ঢাকা রবিবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

কারওয়ান বাজারে কাঁচামালের আড়ত দখলের চেষ্টা

রূপালী প্রতিবেদক

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২১, ২০২৪, ০৯:২৫ পিএম

কারওয়ান বাজারে কাঁচামালের আড়ত দখলের চেষ্টা

মেসার্স বিসমিল্লাহ বাণিজ্যালয়। ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ঢাকা: ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর কারওয়ান বাজারের নিয়মিত চাঁদাবাজ আর দখলদারেরা উধাও হলেও স্বস্তিতে নেই আড়তের মালিক ও ব্যবসায়ীরা। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের ধাক্কায় কেবল চেহারায় বদল ঘটেছে, বন্ধ হয়নি চাঁদাবাজি আর দখলবাজি। তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি রাজধানীর কারওয়ান বাজারের ১ নম্বর আড়ত ভবনের নিচতলায় ২১ নম্বর ‘মেসার্স বিসমিল্লাহ বাণিজ্যালয়’ নামে কাঁচামালের আড়তটি দখলের চেষ্টা চালাচ্ছে একটি চক্র।

চক্রটির সঙ্গে আড়তের ভাড়াটিয়ার যোগসাজশ রয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আড়তের ভাড়া মালিককে না দিয়ে দুর্বৃত্তদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে ভাড়াটিয়া আরিফ। ভাড়া না দেওয়ার জন্য ভাড়াটিয়া সাজিয়েছেন হুমকির নাটক।

এ ঘটনায় ভুক্তভোগী থানায় একটি অভিযোগ করলেও এখনো কোনো সুরাহা হয়নি। ফলে আতঙ্কে রয়েছে ভুক্তভোগী পরিবারটি। দুর্বৃত্তদের হাত থেকে বাঁচতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তারা।

অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিএনপির পরিচয়ধারী লুৎফর রহমান ওরফে এল রহমান ও তার সহযোগীরা কারওয়ান বাজারের বেশকিছু আড়ত দখলে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। এ ছাড়া কারওয়ান বাজারের চাঁদাবাজির বড় একটি অংশ নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে চক্রটি।

কারওয়ান বাজারের একটি সূত্র জানায়, মেসার্স বিসমিল্লাহ বাণিজ্যালয় নামে কাঁচামালের ওই আড়তের মালিক বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. শাহাদাত হোসেন মানিক। তার কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে দীর্ঘদিন কাঁচামালের ব্যবসা করছেন আরিফ হোসেন নামে এক ব্যক্তি। কিন্তু সম্প্রতি লুৎফর রহমানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভাড়া দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন ভাড়াটিয়া আরিফ হোসেন। আরিফ শাহাদাত হোসেনকে জানিয়েছেন, তাকে মোবাইল ফোনে হুমকি দিয়ে আড়তের ভাড়া নিতে নিষেধ করা হয়েছে। তাই তিনি ভাড়া দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন।

অভিযোগ রয়েছে, ওই দোকানের সামনে কাউকে ভিড়তে দেওয়া হচ্ছে না। প্রতিদিন লুৎফুর রহমান ওরফে এল রহমান  গ্রুপের ৩০ থেকে ৪০ জন সন্ত্রাসী আড়তের চারপাশে নজরদারি করছে। এ ছাড়া আড়তের নাম ও মালিকের নাম মুছে ফেলার জন্যও হুমকি দিচ্ছে। এ ঘটনায় গত ২৭ আগস্ট তেজগাঁও থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন দোকান মালিক মো. শাহাদাত হোসেন মানিক। তবে পুলিশ নীরব ভূমিকা পালন করছে বলে দাবি ভুক্তভোগীর।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) অধীন কারওয়ান বাজারের কাঁচামালের ৪০০ বর্গফুটের ২১ নম্বর আড়তটির একটি অংশ, অর্থাৎ ২০০ বর্গফুট ২০০৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি দেলোয়ার হোসেন মোল্লার কাছ থেকে কিনে নেন শাহাদাত হোসেন মানিক। ওই সময় এর দলিলও শাহাদাতকে হস্তান্তর করেন দেলোয়ার। এরপর থেকে ওই দোকান ভাড়া দেন মালিক শাহাদাত। পরবর্তী সময়ে দেলোয়ার হোসেন ওই দলিল অস্বীকার করেন, যার কারণে সিটি করপোরেশন শাহাদাতের নামে নামজারি করেনি। তখন ভুক্তভোগী শাহাদাত হোসেন দেওয়ানি মামলা ও সিভিল রিভিশন দায়ের করেন। এরপর মামলা তুলে নিতে শাহাদাতকে চিঠি দেয় সিটি করপোরেশন।

