ঢাকা শুক্রবার, ১০ জানুয়ারি, ২০২৫

বাকৃবিতে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগকে পুনর্বাসন, প্রশ্রয়ে প্রাধ্যক্ষ-ছাত্রদল নেতা

ময়মনসিংহ ব্যুরো

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১০, ২০২৫, ০৪:৫৭ পিএম

বাকৃবিতে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগকে পুনর্বাসন, প্রশ্রয়ে প্রাধ্যক্ষ-ছাত্রদল নেতা

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যায়ে (বাকৃবি) নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীকে পুনর্বাসন করার অভিযোগ উঠেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হলের প্রাধ্যক্ষ শরীফ আর রাফির বিরুদ্ধে। তিনি প্রাধ্যক্ষের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হলে পুনর্বাসন করার জন্য তাকে দায়ী করছেন অনেকে।

অভিযোগ রয়েছে, প্রাধ্যক্ষ শরীফ আর রাফির সহযোগীতায় বাকৃবি ছাত্রদলের সদস্য মিজানুর রহমান ১০ জন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হলে পুর্নবাসন করেছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হলের প্রাধ্যক্ষ শরীফ আর রাফি বাকৃবি বগুড়া জেলা সমিতির সভাপতি এবং সেই সমিতির সাধারণ সম্পাদক বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহরাওয়ার্দী হল ছাত্রলীগের উপ-তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক উসমান ইভান ওহী। প্রাধ্যক্ষ শরীফ আর রাফির ছত্রছায়ায় ছাত্রলীগের উপ-তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক উসমান ইভান ওহী সোহরাওয়ার্দী হলে অবস্থান করছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, প্রাধ্যক্ষ শরীফ আর রাফি বাকৃবির ছাত্রদল নেতা মিজানুর রহমানের ছত্রছায়ায় ওই হলে ছাত্রলীগের ১০ নেতাকর্মীকে পুর্ণবাসন করেছেন। এতে অনেক ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ভোল পাল্টে ছাত্রদলে যোগদানের চেষ্টা করছেন। এদের মধ্যে ছাত্রদলের লেবাজ পরেছেন আসিফ ইকবাল সুপ্ত, আসিব মুজতবা, আলমগীর হোসেন নীরব, মিজানুর মুগ্ধ, নাফিউর সোহান, রওনক রিফাত, আরমান হাসান, নাজিব আবিদ, সাইফুল ইসলাম, রুবেল আহমেদ। ছাত্রলীগের সক্রিয় ক্যাডাররা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হলে পুনর্বাসন হওয়ার বিষয়টি জানা সত্ত্বেও প্রাধ্যক্ষ শরীফ আর রাফি কোন এক অদৃশ্য কারণে নিরব ভূমিকা পালন করছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হলের প্রাধ্যক্ষ শরীফ আর রাফি

এদিকে, গত ২৬ ডিসেম্বর বাকৃবি শাহজালাল হলে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ফিস্টের আয়োজন করা হয়। ওই আয়োজনে রাতের ফিস্টে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণার গান, জয় বাংলা স্লোগান, জিতবে এবার নৌকা এবং যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই, এমন গান বাজানো হয়। এসব গানের মাধ্যমে দ্রুতই চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়, যার প্রভাব ক্যাম্পাসের বাইরেরও ছড়িয়ে পড়ে। তবে শিক্ষার্থীরা দাবি করছেন, ব্যঙ্গ করার উদ্দেশ্যে এসব গান বাজানো হয়েছে।

বিষয়টি জানতে পেরে তাৎক্ষনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই হলের প্রাধ্যক্ষ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবিষয়ক উপদেষ্টা, সহকারী প্রক্টর ওই দিন (২৬ ডিসেম্বর) হলে গিয়ে দেখতে পান, তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছাত্রলীগ দ্বারা পরিচালিত কৃষি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদের ক্রীড়া সম্পাদক আজমাইন হাসান মাইন গানের সাথে সাথে নাচানাচি করছেন।

প্রশাসন সূত্র জানায়, গত ২৬ ডিসেম্বর ঘটনার সাথে জড়িত শাহজালাল হল ছাত্রলীগের উপ-মানব সম্পদ বিষয়ক সম্পাদক মানিক মিয়া এবং বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক মো. সাইফুল ইসলাম সোহানকে ওই রাতেই হল থেকে বের করে দেয়া হয় এবং তদন্তপূর্বক প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

এছাড়া, ওই হলের ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মুমিন রুহি, সহ-সভাপতি রাসেল মোল্লা, তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক ফাহিম শাহরিয়ারসহ ছাত্রলীগের আরও নেতাকর্মী অবস্থান করছেন।

বাকৃবি‍‍`র বিভিন্ন হলে ছাত্রলীগের পদধারী নেতারা অবস্থান করছেন। এদের মাঝে ফজলুল হক হলে ছাত্রলীগের উপ-শিক্ষা ও পাঠচক্র বিষয়ক সম্পাদক তৌকির ইমাম, যে কিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা জুয়াড়ি ও মাদকাসক্ত বলে জানা গেছে। আশরাফুল হক হলে অবস্থান করছেন সংশ্লিষ্ট হল ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মো. ইরফানুল হক, দেবাশিষ সাহা, উপ-গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক সাইফুল ইসলাম ইয়াসিন, উপ-গণ-শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক মো. জিহাদ আল ফারুকসহ আরও অনেকে।

নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিভিন্ন হলে পুনর্বাসন করার প্রতিবাদে শনিবার (৪ জানুয়ারি) দিবাগত রাত ২টায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুল হক হলের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের অফিস বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়। এর আগে গত ৫ আগস্ট বিকেলে ছাত্রলীগের অফিস ভাঙচুর করে পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, ওই রাতে উপস্থিত শিক্ষার্থীরা লাঠি, ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে প্রথমে ছাত্রলীগের অফিস ভবন ভাঙা শুরু করেন। পরে বুলডোজার দিয়ে পুরো ভবন গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এ সময় নেচে-গেয়ে আনন্দ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন শিক্ষার্থীরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শহীদ শামসুল হক হলের এক শিক্ষার্থী বলেন, নিষিদ্ধ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এই বাকৃবিতে ছাত্রলীগের কবর রচিত হলো। ছাত্রলীগকে যে বা যারা পুনর্বাসন করার চেষ্টা করবে, তাদের বিরুদ্ধে শহীদ শামসুল হক হলের সাধারণ শিক্ষার্থীরা কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন।

এ বিষয়ে বাকৃবি শাখা ছাত্রদলের সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হলের শিক্ষার্থী মিজানুর রহমান বলেন, যে ১০ জনকে বলা হচ্ছে, তারা সবাই লেভেল ২‍‍`র শিক্ষার্থী। প্রকৃতপক্ষে তারা কেউ ছাত্রলীগ করে না বা কোন সময়ই ছাত্রলীগের সাথে জড়িত ছিল না। এগুলো সম্পুর্ণ মিথ্যা ও প্রপাগান্ডা।

জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হলের প্রাধ্যক্ষ শরীফ আর রাফি বলেন, গত ১৫ বছর একটা দল ক্ষমতায় ছিল। শিক্ষার্থীরা চাপে পড়ে অনেক সময় ছাত্রলীগের সাথে জড়িত ছিল। তবে, তারা যদি কোন অন্যায়, অত্যাচার র‍্যাগিংয়ের সাথে জড়িত না থাকে, তাহলে তাদের হলে থাকার অধিকার আছে। তবে, কেউ যদি ছাত্রলীগের আদর্শের সাথে জড়িত থাকে। তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ফজলুল হক হলের ছাত্রলীগের উপ-শিক্ষা ও পাঠচক্র বিষয়ক সম্পাদক তৌকির ইমাম বলেন, আমি যখন প্রথম বর্ষে ভর্তি হই। তখন আমাকে জোর করে ছাত্রলীগের পদ দেওয়া হয়েছিল। এখন আমি ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত না। আমি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত ছিলাম। তাছাড়া, আমার বিরুদ্ধে জুয়া খেলার যে অভিযোগ উঠেছে এটা সম্পুন্ন মিথ্যা ও বানোয়াট।

এ বিষয়ে ফজলুল হক হলের প্রাধ্যক্ষ তোফাজ্জল হোসেন হাওলাদার বলেন, ছাত্রলীগের উপ-শিক্ষা ও পাঠচক্র বিষয়ক সম্পাদক তৌকির ইমাম সাবেক ছাত্রলীগ নেতা। বর্তমানে সে রাজনীতি করবে না মর্মে স্বীকার করার পর তাকে হলে থাকার জন্য বলা হয়েছে। তবে, সে জুয়াড়ি, মাদকাসক্ত ও মাদক ব্যবসার জড়িত বিষয়টি জানা ছিল না। তবে, খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

শাহজালাল হলের প্রাধ্যক্ষ মো. বদিউজ্জামান খান পিন্টু বলেন, গত ২৬ ডিসেম্বর বাকৃবি শাহজালাল হলে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ফিস্টের আয়োজন করা হয়। আয়োজন করলে ওই রাতের ফিস্টে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণার গান, জয় বাংলা স্লোগান, জিতবে এবার নৌকা এবং যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই, এমন গান বাজানো হয়। খবর পেয়ে আমরা তাৎক্ষনিক হলে এসব বন্ধ করে দেই। পরবর্তীতে ভিসি সারের নির্দেশে আমরা একটা তালিকা তৈরী করেছি। অতি তাড়াতাড়ি তালিকা জমা দেব। তালিকা অনুয়ায়ী প্রশাসন ব্যবস্থা নিবে।

বাকৃবি ছাত্রদলের আহ্বায়ক কৃষিবিদ মো. আতিকুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন চায়। গুণগত পরিবর্তন এবং সংস্কারের মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতি আবার চালু হলে ছাত্রলীগ বা ছাত্রলীগের কোন দোসর হল কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে পারবে না। দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক সংস্কার করে নতুন রূপে রাজনীতি চালু করা হবে বলেও জানান তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মো. আব্দুল আলীম বলেন, ৫ আগস্টের পর অনেক হলে লুটপাট হয়েছে। তখন প্রশাসন তেমন সক্রিয় ছিল না। সেই সুযোগে ছাত্রলীগের পদধারি নেতা বিভিন্ন হলে উঠেছে। শিক্ষার্থীদের দাবি, ছাত্রলীগের আদর্শের সাথে কোন নেতাকর্মী বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে পারবে না। আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছি।

আরবি/এইচএম

Link copied!