রাজধানীর উত্তরার ৪৭নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোতালেব মিয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ছাত্রদের দাবানোর জন্য প্রকাশ্যে শটগান নিয়ে বের হয়েছিলেন রাজপথে, এমনটাই মন্তব্য তার নিজ এলাকার বাসিন্দাদের। বিলাসবহুল মাইক্রোতে করে তার পালিত কয়েকজন সন্ত্রাসী শটগান নিয়ে রাজপথে ছিল, এমনটা মন্তব্য করেন তার নিজ বাড়ির পাশে চায়ের দোকানদার কামরুল হাসান।
ট্রান্সমিটার মোড়ে বসবাসকারী নাজমুল ইসলাম বলেন, মোতালেবের ছেলে হেলাল ডিশ ব্যবসা, ইন্টারনেট ব্যবসা, অটোর চাঁদা তোলা, ময়লার চাঁদা তোলা, রাজউকের অনুমতি ছাড়া নিজ ক্ষমতায় বিভিন্ন মানুষের বিল্ডিং নির্মাণের অনুমতি দিয়ে দেওয়া, যেকোনো সামাজিক বিচারে একতরফা করে ফেলা ইত্যাদি এমন কোনো অপরাধ নেই যা করেননি।
মোতালেবের ছেলের বন্ধু আলামিনের ছয়তলা বাড়ির কোনো কাগজপত্রের অস্তিত্ব নেই। অনুমতি ছাড়াই কাউন্সিলর মোতালেবের দাপটে চালাচ্ছেন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি।
এ বিষয়ে রাজউকের সাথে কথা বললে রাজউকের ইন্সপেক্টর মেহেদী বলেন, এ বিষয়ে আমরা অবগত হয়েছি এবং তাকে নোটিশ পাঠিয়েছি স্বল্প সময়ের মধ্যে আমাদের অফিসে সব কাগজপত্র নিয়ে হাজির হওয়ার জন্য।
এই কাউন্সিলর মোতালেবের শুধুমাত্র নাম লেখার অভিজ্ঞতা আছে, যার কারণে একেক সনদে একেক রকম স্বাক্ষর তিনি দিতেন। তাই সাধারণ মানুষ পড়ত স্বাক্ষরের বিড়ম্বনায়।
আয়কর নথির তথ্য অনুযায়ী ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৪৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোতালেব মিয়ার নিজের কোনো জমি নেই। আব্দুল্লাহপুরে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) জায়গায় গড়ে তুলেছিল মাছের আড়ত। সেখানে ২৮০টি দোকান রয়েছে তার, যা থেকে মাসে ভাড়া আদায় করতেন ৩৫ লাখ ২৮ হাজার টাকা। এসব দোকানের পজিশন দেওয়ার সময় এককালীন ৫০ হাজার করে নিয়েছেন এক কোটি ৪০ লাখ টাকা। যারা বিটের পজিশন নিয়েছেন, তারা জামানত হিসেবে তিন থেকে পাঁচ লাখ করে প্রায় ১০ কোটি টাকা দিয়েছেন। গত ৫ মে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত অভিযোগে এসব তথ্য তুলে ধরেছেন স্থানীয় এক বাসিন্দা।
অভিযোগে বলা হয়েছে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গায় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোতালেব মিয়া রাজধানীর আব্দুল্লাহপুরে মাছের আড়তে পাঁচ থেকে সাত ফুট আয়তনের একটি পজিশনকে বিট হিসেবে ভাড়া দিয়েছেন। পুরো আড়তে ২৮০টি বিট হয়েছে। এসব বিট থেকে ৪২০ টাকা করে প্রতিদিন এক লাখ ১৭ হাজার ৬০০ টাকা আদায় করতেন। এ ছাড়া মাছের আড়তের পশ্চিম পাশে বেড়িবাঁধে গড়ে তুলেছেন রেস্টুরেন্ট, ফল ও কাঁচাবাজার। সেখানের প্রতিটি দোকান থেকে দৈনিক ৪০০ টাকা করে ভাড়া নেন। এ ছাড়া উত্তর ও দক্ষিণখান ওয়ার্ডের বর্জ্য-বাণিজ্য করে মাসে দুই লাখ টাকা আয় করেন। যার কিছুই উল্লেখ নেই আয়কর নথিতে। এটি অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানান অভিযোগকারী।