মানুষ বেকার। বিদেশিরা তাদের কল-কারকানায় সহজে কম মুল্য এই বেকার জনগোষ্ঠীকে প্রশিক্ষন দিয়ে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দিতে পারে ।

কারিগরি দক্ষতার উন্নয়নঃ বৈদেশিক বিনিয়োগের ফলে দেশের কারিগরি দক্ষতার উন্নয়ন ঘটে। বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ ক্ষেত্রে উন্নত প্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার দেয়। বাংলাদেশে প্রযুক্তিখাতে বিনিয়োগের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।

কর অবকাশ সুবিধা প্রদানঃ বিদেশিরা যাতে বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হয় এই উদ্দেশ্য বিভিন্ন কর অবকাশ সুবিধা দেয়া হচ্ছে। যার ফলে দেশি-বিদেশিরা বিনিয়োগে আশানুরুপ লাভোবান হচ্ছে।

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষাঃ বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অনেক কমে গেছে। বিশেষ করে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ফ্যাসিবাদি আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির পর দেশের রাজনীতিতে অনেকটাই শান্তির সু-বাতাস বইছে। যা বিনিয়োগের জন্য সম্ভাবনাময়।

কারিগরি দক্ষতার উন্নয়নঃ ইতোমধ্যে দেশি-বৈদেশি বিনিয়োগের ফলে দেশের কারিগরি দক্ষতার উন্নয়ন ঘটেছে। বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ ক্ষেত্রে উন্নত প্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার দেয়। বাংলাদেশে প্রযুক্তিখাতে বিনিয়োগের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।

সু-শাসন প্রতিষ্ঠাঃ বাংলাদেশ বর্তমানে একটি গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এখানে সকল মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করছে অন্তর্বর্তী সরকার। রাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র সকল ক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের যথেষ্ট মর্যাদা প্রদান করা হচ্ছে।

উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিঃ বৈদেশিক বিনিয়োগে মাধ্যমে নামী-দামি ও দক্ষতা সম্পন্ন দেশ বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে থাকে। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয় যা বিনিয়োগকে উৎসাহিত করে।

আমলাতন্ত্রিক জটিলতা হ্রাসঃ বৈদেশিক বিনিয়োগের ফলে বাংলাদেশে সরকারি রীতি-নীতি পরিবর্তন করা হয়েছে এবং সকল প্রকার হয়রানি প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে।

ভাবমূর্তি উন্নয়নঃ বাংলাদেশে উন্নয়ন-বান্ধব, বিনিয়োগ-বান্ধব পরিবেশ তৈরি হয়েছে এ কথা প্রমাণ করতে পারায় বিদেশিদের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে।

বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (SEZ): দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের জন্য ২০২৩ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত‌ বাংলাদেশ ১০০টিরও বেশি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ করছে। যা বিনিয়োগকারীদের বাড়তি সুবিধা দিবে।

বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের নিয়ম বা আইন

মূল আইন: ১৯৮০ সালের ‘Foreign Private Investment (Promotion and Protection) Act’ বৈদেশিক বিনিয়োগকে নিয়ন্ত্রণ করে।

সম্পত্তির অধিকার: বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের আইনের আওতায় তাদের বিনিয়োগ ও সম্পত্তির অধিকার ভোগ করতে পারবেন।

মুনাফা এবং আয় স্থানান্তর: বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা তাদের মুনাফা এবং লভ্যাংশ নির্দিষ্ট আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নিজ দেশে স্থানান্তর করতে পারেন।

কর সুবিধা: নির্দিষ্ট খাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কর ছাড় ও অন্যান্য কর সুবিধা পান, যেমন কর অবকাশ।

বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (SEZ): বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করার জন্য বাংলাদেশে বিভিন্ন বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল রয়েছে যেখানে বিনিয়োগকারীরা বিশেষ সুবিধা পান।

পূর্ণ মালিকানা: বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ১০০% মালিকানা পেতে পারেন, বিশেষ করে রপ্তানিমুখী শিল্প খাতে।

ন্যূনতম মূলধন: বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্য নির্দিষ্ট কোনো ন্যূনতম মূলধন নেই, তবে প্রকল্পের ধরনের ওপর নির্ভর করে মূলধন নির্ধারণ হয়।

উদ্যোগের স্বাধীনতা: বেশিরভাগ খাতেই বিদেশি বিনিয়োগকারীরা স্থানীয় অংশীদার ছাড়াই ব্যবসা শুরু করতে পারেন।

প্রণোদনা: রপ্তানিমুখী শিল্প, প্রযুক্তি এবং অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের জন্য বিভিন্ন প্রণোদনা দেওয়া হয়।

