ঢাকা মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪

ক্যাম্পাসের প্রাণীদের নির্ভরতার ঠিকানা হাবিপ্রবির তিন তরুণ

হাবিপ্রবি প্রতিনিধি

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৬, ২০২৪, ০৩:৪৩ পিএম

ক্যাম্পাসের প্রাণীদের নির্ভরতার ঠিকানা হাবিপ্রবির তিন তরুণ

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

বিশ্ববিদ্যালয় শব্দটা শুনলেই মাথার মধ্যে ভেসে ওঠে একটা ক্যাম্পাস আর ব্যাগ ঘাড়ে কিছু ছাত্রছাত্রী। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়। তবে কখনও কখনও বন্ধুত্ব কিংবা প্রেম শুধু মানুষের সাথে মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনা। মানুষ ছাড়াও অনেকের বন্ধুত্ব হয় ক্যাম্পাসে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানো অবলা পশুপাখিদের সাথে। কখনও এই বন্ধুত্ব, বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছাপিয়ে হয়ে ওঠে নির্ভরতার পরম ঠিকানার নাম। ক্যাম্পাসের পশুপাখিদের জন্য এমনই বন্ধু হয়ে উঠেছেন দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) ভেটেরিনারি এন্ড এনিম্যাল সাইন্স অনুষদের তিন শিক্ষার্থী জোবায়ের আলম, রাকিবুল হাসান রাকিব এবং ইহসানুল হক খান শাওন। পশুপাখির প্রতি ভালোবাসা থেকেই ক্যাম্পাসে বিচরণ করা কুকুর বিড়ালকে খাবার খাওয়ান এই তিন তরুণ। পাশাপাশি কোন প্রাণী অসুস্থ হলে নিজ উদ্যেগে চিকিৎসাসেবাও দিয়ে আসছেন তারা, এমনকি দরকার পরলে করছেন অস্ত্রোপচারও। ক্যাম্পাস এবং ক্যাম্পাসের আশেপাশে কোন প্রাণীর অসুস্থতা দেখলেই শিক্ষার্থীরাও ফোন করেন তাদেরকে, তারাও সেখানে উপস্থিত হয়ে সাধ্যমত দেন চিকিৎসাসেবা। এভাবেই দিনে দিনে হাবিপ্রবি ক্যাম্পাসের প্রাণীদের নির্ভরতার ঠিকানা হয়ে উঠেছেন তারা।

পশুপাখির প্রতি আগ্রহ থেকেই ২০১৯ সালে তারা ভর্তি হন হাবিপ্রবির ভেটেরিনারি এন্ড এনিম্যাল সাইন্স অনুষদে। সারাক্ষণ পশুপাখি নিয়ে পড়াশোনা করায় ক্যাম্পাসের কুকুরদের প্রতি অনুভব করেন অন্যরকম এক টান। শখের বসেই কুকুরগুলোকে খাবার খাওয়ানো শুরু করেন। একসাথে ক্লাস করা এবং কুকুর বিড়ালকে খাবার খাওয়ানোর মাধ্যমে পরিচয় হয় তিন বন্ধুর। গড়ে ওঠে নিজেদের মধ্যে সখ্যতা। এভাবে কুকুরকে খাওয়াতে গিয়ে একসময় তারা দেখেন অনেক কুকুর রোগাক্রান্ত কিংবা দূর্ঘটনায় আঘাতপ্রাপ্ত। তখন থেকেই আস্তে আস্তে শুরু করেন চিকিৎসা দেয়ার কাজ। 

কিভাবে কুকুর বিড়ালকে চিকিৎসা দেওয়ার আগ্রহ এলো জানতে চাইলে জোবায়ের বলেন, আমাদের ভার্সিটির ভেটেরিনারি হাসপাতালে অনেক অসুস্থ পশুপাখির চিকিৎসা দেয়া হতো। একটা অসুস্থ প্রাণীকে সুস্থ হতে দেখলে আমার মধ্যে অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করতো। এই ভালো লাগা থেকেই আমি নিজেও প্রাণীকে চিকিৎসা দিতে আগ্রহ বোধ করি। আস্তে আস্তে এ বিষয়ে পড়াশোনা হয়, জানাশোনা হয়। তখন ঠিক করি ক্যাম্পাসেই অসুস্থ কুকুরকে চিকিৎসা দিবো। এরপর অসুস্থ কোন কুকুর বা বিড়াল দেখলে সেগুলোর চিকিৎসা করা শুরু করি কয়েকজন বন্ধু মিলে। আস্তে আস্তে আমার ভালো লাগতে শুরু করে। কখনও কখনও ক্যাম্পাসে কেউ কোন অসুস্থ কুকুর বা বিড়াল দেখলে ফোন করে জানাতো। তখন সেখানে গিয়েও চিকিৎসা দেয়া শুরু করি। এভাবেই আস্তে আস্তে আমাদের পথচলা শুরু হয়।