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পাউবোর ঢাকা বিভাগ-২-এর প্রকৌশলী মোবারক হোসেন বলেন, সড়কের পাশে যেসব জায়গা, সবই পানি উন্নয়ন বোর্ডের। নদীর পাড়ের কিছু জায়গা ব্যক্তি মালিকানাধীন থাকলে থাকতে পারে। যেখানে আড়ত নির্মাণ করা হয়েছে, সেটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গা। তাদের উচ্ছেদ করতে ঢাকা জেলা প্রশাসনের কাছে ম্যাজিস্ট্রেট চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেট পাওয়া গেলেই অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ শুরু করা হবে।
কাউন্সিলর মোতালেব মিয়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) জোন-৯-এর ১৯৭ সার্কেলের একজন করদাতা। তার আয়কর রিটার্নের তথ্য বলছে, তিনি দক্ষিণখানের উত্তর ফায়দাবাদের ৩২ নম্বর হোল্ডিংয়ের একজন বাসিন্দা। তিনি পৈতৃক সূত্রে পাওয়া বাড়িতে থাকেন। তার নিজের কোনো জমি, প্লট, ফ্ল্যাট কিছুই নেই। তিনি ব্যবসা থেকে বছরে দুই লাখ ৬০ হাজার টাকা আয় করেন। তার নগদ ১০ লাখ ৮০ হাজার টাকা, একটি টিভি ও একটি ফ্রিজ রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাউবোর এই জায়গা আবদুল্লাহপুর মৎস্য ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি মার্কেটের ব্যানারে দখল করেছেন ঢাকা উত্তর সিটির ৪৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোতালেব মিয়া। তবে জায়গাটি নিজের বলে দাবি করতেন তিনি।
‘ভাই ভাই মৎস্য আড়ত’-এর মালিক জসিম হোসেন জানান, এ মার্কেটে তার দুটি বিট। প্রথম বিট নিতে জামানত দিয়েছেন সাড়ে তিন লাখ ও দ্বিতীয় বিট নিতে পাঁচ লাখ টাকা। এ ছাড়া দুটি ক্ষেত্রেই এককালীন দিয়েছেন ৫০ হাজার টাকা করে। দৈনিক বিটপ্রতি ৪২০ টাকা ভাড়া দিতে হতো বলে জানান তিনি।
স্থানীয়রা জানান, উত্তরখান ও দক্ষিণখান এলাকায় প্রায় পাঁচ হাজার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলে। এগুলোর মৌখিক লাইসেন্স দেন কাউন্সিলর মোতালেব মিয়া। তার কাছের লোক স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা ফারুক হোসেন প্রতিদিন অটোরিকশাপ্রতি ১৫০ টাকা আদায় করত। আর মিনি অটো থেকে সপ্তাহে ৬৪০ টাকা করে চাঁদা তুলতেন আরেক স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা জামাল হাসান।
এসব অভিযোগের বিষয়ে মোতালেবের সাথে যোগাযোগ করতে চাইলে, তার ব্যবহার করা গ্রামীণ নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া যায়। তার বর্তমান অবস্থান ও তার ছেলেদের কোনো সন্ধান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, এমনটা নিশ্চিত করেছে দক্ষিণখান থানা পুলিশ।
ওসি দক্ষিণখান মোহাম্মদ তাইফুর রহমান মির্জা বলেন, কাউন্সিলর মোতালেব আমার এলাকার বাসিন্দা, আমরা সোর্সের মাধ্যমে তাকে ট্র্যাক করার অনেক চেষ্টা করেছি। সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে সে দেশের বাইরে, আমরা বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখছি।
আপনার মতামত লিখুন :