অবকাঠামো সুবিধা: বাংলাদেশ সরকার অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের জন্য সহায়ক নীতি গ্রহণ করেছে, যা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য সুবিধাজনক।

পরিবেশগত আইন: পরিবেশগত দিক থেকে দেশের কঠোর নিয়মাবলী মেনে বিনিয়োগ প্রকল্প পরিচালনা করতে হয়।

বাণিজ্যিক নিরাপত্তা: বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ঝুঁকির বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের আইনি সুরক্ষা রয়েছে, যেমন মুদ্রা পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সুরক্ষা।

বাংলাদেশের বিনিয়োগের ঝুঁকি

বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে যে পরিমাণ প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ হওয়া উচিত তা এখনও অর্জিত হয়নি। এ দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, কাঁচামাল, শ্রমের সহজলভ্যতা ও বৃহৎ ভোক্তাবাজার থাকা সত্ত্বেও কেন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগে ঝুঁকি রয়েছে।

ঝুঁকির কারণ কী? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে দেখা যাবে, এর পেছনে দেশ ও দেশের মানুষ, সার্বিক ব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিচারব্যবস্থা সমস্যার সমাধান এবং সর্বোপরি দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দায়ী। এইসব সার্বিক পরিস্থিতি বিদেশি বিনিয়োগ দূরে ঠেলে দিচ্ছে। নিম্নে বাংলাদেশে বিনিয়োগের কিছু ঝুঁকি তুলে ধরা হলো-

অর্থ পাচারঃ ওয়াশিনটন-ভিত্তিক সংস্থা জিএফআইয়ের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে পাচার হয় ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার। টাকার অঙ্কে তা প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা।

অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশ থেকে অর্থ পাচার হলে বাণিজ্য গতিশীলতা কমে। ঘাটতি কমাতে কখনও কখনও বাড়তি কর আদায় করতে হয়। অর্থ সংকটের কারণে সামগ্রিক অর্থনীতির আয়-ব্যয়ের এক ধরনের ভারসাম্য নষ্ট হয়।

সিপিডি-র সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দেখা যাচ্ছে তাদের টাকা পাঠাতে দেরি হচ্ছে। কারণ পাচার-সহ নানা কারণে ফরেন কারেন্সির রিজার্ভটা কমে যাচ্ছে। এটা এক ধরণের রং সিগন্যাল দিচ্ছে।

বিশ্ব ব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, দুর্নীতি ও সুশাসনের অভাবে আর্থিক খাত নিয়ে একটা দুশ্চিন্তা বরাবরই ছিলো। এটা আরও বেড়েছে।

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাঃ ২০২৩ সালের শেষে বিদেশি বিনিয়োগ কমার মূল কারণ হিসেবে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে চিহ্নিত করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, গত বছরের শেষ দিকে রাজনৈতিক দলের টানা আন্দোলন কর্মসূচি, সংঘাত সংঘর্ষের প্রভাব বিদেশি বিনিয়োগে পড়েছে।

অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বাংলাকে বলেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা একটা বড় বিষয় ছিলো। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অনেকে একটা দোটানায় ছিল ইলেকশন হবে কি হবে না। এ কারণে নতুন করে অনেকেই বিনিয়োগে আগ্রহী হননি।

অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতাঃ ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছিলো দেশের অর্থনীতি। কিন্তু গত দু’বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নানা সংকট দেখা যাচ্ছে।

অর্থনীতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ব্যাংকের সুদের হার বৃদ্ধি-সহ নানা কারণে বিনিয়োগকারীদের মাঝে নেতিকবাচক প্রভাব পড়ছে।

বিশ্ব ব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আর্থিক খাত নিয়ে একটা দুশ্চিন্তা বরাবরই ছিলো, সম্প্রতি এটা আরও বেড়েছে। ব্যাংকাররা অনেক সময় এলসি খুলে সময় মতো এলসি সেটল করতে পারেন নাই। আন্তর্জাতিক বাজারে সে খবরও পৌঁছেছে। এসব কারণে ধারণা তৈরি হয়েছে যে, তারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে লাভ হলেও সে টাকা তুলে আনতে পারবে না। এমন পরিস্থিতির কারণে তারা স্থিতিশীলতার অপেক্ষা করছে।

সিপিডি-র সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলছেন, ‘সামষ্টিক অর্থনীতিই যতক্ষণ পর্যন্ত না স্থিতিশীল হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি কমে না আসছে, ততক্ষণ পর্যন্ত বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা একটু অপেক্ষা করবে বলেই মনে হচ্ছে।’

