ঢাকা সোমবার, ২০ জানুয়ারি, ২০২৫

ইকসু গঠন ও নির্বাচন চান শিক্ষার্থীরা

ইদুল হাসান ফারহান, ইবি

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২০, ২০২৫, ০৯:৫৬ এএম

ইকসু গঠন ও নির্বাচন চান শিক্ষার্থীরা

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

আওয়ামী সরকারের পতনের পর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ইকসু) গঠনে সরব হয়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, পত্র-পত্রিকা ও নিয়মিত গল্প-আড্ডায় আলাপ তুলছেন তারা। 

সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি ইকসু গঠন নিয়ে প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি ও মতবিনিময় সভা করতে দেখা গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্রিয় ছাত্র সংগঠনগুলোকেও। 

সেই সঙ্গে অবিলম্বে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানিয়েছে সংগঠনগুলো। তবে ইকসু নিয়ে এখনো কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। 

প্রশাসনের দাবি, দলীয় নির্বাচিত সরকার ছাড়া ইকসু গঠন সম্ভব নয়। তবে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ফোরাম (সিন্ডিকেট/সিনেট) চাইলে এ-সংক্রান্ত নীতিমালা তৈরি করে ছাত্র সংসদ গঠন করতে পারে। এ জন্য জাতীয় সংসদ কর্তৃক নতুন আইন প্রণয়নের দরকার নেই।

জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন আইনি খসড়ায় ছাত্র সংসদসংক্রান্ত প্রয়োজনীয় আইনি কাঠামো রাখা হয়নি। এমনকি পরবর্তীতে ২০১০ সালেও বিশ্ববিদ্যালয় আইনের খসড়া সংশোধনের সময়ও ছাত্র সংসদের বিধান অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি উপেক্ষা করা হয়েছে। 

ফলে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব ও বিগত প্রশাসনগুলোর ঢিলেমিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ গঠন করা হয়নি। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনগুলোর একক আধিপত্যের কারণে শিক্ষার্থীরাও ছাত্র সংসদ গঠন নিয়ে জোরালো দাবি তুলতে পারেনি। 

তাই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে লেখালেখির মাধ্যমে ইকসু গঠনের দাবি তুলছে। এ ছাড়া এই দাবিতে প্রশাসনের কাছে বিভিন্ন সময়ে স্মারকলিপি দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবির ও ছাত্রমৈত্রীসহ অন্যান্য ছাত্র সংগঠন। তবে কোনো স্মারকলিপি না দিলেও অতিদ্রুত ইকসু প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছে শাখা ছাত্রদল। 

শিক্ষার্থী ও ছাত্র সংগঠনগুলোর দাবি, ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে অবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে ছাত্র সংসদ সংক্রান্ত বিধান অন্তর্ভুক্ত করে ইকসু প্রতিষ্ঠা, ছাত্র সংসদ নির্বাচন গ্রহণ, ছাত্র সংসদ ভবন তৈরি করতে হবে। 

এদিকে প্রশাসনের আইনি জটিলতার দোহাইকে ইকসু গঠনে সদিচ্ছার অভাব ও মেকি যুক্তি বলে আখ্যা দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। এ নিয়ে ক্ষোভ জানিয়ে শিক্ষার্থীরা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ৪৫ বছরেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ গঠনের উদ্যোগ নেয়নি প্রশাসন। 

ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের ন্যায্য ও মৌলিক অধিকার যথাযথভাবে পায়নি। এ ছাড়া জুলাই বিপ্লবের অন্যতম দাবি ছিল ছাত্র সংসদ গঠন। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এই বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠন না হওয়ার পেছনে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশই প্রাধান্য পেয়েছে। 

বিভিন্ন সময়ে ক্যাম্পাসে ছাত্র সংগঠনগুলোর নানা অপকর্মের কারণে শিক্ষার্থীরা তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তাই নির্বাচিত সরকারগুলো তাদের ছাত্র সংগঠনের ওপর ভরসা করতে পারে না। তাই তারা ছাত্র সংসদ প্রতিষ্ঠা করেত এত ভয় পায়। তাই আমরা মনে করি, এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলেই ইকসু গঠনের উপযুক্ত সময়। প্রশাসনকে টালবাহানা না করে ইকসু গঠনের উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।

এ বিষয়ে ইবি শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মাহমুদুল হাসান বলেন, আমরা গত কয়েক বছর ধরে ইকসু গঠনের দাবি জানিয়ে আসছি, তবে নানা গোষ্ঠী নানা স্বার্থে ইকসু গঠন হতে দেয়নি। এই প্রশাসনও নানা জটিলতার কথা বলছে। তবে আমরা মনে করি, প্রশাসন মূলত আইনের দোহাই দিয়ে টালবাহানা করছে। আমরা অবিলম্বে ইকসু গঠন ও নির্বাচন চাই।

ইবি শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি মাহমুদুল হাসান বলেন, আমরা দলীয় সরকার নয় এই সরকারের আমলেই জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির মধ্যে সব জটিলতা কাটিয়ে ইকসু গঠনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার দাবি জানাচ্ছি। সেই সঙ্গে দ্রুত নির্বাচনেরও ব্যবস্থা করতে হবে।

