উত্তরা: রাজধানীর প্রবেশপথ উত্তরার অরক্ষিত রেলক্রসিং গুলো দিনে দিনে মরণ ফাঁদে পরিনত হয়ে উঠছে। সেই সাথে এসকল এলাকায় দায়িত্বরত গেটম্যানদের বিরুদ্ধে দায়িত্ব পালনে অবহেলার অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয়রা জানান ট্রেন আসার আগামবার্তা পেয়ে সঠিক সময়ে গেইট বন্ধ করা ও ট্রেন চলে যাওয়ার পর গেইট খুলে দেওয়া এসব দায়িত্ব পালনে গেটম্যানদের অবহেলার কারণে সংশ্লিষ্ট এলাকায় প্রতিনিয়ত বাড়ছে দূর্ঘটনা ও তীব্র যানজট।
সরেজমিনে আব্দুল্লাহপুর গিয়ে জানা যায়, গত এক বছর যাবত রাজধানীর প্রবেশপথ উত্তরা আব্দুল্লাহপুর এলাকার রেলক্রসিং-এর গেইট ব্যারিয়ার নষ্ট হয়ে আছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান ঐ গেইটে ১৫ বছর যাবত চাকুরি করছেন গেটম্যান আব্দুস ছামাদ।
জানা যায়, সারা দেশে রেলপথের উন্নয়ন ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় নতুন নতুন লাইন তৈরীর হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে । রেল কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও অনিয়মের কারণে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন উত্তরা এলাকার ৪ লেনের নতুন রেললাইনের নির্মাণকাজ ও লাইনম্যানদের বসার ঘন্টি ঘর, যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ উন্নয়ন কাজে রয়েছে ধীর গতি। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পর সারাদেশে পরিবর্তনের হাওয়া বৈইছে। স্থানীয়দের দাবি এ সুযোগে উত্তরা এলাকায় চলমান ৪ লেনের রেলওয়ের সড়কের কাজ ও রেলক্রসিংএর নষ্ট হওয়া গেইট ব্যারিয়ার গুলো দ্রুত গতিতে ঠিক করা হউক।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গেটম্যানদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে দিনে দিনে ঝুঁকি পূর্ণ ও অনিরাপদ হয়ে উঠেছে এখানকার রেলক্রসিং এলাকা গুলো।
দেশের সব জেলাকে পর্যায়ক্রমে রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আনার কাজ চলছে।কিন্তু ট্রেন পরিচালনায় সবচেয়ে বড় বাধা লেভেলক্রসিং।
রেলপথের ওপর নির্মিত সড়কে যান চলাচলের কারণে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটে। এ অবস্থা থেকে নিস্তার পেতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এলজিইডি ও সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে এসব লেভেলক্রসিং তৈরি করা হয়।
রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) মো: আরিফুজ্জামান বলেন, এ বিষয়ে দূর্ঘটনা এড়াতে গড়ে প্রতি এক কিলোমিটার পর পর লেভেলক্রসিং তৈরি করা হয়েছে। জানা যায়, সড়ক পথের যাতায়াত সহজ করতেই রেলপথ ধরে নির্মাণ করা হয় লেভেলক্রসিং। রেললাইনের পাশে রাস্তার উন্নয়ন বা প্রশস্তকরণের মাধ্যমে এ রকম ক্রসিং করা বেআইনি হলেও এলাকাবাসীর চলাচল ও দূর্ঘটনা এড়াতে নিরাপত্তার স্বার্থে গড়ে উঠেছে এ সব রেল ক্রসিং।