ঢাকা শনিবার, ০৪ জানুয়ারি, ২০২৫
রাবি সায়েন্স ক্লাব

পাঁচ বন্ধুর প্রতিষ্ঠিত ক্লাবের এক দশকের বর্ণাঢ্য যাত্রা

রাবি প্রতিনিধি

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১, ২০২৫, ০৫:৩০ পিএম

পাঁচ বন্ধুর প্রতিষ্ঠিত ক্লাবের এক দশকের বর্ণাঢ্য যাত্রা

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

সাধারণ অর্থে ক্লাব শব্দের অর্থ সংগঠন। বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে শিক্ষার্থীরা নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে একটি ক্লাবের কার্যক্রম পরিচালনা করে। একটা ক্লাবের সদস্যদের মাঝে দীর্ঘদিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করায় সৃষ্টি হয় এক অপূর্ব মেলবন্ধন। আর এতেই অর্জিত হয় ক্লাবের ও তার সদস্যের গ্রহনযোগ্যতা, সম্মাননা ও পুরস্কার।

এমনই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন অর্জনের মধ্য দিয়ে এক দশকে পদার্পণ করল ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সায়েন্স ক্লাব’ পরিবার।

রাবির এ বিজ্ঞান ক্লাবটি গত এক দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে জানান দিয়েছে তাদের সৃজনশীলতার। কখনো বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করতে আন্তর্জাতিক সেমিনার আয়োজন, কখনো জাতীয় পর্যায়ের বিজ্ঞান প্রতিযোগিতা, আবার কখনো বড় পরিসরে বই মেলা আয়োজন বা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ২০ হাজার বৃক্ষরোপন প্রতিটি কর্মসূচীতেই থাকে যুগোপযোগীতা। পাশাপাশি ক্লাবটির রয়েছে ৫ বছর মেয়াদী দুটি পৃথক প্রকল্প।

প্রথমটি অর্থাৎ, ‘সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট অব দ্যা ন্যাশন থ্রো সাইন্স’ গৃহীত নিয়মিতভাবে সায়েন্স শো, সোশ্যাল এওয়ারনেস এবং বৃক্ষরোপণের লক্ষ্যে। অন্যদিকে দ্বিতীয় অর্থাৎ ‘গ্রিন হরিজন: সাসটেইনেবল লিগ্যাসি থ্রো ইনভাইরোনমেন্টান রেস্টোরেশন’ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য পরিবেশ সচেতনতা ক্যাম্পেইন, বৃক্ষরোপণ, দূষণ হ্রাস কার্যক্রম, পুনর্ব্যবহার এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রোগ্রাম আয়োজন করা।

ক্লাবটি যাত্রা শুরুর গল্পটা ছিল একটু ভিন্নরকম। ২০১৫ সালের জানুয়ারীতে জীন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগের জহুরুল ইসলাম মুন, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের রেজাউল  করিম ও রসায়ন বিভাগের নাসির উদ্দিন বিজ্ঞানের আগ্রহ থেকে পরিকল্পনা করেন ক্যাম্পাসে ডিএনএ পরীক্ষা কার্যক্রমের। এ সময় তাঁদের সাথে যুক্ত হয়  ফিশারিজ বিভাগের অলোক কুমার পাল ও  জীন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগের চৌধুরী আরিফ জাহাঙ্গীর তূর্য।

তৎকালীন প্রক্টর অধ্যাপক তারিকুল হাসানের কাছে কর্মসূচির অনুমতি চাইতে গেলে তিনি পরামর্শ দেন সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্য দিয়ে আয়োজন করা গেলে অংশগ্রহণ বেশি হবে।

এ পরামর্শ থেকেই ‘বিজ্ঞানের গতিশীলতায় নিজেদেরকে সমুন্নত রাখতে এবং একটি বিজ্ঞানমনস্ক জাতি গঠনের লক্ষ্যে নিজেদের এবং মানুষের মধ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়ার’ লক্ষ্য নিয়ে এবং শিক্ষার্থীদের মাঝে জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়া, বিজ্ঞানের আগ্রহ সৃষ্টি, সংশ্লিষ্ট নানা আয়োজনসহ কয়েকটি উদ্দেশ্য নিয়ে সে বছরেরই আগস্টের ২৯ তারিখে ‘আরইউএসসি সাইন্স অলিম্পিয়াড এন্ড ইনআরগুরেশান সেরিমনি’ শীর্ষক সভায় আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে অরাজনৈতিক এ সেচ্ছাসেবী সংগঠন।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাবি সায়েন্স ক্লাব শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান সম্পৃক্ত করতে সায়েন্টিফিক ইভেন্টের পাশাপাশি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ হিসেবে ‘সর্ববৃহৎ জাতীয়’ বিজ্ঞানমেলা, বইমেলা এবং বৃক্ষরোপণ ও বিতরণে রেকর্ড অর্জন করেছে। এছাড়াও ন্যাশনাল অলিম্পিয়াড, প্রোজেক্ট, উচ্চশিক্ষা, সেমিনার, ওয়েবিনার, গবেষণা, টেকনোলজিকাল ও ক্যারিয়ার ভিত্তিক ট্রেনিং, সরকারী এবং বেসরকারী ইন্ডাস্ট্রি কোলাবোরেশন, মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা, পরিবেশ সচেতনতা, টেলিস্কোপের মাধ্যমে মহাকাশ পর্যবেক্ষণের সুযোগ, 3D, 6D, 9D মুভি প্রদর্শনের সুযোগ সহ নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করে ক্লাবটি। নিজস্ব অর্জনকে ছড়িয়ে দিতে ও বিজ্ঞানের প্রসারের উদ্দেশে প্রতিবছর ক্লাবের পক্ষ হতে বিজ্ঞান মেলাতে মেলায় একটি ‘ন্যাশনাল সাইন্স ফিয়েস্টা’ শীর্ষক স্যুভেনির ও ‘রিফ্লেকশন: দ্যা ওভার ভিউ অব সায়েন্স’ নামে ম্যাগাজিন প্রকাশ করা হয়।