পাশাপাশি বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য ডিএনসিসি সচিবকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কারওরান বাজার ২১ নম্বর আড়ত ঘরটির প্রকৃত স্বত্ব ও ন্যায়সঙ্গতভাবে কোন পক্ষের অনুকূলে প্রতিষ্ঠিত হবে, সে বিষয়ে সরেজমিনে তদন্ত করে আনুষঙ্গিক তথ্যাদির ভিত্তিতে সুস্পষ্ট মতামতসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয় কমিটিকে। এরপর অধিকতর তদন্ত শেষে সিটি করপোরেশন খরিদ সূত্রে ২১ নম্বর দোকানের অর্ধেকের (২০০ বর্গফুট) মালিক শাহাদাত হোসেন মানিক এবং বাকি অর্ধেকের (২০০ বর্গফুট) মালিক আবুল খায়ের বলে ঘোষণা দেয়। এরপর থেকেই ২১ নম্বর দোকানের অর্ধেক, অর্থাৎ মেসার্স বিসমিল্লাহ বাণিজ্যালয় বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাত হোসেনের নামে নামজারি করে সিটি করপোরেশন।

সিটি করপোরেশনের তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অধীন কারওয়ান বাজার কাঁচামালের আড়ত মার্কেটটিতে অবস্থিত ৪০০ বর্গফুট আয়তনের ২১ নম্বর আড়তটি ১৯৯৩ সালের ১৮ জুন আবদুল কুদ্দুস নামে এক ব্যক্তিকে দখলস্বত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয়। তিনি অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের সঙ্গে চুক্তিপত্রে আবদ্ধ হন। পরে ২০০৫ সালের ৮ ডিসেম্বর আবদুল কুদ্দুস ৪০০ বর্গফুট আড়ত ঘরটি ২০০ বর্গফুট করে লুৎফর রহমান ও দেলোয়ার হোসেন মোল্লার কাছে বিক্রি করেন, যা ২০০৬ সালের ২৩ মার্চ দুজনের নামে সমানভাবে ২০০ বর্গফুট করে নামজারি করা হয়। কিন্তু ওই বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি দেলোয়ার দলিল সূত্রে তার অংশের ২০০ বর্গফুট বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাত হোসেন মানিকের কাছে বিক্রি করেন। পরে সেই দলিল অস্বীকার করেন দেলোয়ার, যার কারণে সিটি করপোরেশন শাহাদাত হোসেনের নামে নামজারি সম্পাদন করেনি। নিজের নামে নামজারি না হওয়ায় দেওয়ানি মামলা ও সিভিল রিভিশন দায়ের করেন শাহাদাত হোসেন, যার দেওয়ানি মামলা নম্বর ৩১৫/০৮ ও সিভিল রিভিশন নম্বর ৮৮/৮। পরে সিভিল রিভিশন মামলা খারিজ হয় এবং দেওয়ানি মামলায় শাহাদাত হোসেন মানিকের পক্ষে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশ হয়।

এদিকে নামজারি সূত্রে ২০০ বর্গফুটের মালিক দেলোয়ার হোসেন মোল্লা ২০১০ সালের ৭ আগস্ট অপর নামজারির প্রাপক লুৎফর রহমানসহ ষোলোআনা, অর্থাৎ ৪০০ বর্গফুট দলিলমূলে আব্দুল খায়েরের কাছে দখলিস্বত্ব হস্তান্তর করেন, যা ২০১২ সালের ৩ জানুয়ারি তার নামে নামজারি করা হয়।

বিষয়টি নিয়ে সিটি করপোরেশন কয়েক দফায় দুই পক্ষকে নিয়ে বৈঠকে বসেছে এবং উভয় পক্ষের বক্তব্য ও সাক্ষ্য-প্রমাণ ও কাগজপত্র পর্যালোচনা করেছে। সিটি করপোরেশনের তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শাহাদাত হোসেন মানিক ২০০ বর্গফুট দোকানের মালিক।

