ঢাকা রবিবার, ২৩ মার্চ, ২০২৫

রাজধানীর ফুটপাতে চাঁদাবাজির শূন্যস্থান পূরণ করল কারা?

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: মার্চ ২২, ২০২৫, ০৮:৩৮ পিএম
রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন সড়ক ও ফুটপাত দখল করে ব্যবসা করছেন হকাররা- ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীর ফুটপাত দখলমুক্ত নিয়ে ষোলবছরই লুকোচুরি খেলেছিল পতিত আওয়ামী লীগ। বিভিন্ন সময় চালিয়ে ছিল আইওয়াশের অভিযান। এতে দখলমুক্ত তো হয়নি, উল্টো প্রতিনিয়তই সম্প্রসারিত হয়েছিল ফুটপাত দখল। এতে চাঁদাবাজিও ছিল রমরমা।

সদরঘাট থেকে গাবতলী। গুলিস্তান কিংবা যাত্রাবাড়ি। ফার্মগেট, নিউ মার্কেট সবত্রই ছিল দখল চাঁদাবাজির রাজত্ব। এসব থেকে উঠতো হাজার হাজার কোটি টাকা। আর এসব টাকা ভাগাভাগি হতো আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও তাদের সন্ত্রাসীদের মধ্যে। একটা অংশ যেত পুলিশের পকেটেও। মূলত এ কারণেই ফুটপাত দখল মুক্ত নিয়ে লুকোচুরি খেলেছিল ততকালীন সরকার।

২০১৬ সালে একটি বেসকারি সংস্থার গবেষণা দেখা যায়, রাজধানীতে হকার প্রতিদিন ৫০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হতো। প্রতিবছর চাঁদাবাজিদের পকেটে ঢুকতো প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা।

কিন্তু গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। এতে দলটির নেতাকর্মী ও সন্ত্রাসীরা গা ঢাকা দিয়েছেন।

অথচ রাজধানীর ফুটপাত দখল ও চাঁদাবাজি সেই আগের মতোই চলছে। কোন কোন ক্ষেত্রে আগের চেয়েও বেড়েছে দখল-চাঁদাবাজির আওতা।

ফলে প্রশ্ন উঠছে তাহলে চাঁদাবাজির শূন্যস্থান পূরণ করল কারা?

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগের চাঁদাবাজরা অন্তরালে চলে গেলে তাদের জায়গা কিছু সন্ত্রাসীর আর্বিভাব ঘটেছে। আর এদের শেলটার দিচ্ছেন বিএনপি ও দলটির অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীরা।

তবে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে তাদের অনেকের সঙ্গেই কথা বলা সম্ভব হয়নি। কারও কারও সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হলে তারা সেটি অস্বীকার করেছেন।

ফুটপাত দখল ও চাঁদাবাজির অন্যতম ক্ষেত্র নিউমার্কেট এলাকা। যেখানে ৭ থেকে ৮ হাজার দোকান রয়েছে ফুটপাতে। এসব দোকানপাট নিউমার্কেট, গাউছিয়া, নীলক্ষেত ছাড়াও আজিমপুর, সায়েন্স ল্যাব, এলিফ্যান্ট রোড, কাঁটাবন এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে।

আর পুরো এলাকার নিয়ন্ত্রণ চলে এক চক্রের হাতে। এতোদিন আওয়ামী লীগের ইব্রাহিম ইবু, নুর ইসলাম, সাত্তার মোল্লা, মনির, সৈয়দুর চৈয়্যা ও কালা সিরাজের চক্রে ছিল এলাকাটি।

কিন্তু সরকার পতনের পর কারাগার থেকে বেরিয়ে এসব এলাকার নিজের কবজায় নিয়ে নেন শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমন।

শুধু চাঁদার নিয়ন্ত্রণই নয়, নতুনের বাইরে পুরনো হকাদের কাছ থেকেও নতুন করে এককালীন টাকাও তুলছে। এককালীন টাকা না দিয়ে উঠিয়ে দেওয়ার হুঁমকিও দিচ্ছেন ইমনের সাঙ্গপাঙ্গরা।