ইতোমধ্যে ক্লাবটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হয়ে রাজশাহী শহরের প্রায় প্রতিটি স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানে আগ্রহী করে তুলতে ধারাবাহিকভাবে সায়েন্স শো, সেমিনার আয়োজন করছে। তাঁদের প্রচেষ্টা রয়েছে এ কার্যক্রম শহর পার করে গ্রাম অঞ্চলের দিকেও ধাবিত করার। ফলে, ক্লাবটি শুধুমাত্র রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমাবদ্ধ নয় বরং পুরো রাজশাহী অঞ্চলেই তাদের কার্যক্রম প্রসারিত করছে।

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও পরিচ্ছন্ন রাখতে, সংগঠনটি জনপ্রিয়ভাবে পার্থেনিয়াম নিয়ন্ত্রণ, বায়োডাইভারসিটি, স্মার্ট বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জলাধার সংরক্ষণ ইত্যাদি বিষয়ে সেমিনার ও ওয়ার্কশপ আয়োজন করেছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ১৩টি  ইকো স্মার্ট ডাস্টবিন ও ৬ টি সাধারণ ডাস্টবিন স্থাপন করেছে। এ ছাড়াও ক্লাবটি এ বছরে প্রায় ৪ হাজার বৃক্ষ বিতরণ করেছে।

ক্লাবের সদস্য সাব্বির সিকদার বলেন, আমার দেখা অন্যতম সেরা একটা ক্লাব রাবি সায়েন্স ক্লাব। পুরো বছর জুড়েই কোনো না কোনো কাজের মধ্য দিয়ে আমরা পার করি। ফলে, ক্লাবের প্রত্যেক সদস্যই হয়ে ওঠে অত্যন্ত দক্ষভাবে।

সৃজনশীলতার স্বীকৃতিস্বরূপ ক্লাবটি ২০১৮ সালে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর নিবন্ধন লাভ করে, ২০২৩ সালে সালে তিন শতাধিক ক্লাবের সাথে প্রতিযোগিতায় সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রায় ৬ হাজার ভোট পেয়ে YCI লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ডে ‘বেস্ট ক্লাব এওয়ার্ড’ অর্জন করে। এ স্বীকৃতির অনুদানে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের বিশেষ অনুদান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে বিজ্ঞান ক্লাবের জন্য বরাদ্দকৃত ১ লক্ষ টাকার অনুদানের প্রতি বছর ক্লাবটি।

এছাড়াও আন্তর্জাতিক জলবায়ু পরিবর্তন ও উন্নয়ন কেন্দ্র হতে অর্ধ মিলিয়ন টাকার প্রজেক্ট ও ‘সুরেন্দ্রনাথ দাস এন্ড ভাজাসুন্দারী দাস মেমোরিয়াল ফান্ড’ থেকে পাঁচ বছর মেয়াদী বেশ বড় অংকের অনুদান পায় রাবির এ ক্লাব।

এক দশকের আড়ম্বরপূর্ণ যাত্রায় ক্লাবের সাথে যুক্ত রয়েছে ক্লাবের সাত শতাধিক প্রাক্তন সদস্য। এ ছাড়াও ৩৫ জন সম্পাদকীয়, ১০ জন উচ্চ-কার্যনির্বাহীসহ ক্লাবের বর্তমান সদস্য সংখ্যা দেড় শত। বর্তমান ও প্রাক্তন সদস্যদের সুনিপুণ প্রচেষ্টায়  ক্লাবের নেটওয়ার্কিং পৌঁছে গেছে অনন্য মাত্রায়। ফলে শিক্ষার্থীদের সুযোগ হয়েছে দেশ বরেণ্য ব্যক্তি, বিজ্ঞানী ও প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করার সুযোগ। এদের মধ্যে ড. সালেহীন কাদরী, ড. ফেরদৌসী কাদরী, ড. হাসিনা খান, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, মুনির হাসান প্রমুখ। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন, বাংলাদেশ শিল্প ও বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদ উল্লেখযোগ্য।

এ ছাড়াও প্রথমা,  UPL, জ্ঞানকোষ, সমকালীন প্রকাশন, পারিজাত ইত্যাদি সহ আরো বেশ কিছু প্রকাশনীর সাথে সরাসরি কাজ করেছে রাবি সাইন্স ক্লাব।

সার্বিক বিষয়ে ক্লাবের বর্তমান সভাপতি ও ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের শিক্ষার্থী মাসুদ বলেন, কয়েকবছর সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ, বিভিন্ন শ্রেনির প্রতিষ্ঠানের সাথে এক সাথে সফলভাবে কাজ করতে যেয়ে মানসিক বড় রকমের পরিবর্তন ঘটে যায়। একটা পরিবারে পরিনত হয়ে যায় ক্লাবটি।

এ ছাড়াও তিনি সক্রিয়ভাবে ক্লাব জীবনের এই ৫-৬ বছর অন্যতম সোনালি সময় হয়ে থাকবে বলে জানান। লম্বা এ যাত্রায় যুক্ত থাকা কমিউনিটিকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান ক্লাব সভাপতি।

আরবি/জেডআর

Link copied!