রেলওয়ে অ্যাক্ট, ১৮৯০-এর ১২৮ ধারার বিধানমতে এ কাজে ২ বছরের কারাদন্ডের বিধান রয়েছে। কখনো কখনো এসব গেটে গেটম্যান না থাকায় মানুষের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ট্রেনের ইঞ্জিন ও বগি।রেলওয়ের আইনে বলা আছে রেললাইন দিয়ে সড়ক করতে হলে আগে আবেদন করতে হয়।এর পর গেটম্যানের বেতন,অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের অর্থ দিতে হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই আইন মানা হচ্ছে না। জানা যায়,যারা এসব প্রতিষ্ঠান অনুমোদন নিয়েছে তারাও গেটম্যানদের বেতন-ভাতা ঠিকমতো পরিশোধ করে না। ফলে অনেক অস্থায়ী গেটম্যান ঠিকমতো বেতন পায়না।বেতন না পেয়ে মাসের পর মাস তারা মানবেতর জীবন যাপন করছে।
রেলক্রসিং এ দায়িত্বরত গেইট ম্যান ও কিছু অসাধু লোকজনের আতাঁতে রেললাইনের দুই পাশে রেলের জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছে অবৈধ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও তাদের নেতৃত্বে রেললাইনের উপর পশরা সাজিয়ে বসছে শত-শত ভাসমান দোকানপাট।
বিমানবন্দর রেলস্টেশন এলাকায় রেললাইনের উপর যত্রতত্র বসছে ঝুঁকিপূর্ণ ভাসমান দোকানপাট। এসব ভাসমান দোকানদাররা ট্রেন আসতে দেখলে টুকরি নিয়ে দৌড় মারে, ট্রেন চলে গেলে আবার রেললাইন দখল করে বসে। প্রতিদিন প্রতি মূহর্তে এভাবে চলে তাদের লুকোচুরি খেলা। কুড়িল বিশ্বরোড থেকে কাওলা বিমানবন্দর রেলস্টেশন হয়ে আব্দুল্লাহপুর টঙ্গীব্রীজ পর্যন্ত এসব এলাকায় রেলওয়ের জমি দখল করে রেললাইনের দুই পাশে অবৈধ ভাবে গড়ে উঠা দোকানপাট,ভাসমান খাবার হোটেল রেস্তোরাঁ,চায়ের দোকান, ভাংগারি দোকান,কাঠ বাঁশের ব্যবসা, কাপড়ের দোকান ও মার্কেট, ফার্নিচারের দোকান,রিক্সা ও অটোরিকশার গেরেজ,গোডাউন ও বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে চলছে নিরব চাঁদাবাজি।
চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ ও ভাংগারি দোকানে চোরাইমাল কেনা বেচাকে কেন্দ্র করে প্রতিনিয়ত এসব এলাকায় মারা মারি ও হামলা মামলার ঘটনাও ঘটছে অহরহ। সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, কুড়িল বিশ্বরোড থেকে উত্তরা আব্দুল্লাহপুর এলাকার প্রায় ৫ কিলোমিটার রেল সড়কের ৫টি অনুমোদিত রেলক্রসিং ছাড়াও আরো প্রায় ৫টি অন- অনুমোদিত রেলক্রসিং রয়েছে। অনুমোদিত ৫টি রেলক্রসিং-এর গেইট ব্যারিয়ার গুলো প্রায়ই নষ্ট থাকে।মাঝে মাঝে এসব ব্যারিয়ারের এক অংশ কাজ করলেও অন্য অংশ অকেজো থাকার কারণে গেইট থাকে উম্মুক্ত।
এসব গেইট ব্যারিয়ার কাজ না করার কারণ জানতে চাইলে,আজমপুর এলাকার গেটম্যান সাইফুল ইসলাম বলেন, এগুলো অনেক পুরনো গেইট,চেইন ও মেশিন ঠিক মতো কাজ করে না, এটি ঘুরাতে অনেক শক্তি লাগে। মাঝে মাঝেই মেশিন জ্যাম হয়ে যায়, অফিসকে জানালেও সময় মতো টেকনিশিয়ান আসে না।আব্দুল্লাহপুর এলাকার গেইট ম্যান আব্দুস ছামাদ বলেন, এখানে দুই পাশে চারটি গেইট ব্যারিয়ার রয়েছে, ট্রেনের চাপে সারাক্ষণ গেইট উঠা নামা করতে করতে মাঝে মাঝে এগুলো নষ্ট হয়ে যায়। বিষয় গুলো অফিসে জানালেও তারা ব্যবস্থা নেয় না।