অভিযোগ উঠেছে সন্ত্রাসী ইমনের অধীনে চাঁদাবাজির কাজ করছেন নিউমার্কেট থানা যুবদল সভাপতি নিজাম বেপারি, সাধারণ সম্পাদক কে এম চঞ্চল, ঢাকা কলেজ ছাত্রদল আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সাগর, তারেক জামিল, পারভেজসহ স্থানীয় বিএনপির বিভিন্ন নেতা।

রাজধানীর ফুটপাতের চাঁদাবাজির আরেক বড় ক্ষেত্র গুলিস্তান। আগে গোলাপ শাহ মাজারের সামনে থেকে ফুলবাড়িয়া এবং  বঙ্গবাজার থেকে সিটি প্লাজা হয়ে গোলাপ শাহ মাজার পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ যুবলীগের হান্নানের হাতে থাকলেও এখন ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ২০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আবু সুফিয়ানের অধীনে।

একইভাবে গুলিস্তানের আশপাশ এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টের নিয়ন্ত্রণও হাতবদল হয়েছে। নতুন চাঁদাবাজদের তালিকায় নাম আসছে  কাপ্তানবাজার ইউনিট বিএনপির সভাপতি নুর ইসলাম, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ ইউনিট বিএনপির সভাপতি সেলিম, বিএনপি নেতা নবী, খোরশেদ ও সেলিম।

এদের বাইরে ছিন্নমূল হকার্স লীগের সভাপতি হারুনুর রশিদ, খলিল, পোটন, জিয়া এবং  হকার সংগ্রাম পরিষদের কামাল সিদ্দিকী, ওয়ার্কার্স পার্টির ঢাকা মহানগরীর সভাপতি আবুল হোসাইনের নাম এসেছে চাঁদাবাজির তালিকায়।

ফার্মগেটের নিয়ন্ত্রণ আওয়ামী লীগের সাবেক কাউন্সিলর ফরিদুর রহমান খান ইরান থেকে এখন সাবেক কাউন্সিলর ও ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সমন্বয়ক আনোয়ারুজ্জামান আনোয়ার ও  শীর্ষ সন্ত্রাসী সুইডেন আসলামের অধীনে চলছে।

মতিঝিল এলাকার চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ এখন শীর্ষ সন্ত্রাসী নাসির উদ্দিন ওরফে ফেন্সি নাসিরের নিয়ন্ত্রণে। এখানকার চাঁদাবাজির সঙ্গে শ্রমিক দল নেতা সবুজের নামও উঠে এসেছে।

 

এছাড়াও মিরপুর ১০ নম্বর এলাকায় চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ করছেন বিএনপি নেতা তারেক ও বাদশা।  সদরঘাট এলাকায়ও চাঁদাবাজির সঙ্গে স্থানীয় বিএনপি ও দলটির সহযোগী সংগঠনের নেতাদের নাম আসছে।

সেই সঙ্গে উত্তরা, মহাখালী, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী এলাকার চাঁদাবাজির চিত্রও সেই আগের মতোই। এসব এলাকায়ও  বিভিন্ন সন্ত্রাসীরা বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাদের ছত্রছাড়ায় চাঁদাবাজি করছে বলে তথ্য আসছে।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ও মহানগর পুলিশ সূত্র জানায়, তারা শিগগিরই এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

ফুটপাত দখলের বিষয়ে সম্প্রতি (১৫ মার্চ) ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ সাংবাদিকদের বলেন, ‘ঈদের পরে আমরা অভিযান পরিচালনা করবো।’

যদিও অনেকেই বলছেন, সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে শুধু কঠোর ব্যবস্থার আশ্বাসই এসে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। বরং ফুটপাত দখল দিনদিন বাড়ছেই। এরসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নগরবাসীর ভুগান্তিও।