অপরদিকে আবুল খায়ের ৪০০ বর্গফুট ক্রয় করলেও তার দলিলের পূর্বে শাহাদাত হোসেন মানিকের দলিলটি সম্পাদিত হয়। ৩১৫/০৮ নম্বর দেওয়ানি মামলায় শাহাদত হোসেন মানিকের পক্ষে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। গত ২০০৫ সালের ৮ ডিসেম্বর ক্রয়সূত্রে মালিক দেলোয়ার হোসেন মোল্লা তার অংশীয় ২০০ বর্গফুট দোকান শাহাদত হোসেন মানিকের কাছে বিক্রি করেন এবং তার নামে নামজারির আবেদন করার পরও পুনরায় খায়েরের কাছে ২০১০ সালের ৭ আগস্ট বিক্রি করেন।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দেলোয়ার হোসেনের সব স্বাক্ষর একই বলে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হওয়ায় খরিদসূত্রে দোকানের অর্ধেক ২০০ বর্গফুটের মালিক শাহাদাত হোসেন মানিক এবং বাকি অর্ধেকের (২০০ বর্গফুট) মালিক আবুল খায়ের। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২০১৩ সালের ২৮ মে ৪৬.২০৭.০০৩.১০.১১.১৩৫৭.২০১১.৫৩৭ স্মারকের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ওই তদন্ত করা হয় বলে জানা যায়।

ভুক্তভোগী বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাত হোসেন মানিক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমি বিএনপির চাঁদপুর জেলার প্রতিষ্ঠাকালীন মেম্বার। বর্তমানে বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পরপরই লুৎফর রহমান আমার ভাড়াটিয়াকে দোকানের ভাড়া আমাকে দিতে নিষেধ করে তাকে হুমকি-ধমকি দেয়। এরপর থেকে আমার ভাড়াটিয়া আরিফ ভয়ে ভাড়া দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে আমার আড়তের ভাড়াটিয়া হিসেবে আছেন আরিফ। সম্প্রতি নতুন করে আবার দুই বছর ছয় মাস মেয়াদের চুক্তিতে আরিফকে ওই আড়ত ঘর ভাড়া দেওয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে পুলিশে অভিযোগ করা হলেও কোনো ধরনের সুরাহা মেলেনি বলে অভিযোগ করেন ওই ভুক্তভোগী।’

জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কারওয়ান বাজারের মাঠপর্যায়ে চাঁদাবাজির বড় একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করা হতো কিচেন মার্কেটের ছাদের ওপর ঢাকা মহানগর উত্তর ২৬ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক লোকমান হোসেনের কার্যালয় এবং শ্রমিক লীগের সভাপতি আবুল কাশেমের কার্যালয় থেকে। কারওয়ান বাজারের চাঁদাবাজির অন্যতম নিয়ন্ত্রক ছিলেন লোকমান হোসেন। এই লোকমান ও কাশেম পালানোর পর এ দুটি অফিস নিয়ন্ত্রণে নেন বেলাল হোসেন নামে এক ব্যক্তি। আগে মাছবাজারের চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করা হতো জাতীয় শ্রমিক লীগ তেজগাঁও থানার কার্যকরী সম্পাদক ও থানা আওয়ামী লীগের ক্রীড়া সম্পাদক মোশারফ হোসেনের কার্যালয় থেকে। এই সিন্ডিকেট এখন জালাল মোল্লা, জসিম ও অপুর ভাগিনার দখলে। এ ছাড়া আজিজুর রহমান, মুসা, বাবু, মাসুদও দখলে রেখেছেন একাধিক খাত। তাদের শেল্টার দিচ্ছেন আনোয়ার ও এল রহমান ওরফে লুৎফর রহমান।

এ বিষয়ে অভিযুক্ত লুৎফর রহমান বলেন, ‘আমি কোনো দখল বা চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত না। আমার বিরুদ্ধে আড়ত দখলের অভিযোগ মিথ্যা। দরকার হলে আপনারা ঘটনাস্থলে এসে তদন্ত করে দেখেন। আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পাওয়া যাবে না।’

তেজগাঁও থানায় করা অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা কারওয়ান বাজার পুলিশ ফাঁড়ির উপ-পরিদর্শক (এসআই) সাইমুম আহমেদ বলেন, ‘জমিসংক্রান্ত বিষয়ে পুলিশের কোনো কিছু করার নেই। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনে সঙ্গে সঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থানে এমন কিছু ঘটনা ঘটছে। তাই আমরা চেষ্টা করেছিলাম দুপক্ষকে বসিয়ে একটা সমাধানের চেষ্টা করার। কিন্তু আমরা তো তাদের প্রেশার দিতে পারি না। তার পরেও যেহেতু একটা অভিযোগ এসেছে, আমরা চেষ্টা করছি সমাধান করার। তাদের বলেছি, কোনো সমাধানে যেতে না পারলে আপনাদের কোর্টের আশ্রয় নিতে হবে।’  

তিনি বলেন, ভুক্তভোগীরা থানায় অভিযোগের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর কাছেও একটি অভিযোগ করেছেন।

আরবি/ এইচএম

Link copied!