উত্তরা এলাকায় অরক্ষিত রেলক্রসিং এর গেইট ব্যারিয়ার রক্ষণাবেক্ষণ কাজে তদারকির অভাব বিষয়ে কারণ জানতে চাইলে, বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) মোঃ আরিফুজ্জামান বলেন,গেইট ব্যারিয়ার নষ্ট হলে সেফটি আইনে ঐদিনই ঠিক করতে হবে,কোন কারণে ঐ দিন ঠিক করতে না পারলে পরের দিন অবশ্যয়ই ঠিক করতে হবে। এ বিষয়ে খবর পেলে আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিবো। গেটম্যান ও টেকনিশিয়ানদের দায়িত্বে অবহেলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, উত্তরা এলাকায় অনুমোদিত রেলক্রসিং-এ দায়িত্বরত কোন গেইট ম্যান ও টেকনিশিয়ানের দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ পেলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে আইনগত কঠোর ব্যবস্থা নিবো। প্রয়োজনে তাদেরকে চাকুরীচ্যুত করা হবে।তাদেরকে মনিটরিং করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন,গেইন ম্যানদের তদারকির জন্য ইনস্পেক্টর রয়েছে। তবে এসময় রেলক্রসিং গুলোতে গিয়ে কথা বলার জন্য কোন ইনস্পেক্টরের দেখা পাওয়া যায় নি।
সরেজমিনে দেখা যায়,প্রতিদিন বিকাল হলেই হাজার হাজার মানুষ উত্তরা কাওলা এলাকা, বিমানবন্দর এলাকা,কসাইবাড়ী, আজমপুর,হাজী বাড়ি, জয়নাল মার্কেট, ৮ নং সেক্টর রেললাইন ও আব্দুল্লাহপুর রেলক্রসিং দিয়ে চলাচল করে। এছাড়াও বিকাল হলেই এখানকার রেললাইনের উপর হাজার হাজার মানুষকে বসে থাকতেও দেখা যায়।এদের মধ্যে অনেকেই কানে হেডফোন লাগিয়ে বসে বসে মোবাইলে গান শুনে, কাথা বলে,আবার একাধিক গ্রুপে অনেকে মোবাইল ফোনে লুডু খেলে,বসে বসে গেইমস খেলে ও আড্ডা মারে।স্থানীয় সুত্রে জানা যায়, পথচারীদের
অসাবধানতার কারণেই রেললাইন এলাকায় প্রতিনিয়ত ঘটছে দূর্ঘটনা।একাধিক সুত্রে জানা যায়, গত ২৩ শে জুলাই ২০২৪ ইং তারিখ কুড়িল বিশ্ব রোড এলাকায় রেললাইনে হাঁটতে গিয়ে বলাকা কমিউটার ট্রেনের ধাক্কায় তানজিম জয় নামের এক শিক্ষার্থী নিহত হয়। একই দিনে কানে হেড ফোন লাগিয়ে কাওলা এলাকায় রেললাইন পারাপারের সময় একতা এক্সপ্রেসের ধাক্কা মারা যায়।২৬ মার্চ ২০২৩ সালে ভোর ৫ টায় ফজরের নামাজ শেষে আজমপুর ফরিদ মার্কেট এলাকায় রেললাইন ধরে হাঁটার সময় নওয়াব হাবিবউল্লাহ মডেল স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষার্থী আহম্মেদ সানী হানিফ ট্রেনের ধাক্কায় মারা যায়।
১৮ই ডিসেম্বর ২০২৩ইং তারিখ মোবাইলে কথা বলতে বলতে আজমপুর রেললাইন পার হতে গিয়ে ব্রাহ্মপুত্র এক্সপ্রেস ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে সজীব নামের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়।
আপনার মতামত লিখুন :