বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে হামলাকারীদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ১২২ শিক্ষার্থীকে শনাক্ত করা হয়েছে।
এছাড়াও ওই সময় অন্তত ৭০ জন শিক্ষক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে হামলাকে উসকে দিয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যানুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
অভিযোগকারীরা অভিযোগ দায়েরের সময় যেসব সাক্ষ্য-প্রমাণ জমা দিয়েছিল তার সঙ্গে বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার কন্টেন্ট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও এবং প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান বিচার বিশ্লেষণ করে এই প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কার্যালয়ের পাশে লাউঞ্জে তথ্যানুসন্ধান কমিটির আহবায়ক ও আইন অনুষদের সহযোগী অধ্যাপক মাহফুজুল হক সুপণ উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খানের হাতে এই প্রতিবেদন তুলে দেন। পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে প্রতিবেদনে পাওয়া বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন তিনি।
তথ্যানুসন্ধান কমিটির আহবায়ক সুপণ বলেন, ‘হামলাকারীদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২২ জনকে চিহ্নিত করা গেছে। এছাড়াও বহিরাগত অনেকেই নাম প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে কেবল হামলার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে, এমন নাম দেওয়া হয়েছে। সবমিলিয়ে ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত হামলার ২৫ ভাগ এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ১৫ জুলাই আন্দোলনকারীদের ওপর যে হামলা ছিল তা ‘পরিকল্পিত’ ছিল বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
হামলাকে পরিকল্পিত উল্লেখ করে তথ্যানুসন্ধান কমিটির আহবায়ক বলেন, ‘১৫ জুলাইয়ের হামলা ছিল পুরোটাই পরিকল্পিত। সেখানে দুইটি গ্রুপ ছিল সাদা ক্যাপ পরিহিত; একটি গ্রুপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মলচত্বরে, আরেকটি গ্রুপ ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরী বিভাগের সামনে। এটি একদিনে হয়নি। আগে থেকে পরিকল্পনা না হলে এভাবে সম্ভব না। হামলায় সরকারি বাঙলা কলেজ, কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থী আছে। এটি একদিনে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘মেয়েদের ওপর হামলা ১৫ জুলাইয়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। উপাচার্যের বাসভবনের সামনে মেয়েদেরকে বাস থেকে নামাচ্ছে এবং পেটাচ্ছে। এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা।’
‘অনেক ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে আছে, লাঠি দিয়ে বাছবিচার ছাড়া পেটাচ্ছে, এখানে ঘটনা এমন ছিল না। বরং মেয়েগুলোকে ধরে ধরে পেটানো হচ্ছে। একজন মেয়ে হাত ছাড়িয়ে চলে যেতে চাচ্ছিল, তার হাত ধরে রেখেছে, এটা তো শ্লীলতাহানির পর্যায়ে পড়ে। মেয়েদের ওপর হামলার ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী জড়িত ছিল। তবে বাইরের বেশি ছিল।’
তথ্যানুসন্ধান কমিটির আহবায়ক বলেন, ‘আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টার, ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগের ফটকের এবং জরুরি বিভাগের ভেতরেও হামলা হয়েছে। ডাক্তারদের চিকিৎসা না দিতে বলা হয়েছে। সেসব ভিডিও আমরা পেয়েছি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন জড়িত কী না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা একটা সাধারণ বক্তব্য। যেমন উপাচার্যের বাসভবনের ফটকের সামনে মেয়েদের পেটানো হচ্ছে। ওনারা কিছু জানেন না। ১৬ তারিখ বাইরে থেকে বাস এনে মুহসীন হলের মাঠে রাখা হয়েছে। আমরা প্রশাসনের কোনো ব্যবস্থা দেখেছি?’
‘মুজিব হলের পকেট গেট দিয়ে বহিরাগতদের প্রবেশ করানো হয়েছে, হলের কর্মচারীরা প্রভোস্ট ও আবাসিক শিক্ষকদের ফোন দিয়েছে। তারা ফোন ধরেনি। এখানে শুধু অবহেলা হয়েছে ব্যাপারটা এমন নয়, হয়তো তারা এসব জানতো। তবে কোনো শিক্ষক সরাসরি জড়িত কী না, তা আমরা প্রমাণ পাইনি, তবে জড়িত থাকলেও থাকতে পারে।’
এ প্রতিবেদনে হামলা ও সহিংসতার কতটুকু কাভার করা হয়েছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। আরও শনাক্ত করার সুযোগ আছে। তবে আমরা মনে করি, ২৫ ভাগ তুলে আনতে পেরেছি আমরা।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ব্যাক্তিগত ভিডিও সংগ্রহ করেছি। কিন্তু আমরা সিসিটিভি ফুটেজ পাইনি। প্রত্যেক হলের হার্ডড্রাইভ খুলে নিয়ে গেছে। ভিসি চত্বরের হার্ডড্রাইভে আমরা কিছু পাইনি। অনেক জায়গায় ক্যামেরা এমনভাবে লাগানো, কেবল গাছ দেখা যায়।’
তথ্যানুসন্ধান কমিটি শতাধিক হামলাকারীকে চিহ্নিত করেছে বলেও তথ্যানুসন্ধান কমিটির আহবায়ক জানিয়েছেন।
হামলাকারীদের শাস্তির বিষয়ে তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় মামলা করতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয় কেবল একাডেমিক ব্যবস্থা নিতে পারে। যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়, তাদের ক্ষেত্রে ওই প্রতিষ্ঠান থেকে একাডেমিক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা আমরা সুপারিশ করেছি।’
প্রতিবেদন গ্রহণ শেষে উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, তথ্যানুসন্ধান কমিটি কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এটি সিন্ডিকেটে উন্মোচিত হবে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেখানে বিস্তারিত আলোচনা হবে। এরপর তদন্ত কমিটি ও ট্রাইবুন্যাল গঠনের মতো আইনি প্রক্রিয়াগুলো হবে। সত্যানুসন্ধান কমিটি তদন্তের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করেছে। ফলে প্রতিবেদন তৈরি করতে তূলনামূলক সময় লেগেছে।’
প্রসঙ্গত, ছাত্রজনতার ওই আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান ততকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যারফলে আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের ক্ষমতার পতন ঘটে। এরপর ছাত্রদের সুপারিশে শান্তিতে নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্ব অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। ওই সরকারই এখন পর্যন্ত দেশ চালাচ্ছেন।