নভেম্বরের শুরু থেকেই আবহাওয়া অনেকটাই পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। বাতাসে কমে গেছে আর্দ্রতা। প্রকৃতিতে এখন কিছুটা শীতের আমেজ পাওয়া যাচ্ছে। আর এই শীতের শুরুটা যেন অন্য রকম এক মুহূর্ত।
গুণীজনরা বলেন, প্রেম আর শীতের শুরুটা একইভাবে হৃদয়কে নাড়া দেয়। শীতের শুরুতে ভালো লাগার নতুন মাত্রা যোগ করে পিঠা। পিঠা ছাড়া বাংলার শীত যেন পরিপূর্ণ হয় না। কথায় আছে ‘শীতের পিঠা, খেতে ভারি মিঠা’।
কিন্তু ব্যতিক্রম ঘটে পরিবার থেকে দূরে থাকা শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে। পড়াশোনার উদ্দেশ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের এসব ছেলে-মেয়েকে থাকতে হয় পরিবার থেকে অনেক দূরে। তবে পরিবারের সাথে থাকতে না পারলেও শীতের শুরুতেই পিঠার স্বাদ আস্বাদন করতে পারেন দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থীরা।
হিমেল হাওয়া বাড়ার সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে দেখা যায় শীতকালীন হরেক রকম পিঠার পসরা সাজিয়ে বসে আছেন স্থানীয় কিছু পিঠা বিক্রেতা এবং বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কিছু তরুণ উদ্যোক্তা। খোলা আকাশের নিচে সারি সারি মাটির চুলা সাঁজানো। এতে দাউ দাউ করে জ্বলছে কাঠের টুকরো। সেসব চুলার ওপর কড়াই বসানো।
এদিকে, চুলার চারপাশের সবুজ ঘাসের ওপর রঙিন মাদুর বিছানো। কিছু চেয়ারও রয়েছে। তড়িঘড়ি করে চলছে পিঠা তৈরির কাজ। এভাবেই জমে উঠেছে রাবির শীতকালীন এসব পিঠার দোকান। যা চলবে শীতের শেষ পর্যন্ত। আর এসব দোকানের ধোঁয়া ওঠা গরম গরম পিঠা খেতে খেতে জমে উঠে শিক্ষার্থীদের আড্ডা। ঠিক মুখোমুখি বসে সবাই পিঠা খাচ্ছেন। কেউ এসেছেন সহপাঠীদের সঙ্গে আবার কেউবা বন্ধুদের নিয়ে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে পিঠার দোকান বসলেও সবচেয়ে বেশি জমে উঠেছে শহীদ সুখরঞ্জন সামাদ্দার ছাত্র-শিক্ষক সংস্কৃতিক কেন্দ্রের (টিএসসিসি) মাঠে।
সরেজমিনে দেখা যায়, অনেকগুলো চুলায় একসঙ্গে পিঠা তৈরি হচ্ছে। আতপ চালের আটা দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে চিতই পিঠা, চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে ভাপা পিঠা, আরও আছে পাটিসাপটা, নারিকেল, পুলি, তেলের পিঠাসহ হরেক রকমের শীতকালীন পিঠা। গরম গরম পিঠা শিক্ষার্থীদের আড্ডার আসরে পৌঁছে দিচ্ছেন দোকানের কর্মচারীরা। তবে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কিছু শিক্ষার্থীদেরও স্টল দিতে দেখা যায়। যেখানে এসব পিঠা পরিবেশন করছেন উদ্যোক্তা এসব শিক্ষার্থীরাই।
পিঠার সঙ্গে হরেক রকম ভর্তার প্লেট সাজিয়ে দিচ্ছেন তারা। ভর্তাগুলোর মধ্যে— চিংড়ি, মাছের শুঁটকি, বেগুন, কাঁচামরিচ, ধনিয়া পাতা ও কালোজিরা ভর্তা অন্যতম। পিঠার সঙ্গে সঙ্গে ভর্তার প্লেটও চলে যাচ্ছে আড্ডাস্থলে। গরম পিঠা আর তার সঙ্গে নানা রকম ভর্তায় আড্ডা যেন আরো জমে ওঠে।
ক্যাম্পাসের দোকানগুলোতে বন্ধুরা মিলে যখন একসঙ্গে পিঠা খাওয়া হয়, তখন নিজের অজান্তেই ক্ষণিকের জন্য মনে পড়ে যায় গ্রামের বাড়িতে চুলার ধারে বসে মায়ের হাতের পিঠা খাওয়ার কথা। তাই তো পরিবার-পরিজন থেকে শত শত মাইল দূরের ক্যাম্পাস যেন আরেকটা পরিবার।
বন্ধুদের সাথে পিঠা খেতে এসেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান। তিনি বলেন, শীতকাল মানেই নিত্য-নতুন খাবারের সমাহার। তেমনই শীতকালের একটি অন্যতম মজার খাবার পিঠা। পিঠা পছন্দ করে না এমন মানুষ মেলা ভার। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। পরিবার ছাড়া পিঠা খেয়ে সব থেকে বেশি আনন্দ পাই টিএসসিসির মাঠে। এ কারণে প্রায় সময় বন্ধু-বান্ধব নিয়ে একসাথে আসি। পিঠার জন্যই যেন শীতের আগমন। শীতের পিঠা খাওয়ার অনুভূতিটা আসলেই অন্যরকম।
ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী মরিয়ম ইসলাম বলেন, সারাদিন ক্লাস-পরীক্ষা দিয়ে আমরা ক্লান্ত হয়ে যায়। তখন এখানে এসে বন্ধু-বান্ধবীর সঙ্গে আড্ডা জমিয়ে পিঠা খাওয়ার ফলে সেই ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। বাড়িতে থাকলে হয়তো পিঠা খেতাম কিন্তু বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা জমিয়ে খাওয়ার সুযোগ হতো না।
কথা হয় অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী শারমিন আক্তারের সাথে। তিনি জানান, শীতকাল আসতেই বাড়িতে পিঠা বানানোর কাজ শুরু হতো। ক্যাম্পাস খোলা থাকায় মায়ের হাতে পিঠা খাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব দোকানগুলো আমাদের মায়ের হাতের পিঠার কথা স্বরণ করিয়ে দিচ্ছে। বিভিন্ন রকম ভর্তাও পাওয়া যাচ্ছে এখানে।
দীর্ঘদিন ধরে পিঠা বিক্রি করেন রাজশাহীর শফিক মিয়া। তিনি জানালেন, অনেক শিক্ষার্থী পিঠা খেতে আসে। যার ফলে বানিয়ে শেষ করতে পারি না। প্রতিদিন প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার মতো পিঠা বিক্রি হয়।
তবে হতাশা নিয়ে তিনি বলেন, দ্রব্যমূলের উর্ধ্বগতির ফলে আগের মতো লাভ হয় না। লাকড়ি, তেল, আটাসহ সব কিছুর দাম আগের থেকে দ্বিগুণ হয়েছে। তবে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় পিঠা বিক্রিতে আশার আলো দেখছেন তারা।
আপনার মতামত লিখুন :