ইবি ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক আনোয়ার পারভেজ বলেন, দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে স্বৈরাচারী সরকারের কারণে ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলো তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম অবাধে করতে পারেনি। তাই আমরা মনে করছি, ইকসু গঠনে প্রশাসনকে আরও সময় নেওয়া উচিত।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইবি শাখার সমন্বয়ক এস এম সুইট বলেন, আমাদের দাবি হচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলেই ইকসু গঠন করা হোক। কারণ বিগত সময়ে দলীয় সরকারের আমলে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের রাজনৈতিক স্বার্থচিন্তা করে ছাত্র সংসদ গঠনে অনীহা দেখিয়েছে। ভবিষ্যতেও এই অনীহা অব্যাহত থাকবে বলে আমরা আশঙ্কা করছি। যদি ইকসু গঠনে প্রশাসন টালবাহানা করে তাহলে কঠোর কর্মসূচি দিতে আমরা বাধ্য হব।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনকে ইকসু প্রতিষ্ঠায় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দাঁড় করালেও বিদ্যমান আইনি কাঠামোর মধ্যে দিয়ে ইকসু গঠন সম্ভব বলে একাধিক আইন বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন। 

তারা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে ছাত্র সংসদের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ না থাকলেও বিদ্যমান আইনি কাঠামো দিয়ে সংবিধি ও অধ্যাদেশ প্রণয়ন করে প্রশাসন চাইলে একটি নিরপেক্ষ ছাত্র সংসদ গঠন করতে পারে। 

সংবিধি ও অধ্যাদেশ প্রণয়নের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন-১৯৮০ এর সিন্ডিকেট ক্ষমতা ও কার্যাবলি (২০) সংক্রান্ত ধারায় বলা হয়েছে, ‘চ্যান্সেলরের অনুমোদন সাপেক্ষে সংবিধি প্রণয়ন, সংশোধন বা বাতিল করবে এবং অধ্যাদেশ প্রণয়ন, সংশোধন বা বাতিল করবে। 

এ ছাড়াও সংবিধি প্রণয়ন (৩২) সংক্রান্ত ধারায় বলা হয়েছে, যেকোনো সময়ে সিন্ডিকেট সংবিধি প্রণয়ন করতে পারবেন এবং তা সংশোধন বা বাতিল করতে পারবেন (২) ও সিন্ডিকেট কর্তৃক প্রণীত সকল সংবিধি এবং এতদসম্পর্কে সকল সংশোধনী এবং বাতিলকৃত বিষয় চ্যান্সেলরের কাছে তার অনুমোদনের জন্য পেশ করতে হবে (৩)। অধ্যাদেশ প্রণয়নের ক্ষেত্রেও আইনের ৩৪নং ধারায় সিন্ডিকেটের ক্ষমতা কিছু শর্তসাপেক্ষে আরোপ করা হয়েছে।’

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. জহুরুল ইসলাম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ফোরাম (সিন্ডিকেট) চাইলে এ-সংক্রান্ত নীতিমালা তৈরি করে ছাত্র সংসদ গঠন করতে পারে। 

কেউ কেউ নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে ছাত্র সংসদ গঠনের কথা বললেও আমি মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয় নিজেই এটি করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় তো অনেক আইনই তৈরি করতে পারে, তাহলে এ-সংক্রান্ত আইন কেন পারবে না? আইনের দোহাই দিয়ে শিক্ষার্থীদের বঞ্চিত করা উচিত না।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে বিশ্ববিদ্যালয়সংক্রান্ত প্রধান প্রধান নীতিমালার কথা উল্লেখ রয়েছে। সব বিষয়ে নীতিমালা থাকবে না এটি স্বাভাবিক। 

ছাত্র সংসদ প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আইনের দোহাই দেওয়া ঠুনকো অজুহাত। বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন অনেক কিছু চলমান রয়েছে যেগুলো আইনে নেই। আমি মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট চাইলে নতুন আইন, সংবিধি ও অধ্যাদেশ প্রণয়ন করে ছাত্র সংসদ গঠন করতে পারে। আর এই সরকার তো অধ্যাদেশ জারি করছে তাহলে দলীয় সরকারের আমলে ছাত্র সংসদ গঠন করতে হবে এই কথা কেন বলতে হবে? 

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপউপাচার্য অধ্যাপক ড. এয়াকুব আলীর সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, ছাত্র সংসদ গঠন তো দূরের কথা আগে আমাদের সেশনজট নিরসন করতে হবে। আমরা মনে করি, ইকসু প্রতিষ্ঠা করা সব শিক্ষার্থীর দাবি। 

তবে এটি প্রতিষ্ঠা করা এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। জগ্ননাথ বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে এটি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েও পারেনি। সিন্ডিকেট চাইলে নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারে এসব মুখস্ত কথা বললে তো হবে না। ইকসু প্রতিষ্ঠার ক্ষমতা সিন্ডিকেটের হাতে নেই। 

উপাচার্য অধ্যাপক ড. নকিব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ বলেন, ছাত্র সংসদসংক্রান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে প্রয়োজনীয় আইনি কাঠামো নেই। তাই ছাত্র সংসদ গঠন করতে হলে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ, আদালতের আদেশ ও সংসদ কর্তৃক পাস করা নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে। দলীয় নির্বাচিত সরকার ছাড়া এটি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। এ ছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এমন কোনো কিছু করবে না যেখানে নতুন আইন পাস করতে হয়।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!