এমন একটি কলেজ কল্পনা করুন, যেটির নেই নিজস্ব কোন ভবন কিংবা শিক্ষক। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এবং শিক্ষক না থাকলেও রীতিমতো ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে নিয়েছে শিক্ষার্থী ভর্তি। শিক্ষার্থী ভর্তির পাশাপাশি মাসিক বেতন নির্ধারণেও রেখেছে আভিজাত্যের ছাপ। প্রত্যেক মাসে বেতন হিসেবে শিক্ষার্থীদের গুনতে হবে দু`হাজার টাকা। যথাযথ প্রক্রিয়া অবলম্বন না করে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি করানো এই একশো শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ভর্তি ফি এবং এক মাসের অগ্রীম বেতন বাবদ মোটমাট নেয়া হয়েছে সাত লক্ষ টাকা।
ভবন এবং শিক্ষক বিহীন এই কলেজটির নাম শেখ রাসেল মডেল স্কুল। যেটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধীনে রাবি`র কাজলা গেট সংলগ্ন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদানের অনুমতি থাকলেও এই স্কুলে বিগত কয়েকবছর ধরে অবৈধভাবে নবম শ্রেণিতে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে। চলতি বছর প্রথমবারের মতো কলেজ শাখায় ভর্তি করা হয়েছে ১০০ জন শিক্ষার্থীকে।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, দেশের অন্যান্য কলেজগুলোতে ১লা জুলাই ক্লাস শুরু হলেও এই স্কুলের কলেজ শাখায় ক্লাস শুরু করতে পারেনি শিক্ষার্থীরা। হয়নি উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য রেজিষ্ট্রেশন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি মোতাবেক, এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কলেজ শাখা চালু করতে হলে প্রথমত ম্যানেজিং কমিটির অনুমতি ও পর্যায়ক্রমে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সিদ্ধান্তসহ আরো কিছু ধাপ পেরিয়ে যেতে হতো। এরপর সবশেষে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট সভায় উত্থাপিত হয়ে সিদ্ধান্ত গৃহিত হলে তা শিক্ষাবোর্ডে আবেদনের জন্য পাঠানো যাবে। পরে শিক্ষাবোর্ড প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাই ও কলেজ পরিদর্শনের পরই কলেজ শাখা চালুর অনুমতি প্রদান করতে পারে।
তবে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন নথিপত্র ঘেটে দেখা যায়, কলেজ শাখা চালুর ব্যাপারে এসব বিধির কোনো তোয়াক্কা করেনি প্রতিষ্ঠানটি। ম্যানেজিং কমিটিতে সিদ্ধান্ত বাতিল হলে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে এই সিদ্ধান্ত উত্থাপন করতে পারেনি। তবে সিন্ডিকেটে উত্থাপন না করলেও ভুয়া নথিপত্র ব্যবহার করে শিক্ষাবোর্ড থেকে কলেজ শাখা চালুর অনুমতি বাগিয়ে নেয় প্রতিষ্ঠানটি।
অন্যদিকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদানের অনুমতি থাকায় অবৈধভাবে ভর্তি করানো নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য পাশে অবস্থিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল ও কলেজ থেকে রেজিষ্ট্রেশন সম্পন্ন করানো হয়।
একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের সূত্রে জানা যায়, ২৭ জুন বিশ্ববিদ্যালয় ওয়েবসাইটে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর আবেদনের মাধ্যমে ভর্তি হন তারা। এরপর যথাসময়ে ক্লাস শুরু না হলে তারা জানতে পারেন তাদের কলেজে শিক্ষকের পাশাপাশি নিজস্ব কোনো ভবনও নেই। এমতাবস্থায় বিপাকে পড়েছেন একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া এই একশো শিক্ষার্থী। ক্লাস শুরু এবং রেজিষ্ট্রেশনের দাবিতে ২২ সেপ্টেম্বর ও ১৭ অক্টোবর শেখ রাসেল মডেল স্কুল ভবনে তালাও প্রদান করেছেন তারা।
কলেজ শাখা চালুর বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক দুলাল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, আমি এই স্কুলটিকে একটি মডেল স্কুলই করতে চেয়েছিলাম এবং সেই লক্ষ্যেই স্কুলের অধ্যক্ষ ও অন্যান্যদের সাথে কথাও বলেছি। কিন্তু স্কুল শিক্ষকরা শুরু থেকেই এটিকে কলেজ করতে চেয়েছেন। যেহেতু আমি কলেজ করার বিরোধিতা করেছিলাম, তারা আমাকে না জানিয়েই সাবেক রাবি উপাচার্য গোলাম সাব্বির সাত্তার স্যারের অনুমতি নিয়ে (বোর্ড থেকে) কলেজ শাখা চালুর অনুমতি নিয়ে আসেন। কলেজ হওয়ার সমন্বিত প্রসেস তারা (স্কুল শিক্ষকরা) আরও আগে আব্দুস সোবহান স্যার উপাচার্য থাকাকালীন শুরু করেছিল। আমি দায়িত্ব পাওয়ার শুরু থেকে এর বিপক্ষে ছিলাম। কিন্তু যখন তারা অনুমতি নিয়ে আসলো এবং শিক্ষার্থী ভর্তি করলো; তখন স্কুলের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের অনুরোধে কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম চালুর চেষ্টা করি। অস্থায়ী বা খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ, পাশের বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল থেকে গেস্ট শিক্ষক গ্রহণ, ল্যাব নির্মাণ এবং স্কুল ও কলেজ শাখাকে ২ শিফটে নেওয়ার মাধ্যমে কলেজ শাখা চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করি। তবে মাঝখানের আন্দোলনের (বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন) কারণে এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন হয়নি, নাহলে ওইসময় কলেজ শাখার চালুর ব্যাপারে কোনো সমস্যা হতো না। তবে কলেজ শাখা চালুর অনুমোদন আমার হাতে ছিল না, তারা (স্কুল কর্তৃপক্ষ) এই অনুমোদন নিয়ে আসে এবং একপ্রকার আমার উপরে চাপিয়ে দেয়। আমি দায়িত্ব পালনকালে শুধু এটির বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে কলেজ শাখাকে চালিয়ে নেয়া যায় কিনা সেই চেষ্টাটুকু করেছিলাম।
প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাই ও কলেজ পরিদর্শনের পরে কলেজ শাখা চালুর অনুমতি দেওয়ার নিয়ম থাকলেও ব্যাপক অসংগতির অভিযোগ উঠেছে রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের বিরুদ্ধে।
তবে এবিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের সভাপতি অধ্যাপক ড. অলীউল আলম জানান, আমি একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে ঢাকায় অবস্থান করছি। আমি জানি যে, সবধরনের নিয়ম অনুসরণ করেই কলেজ শাখা চালুর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে কলেজ শাখা পরিদর্শনের বিষয়ে আমাদের বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক বলতে পারবেন।
অনুমোদন দেওয়াকালীন কলেজ পরিদর্শক ও বর্তমানে রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের সচিব অধ্যাপক হুমায়ুন কবিরের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, উক্ত কলেজশাখা চালুর বিষয়ে সকল নিয়ম অনুসরণ করা হয়েছে। আমাদের কাছে এর ডকুমেন্টসও আছে।
আপনার মতামত লিখুন :