সেবার মান ও জ্বালানি সংকটঃ বাংলাদেশে যে সব খাতে বৈদেশিক বিনিয়োগ আসছে তার মধ্যে অন্যতম হলো টেক্সটাইল, চামড়াজাত সামগ্রী, পাট, কৃষিভিত্তিক শিল্প ইত্যাদি। বিদেশিদের বিনিয়োগে আগ্রহী করতে বেশ কিছু বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু এ সব জায়গায় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ তৈরি করা যাচ্ছে না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির পর নিষ্কণ্টক জমি নিয়ে যে বাধা ছিলো সেটা কাটানো গেছে। কিন্তু ওয়ান স্টপ সার্ভিস, মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবারহ সেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এ কারণে প্রত্যাশিত বিনিয়োগ পাওয়া যাচ্ছে না।

এসব খাতে বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার পেছনে আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও কাজ করছে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, অর্থনীতির দিক থেকে ভারত, ভিয়েতনাম, চীন কিংবা বাংলাদেশের সমতুল্য দেশগুলোতে যে পরিমাণ এফডিআই আসে সে তুলনায় বাংলাদেশে এফডিআই খুবই নগণ্য।

ড. জাহিদ হোসেন বলেন, সরকার যদিও অনেক কাজ করার কথা বলেছে। জমির ঝামেলা মেটানো, গ্যাস বিদ্যুৎ পানি এইসব আমরা দিয়ে দিব এক জায়গায় - এ ধরনের অনেক কথাবার্তা হয়েছে। তবে বাস্তবে অনেক সুযোগই নিশ্চিত করা যায়নি।

সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘ সূত্রিতাঃ বিদেশি কোন সরকার বা কোম্পানির বিনিয়োগ প্রস্তাব বিবেচনা করতে দীর্ঘ সময় ক্ষেপণ করে, ফলে বিনিয়োগকারী বিরক্ত হয়ে অনেক সময় বাংলাদেশের পরিবর্তে অন্য কোন দেশে চলে যায়।

আমলাতান্ত্রিক জটিলতাঃ বাংলাদেশে নিবন্ধিত বিনিয়োগ প্রস্তাব বিবেচনার জন্য one steep সার্ভিস নেই। তাছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে অহেতুক দীর্ঘ সূত্রিতার কারনে বিদেশিরা বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখায় না।

অবকাঠামোগত সমস্যাঃ বাংলাদেশে বিদ্যুৎ, গ্যাস সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রেই অবকাঠামোগত সমস্যা রয়েছ। তাছাড়া যানজট, বন্ধরে জাহাজীকরনে প্রচুর সময় ক্ষেপণ ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় বিদেশিরা বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।

অদক্ষ শ্রমিকঃ অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী ও শিক্ষার নিম্নমানের কারনে বাংলাদেশে শ্রম শক্তি অদক্ষ থেকে যায়। এই অদক্ষ শ্রমিকের কারনেও বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে উৎসাহীত হয় না।

বাজারের সংকীর্ণতাঃ বাংলাদেশ প্রায় ২০ কোটি মানুষের দেশ হলেও, এদের বেশিরভাগের কোন ক্রয় ক্ষমতা নেই, ফলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা কম যা অনেক বিদেশি কোম্পানিকে শিল্প কল-কারখানা স্থাপনে নিরুৎসাহীত করে। যার ফলে বিনিয়োগ কম হয়।

শ্রমিক অসন্তোষঃ শ্রমিক অসন্তোষ বাংলাদেশে একটি নিত্য নৈমত্তিক সমস্যা। সামান্য বিষয়ে শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে আসে এবং ভাঙ্গচুর ও অগ্নি সংযোগ শুরু করে। ফলে বিদেশিরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে চায় না।

দুর্নীতি ও সুশাসনের অভাবঃ বাংলাদেশের সর্বত্র দুর্নীতি একটি ভয়াবহ সমস্যা। সরকারি পর্যায়ে কোন কাজ দুর্নীতি ছাড়া আশা করা যায় না। পাশাপাশি সু-শাসনের অভাব বাংলাদেশের আরও একটি বড় সমস্যা। ফলে বিদেশিরা বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।

আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিঃ বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোটেই সন্তোষজনক নয়। চাঁদাবাজি, চুরি, ডাকাতি, খুন রাহজানি এসব লেগেই আছে।অনেক সময় বিদেশিরা এসবের শিকার হয়। এতে বিদেশিরা বিনিয়োগে উৎসাহী হয় না।

বাংলাদেশের ভাবমূর্তিঃ রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক তথা সার্বিক বিবেচনায় বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল নয়। যে কারনে বাংলাদেশে বিদেশিরা বিনিয়োগে আগ্রহী হয় না।

বিদ্যমান সমস্যাগুলোর সমাধান হলে বাংলাদেশে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার মাধ্যমে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, স্বচ্ছ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য সঠিক নীতি ও কৌশল প্রয়োগ করে দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

আরবি/এইচএম

Link copied!