আরেক বন্ধু রাকিবের পশুপাখির সাথে পথচলা শুরু ষষ্ঠ শ্রেনী থেকে। বাবার চাকুরির সুবাদে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মধ্যে কোয়ার্টারেই বড় হয়েছেন তিনি। সেই সুবাদে ক্যাম্পাসের প্রাণীদের সাথেও তার সখ্যতা আগে থেকেই। তিনি বলেন, ষষ্ঠ শ্রেনী থেকে কুকুরকে খাওয়ানোর মাধ্যমে পশুপাখির সাথে আমার সম্পর্কের শুরু। এরপর হাবিপ্রবিতে ভেটেরিনারি অনুষদে ভর্তি হলে পশুপাখির জন্য আরও কাছে থেকে কাজ করার সুযোগ পাই। পশুপাখির চিকিৎসা নিয়ে পড়াশোনা করার পর শুধু খাবার খাওয়ানোর মধ্যে আটকে না থেকে ক্যাম্পাসের অসুস্থ প্রাণীকে চিকিৎসা দেওয়া শুরু করি। এতে নিজের ভালো লাগা আরও বাড়ে। সেই থেকে আনন্দের সাথে এই কাজ করে আসছি।" তবে শুধুমাত্র ক্যাম্পাসের কুকুর নিয়ে কাজ করেই তিনি থেমে নেই। নিজের টাকা খরচ করে প্রতিদিন ক্যাম্পাসের আশেপাশের কর্ণাই, সুবড়ার মতো এলাকায় প্রায় ৫০ থেকে ৬০ টি কুকুরকে খাবার খাওয়ান তিনি। 

তবে পশুপাখির সাথে পথচলা শুরু করার গল্পটা একটু ভিন্ন আরেক বন্ধু ইহসানুল হক শাওনের। ছোটবেলায় বাসায় আসা বিড়াল দেখে প্রাণীর প্রতি তার আগ্রহ জন্মায়। এরপর একটি অসুস্থ বিড়ালকে ডাক্তারের পরামর্শে চিকিৎসা দেওয়া শুরু করেন তিনি। তবে কয়েকদিন চিকিৎসা দিয়েও বাঁচাতে পারেননি নিজের পছন্দের বিড়ালকে। এরপর বাসার পাশেই একটি পোষা কুকুরের ঘা হলে সেখানেও একই ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা শুরু করেন তিনি। এবার সফল হন। সুস্থ হয়ে ওঠে কুকুরটি। এভাবেই আস্তে আস্তে সখ্যতা বাড়ে আরও অনেক কুকুরের সাথে। সেই থেকে পোষা প্রাণীর প্রতি অন্যরকম এক টান শাওনের। এরপর হাবিপ্রবির ভেটেরিনারিতে পড়ার সুযোগ হলে সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজের ভালো লাগা থেকে চিকিৎসা দেওয়া শুরু করেন ক্যাম্পাসের কুকুর এবং বিড়ালের। একসময় ক্যাম্পাসের গন্ডি পেরিয়ে দিনাজপুর জেলা সদরেও বিভিন্ন প্রাণীর চিকিৎসা দেওয়া শুরু করেন তিনি। এভাবেই তিনি শুধু ক্যাম্পাসেই নন বরং পুরো শহরের পশুপাখির নির্ভরতার ঠিকানা হয়ে উঠেছেন। বর্তমানে যুক্ত আছেন দিনাজপুর এনিম্যাল রেস্কিউ গ্রুপের সাথে। পশুপাখির সাথে এ যাত্রায় তার স্বপ্ন অনেক বড়। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে তিনি বলেন, "অনেকসময় এসব প্রাণীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে জটিল অস্ত্রোপচার করতে হয়। এক্ষেত্রে কয়েকদিন এদেরকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা খুব জরুরি। কিন্তু আমাদের এখানে তেমন সুযোগ নেই। আমাদের ইচ্ছা আছে এসব প্রাণীর জন্য একটা এনিম্যাল রেস্কিউ সেন্টার বানানোর। যেখানে এদের জন্য সবরকম সুযোগ সুবিধা থাকবে। আমরা এটা নিয়ে কাজ করছি। আশা করি আমাদের স্বপ্ন দ্রুতই পূরণ হবে।" এছাড়াও নিয়মিত খাবার এবং ভ্যাক্সিন দেয়ার পরিকল্পনাও জানান তিনি। 

প্রাণীর চিকিৎসা করতে প্রতিমাসেই একটা নির্দিষ্ট অংকের টাকার প্রয়োজন হয় তাদের। এই টাকার ব্যবস্থা তারা নিজ উদ্যেগেই করেন বলে জানান। জোবায়ের আলম বলেন, আমরা কাজ করি সম্পূর্ণ ভালোলাগা থেকে। টাকার ব্যবস্থাও নিজেরাই করি। আমাদের অনুষদের শিক্ষকরাও আমাদেরকে অনেকসময় হেল্প করেন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিজেদের ভালোলাগা থেকে নিজেরাই পকেটের টাকা খরচ করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করি। 

চিকিৎসার পাশাপাশি নিয়মিত এসব কুকুরকে খাবারও খাওয়ান তারা। বেশিরভাগ সময় ক্যাম্পাসের আশেপাশের এলাকার মুরগির দোকান থেকে উচ্ছিষ্ট সরবরাহ করে তা কুকুরকে খাওয়ান তারা। বিভিন্ন আবাসিক হলের বেঁচে যাওয়া খাবারগুলোও সংগ্রহ করেন এবং কখনও কখনও নিজেদের টাকাতেও খাবার সরবরাহ করেন তারা। খাবার সরবরাহ ছাড়াও কোন কুকুর বাচ্চা প্রসব করলে সেগুলোর জন্য নিরাপদ জায়গার ব্যবস্থাও করেন তারা।

এভাবেই ক্যাম্পাসের প্রাণীদের বিশ্বস্ততার ঠিকানা হয়ে উঠেছেন তিন বন্ধু। ক্যাম্পাসের কোন প্রাণী অসুস্থ হলেই এখন ডাক পরে তাদের।

আরবি/জেডআর

Link copied!