ঢাকা শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৪

ভাতের হোটেল থেকে কাউন্সিলর যুবরাজ

তরিক শিবলী

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৭, ২০২৪, ১২:৫৮ এএম

ভাতের হোটেল থেকে কাউন্সিলর যুবরাজ

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

জাহাঙ্গীর হোসেন যুবরাজ ঢাকা মহানগর উত্তর সিটির ৫৪নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর। এয়ারপোর্টের সামনে ভাতের হোটেলের মালিকের ছেলে এই যুবরাজ। পরবর্তী সময়ে যুবরাজ অনেক কষ্ট করে শাওমি মোবাইল বিক্রির ব্যবসা শুরু করেন। সব কিছু ছাপিয়ে এখন হাজার কোটি টাকার মালিক এই কাউন্সিলর।

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি হাবিব হাসানের সহচর হিসেবে নিয়মিত কাজ করেছেন এই কাউন্সিলর। প্রতিবছর বঙ্গবন্ধুর জন্ম উৎসব উপলক্ষে তার নিজ বাসভবনের ছাদে ২০ লাখ টাকা খরচ করে বাজি ফুটিয়ে উৎসব-উদ্দীপনা পালন করেছেন। তুরাগ নদীর পাশে মাঝিঘাট থেকে নৌকা পারাপার এবং প্রতি নৌকা থেকে চাঁদা নিয়ে মাসে লাখ লাখ টাকা আয় করছেন এই কাউন্সিলর যুবরাজ।

তার ছেলে লিয়ন খান ও ভাই মো. মিঠু ঢাকা উত্তর সিটির করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডের একচ্ছত্র অধিপতি। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের আগ পর্যন্ত এই বাবা-ছেলে ছিলেন ঢাকা মহনগর উত্তরের কিং। দলের পদবাণিজ্য, মাদককারবার, জমি দখল, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্ম নিয়ন্ত্রণ করতেন তারা। তাদের দোর্দণ্ড প্রতাপের কাছে একেবারে অসহায় ছিল এলাকাবাসী।

সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, অনেক প্রভাবশালী নেতা, ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মকর্তাও ছিলেন অসহায়। পরিস্থিতি এমন ছিল, যেন তাদের কথা ছাড়া মহানগর উত্তরের একটি গাছের পাতাও নড়ত না।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দলের অন্য নেতাদের মতো গাঢাকা দিয়েছেন জাহাঙ্গীর হোসেন যুবরাজ, ছেলে লিয়ন খান ও ভাই মো. মিঠু। তারা দেশে, নাকি বিদেশে পালিয়েছেন সে বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেননি ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগ ও তার আত্মীয়-স্বজনরাও।

ওয়ার্ড ও ইউনিট আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পদবাণিজ্যের মাধ্যমে জাহাঙ্গীর হোসেন যুবরাজ ও তার ছেলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এমন অভিযোগ থাকার পরও জাহাঙ্গীর হোসেন যুবরাজের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। উপরন্তু তার এ পদবাণিজ্যে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও কয়েকজন সিনিয়র নেতার সহযোগিতা করার অভিযোগ রয়েছে। ফলে বাবা-ছেলে অপকর্মে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।

এ ছাড়া সিটি করপোরেশনের আওতায় টেন্ডারবাজি, ফুটপাত থেকে শুরু করে নানা ধরনের চাঁদাবাজি, জমি দখল, বাড়ি দখল, প্রতিপক্ষের ওপর আঘাত, সরকারি জায়গা দখল করে মার্কেট নির্মাণ, মাদক বিক্রিতে সহায়তা, সন্ত্রাসী লালনসহ বিভিন্ন অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ রয়েছে এ দুজনের বিরুদ্ধে।

এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে ময়লা সংগ্রহ বাবদ অবৈধ চাঁদা আদায়সহ মাসে লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গেও একাধিকবার বিরোধে জড়িয়েছেন তিনি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে রাজধানীর উত্তরায় আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্র হাতে রাস্তায় দেখা যায়। সেই সময়ের কিছু ছবি ও ভিডিও বিশ্লেষণ করে হামলাকারীদের কয়েকজনকে শনাক্ত করা গেছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন স্থানীয় ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর হোসেন যুবরাজ, তার ছেলে লিয়ন খান ও ভাই মো. মিঠু। বাকিরাও তাদের সহযোগী বলে জানা গেছে। তবে তাদের কাউকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।

ছাত্র-জনতার ওপর সশস্ত্র হামলার বেশ কিছু ছবি ও ভিডিও মোবাইল ফোনে ধারণ করেন এলাকাবাসী। এর মধ্যে গত ২ আগস্ট উত্তরা-১১ নম্বর সেক্টরের কিছু ছবিতে যুবরাজ, তার সহযোগী ও পরিবারের সদস্যদের দেখা যায়। তাদের ভালোভাবে চেনেন এমন কিছু মানুষ ছবি-ভিডিও দেখে শনাক্ত করতে এই প্রতিবেদককে সহায়তা করেছেন।

স্থানীয়রা জানান, সেদিন হেলমেট পরে হাতে অস্ত্র নিয়ে মাঠে নামেন সাবেক কাউন্সিলর যুবরাজ ও তার সহযোগীরা। দূর থেকে তোলা ছবিতে দেখা যায়, যুবরাজের গায়ে ছিল ছাইরঙা শার্ট। আরেক ভিডিওতে দেখা যায়, এক সহযোগীর হাত থেকে শটগান নিচ্ছেন তিনি। এরপর সেটি লোড করে বেপরোয়া গতিতে গুলি ছোড়েন। তার পাশে হেলমেট ও মাস্ক পরা আরও কয়েকজন ছিলেন। তার ভাই মিঠুর হাতে ছিল একটি শটগান। তিনি ছিলেন কালো গেঞ্জি পরা। মুখ ঢাকা না থাকায় তাকে বেশ ভালোভাবেই চেনা যায়। যুবরাজের ছেলে লিয়ন খানকে দেখা যায়, সাদা গেঞ্জি ও হেলমেট পরা। তার হাতেও ছিল শটগান। পাশেই দেখা যায় যুবরাজের আরেক ভাইকে, তবে তার নাম জানা যায়নি।

১১ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা সাগর আহমেদ  বলেন, ২ আগস্ট দুর্বৃত্তদের গুলিতে অন্তত দুজন মারা যান। পরে তাদের উদ্ধার করে স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়। এর বাইরে আরও কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। তারা বেঁচে আছেন কি না, তা জানার সুযোগ হয়নি।

উত্তরা-পশ্চিম থানার ওসি হাফিজুর রহমান বলেন, আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি ছোড়া ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। শিগগির তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে বলে আশা করছি।

এদিকে কাউন্সিলর যুবরাজ ও তার সহযোগীদের অস্ত্র হাতে ছবি দিয়ে পোস্টার ছাপিয়ে বিভিন্ন দেয়ালে সাঁটানোর ব্যবস্থা করেছেন এলাকাবাসী। তারা হত্যা ও হামলায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। উত্তরা কামারপাড়ায় তিনটি বিল্ডিংয়ের মালিক এই যুবরাজ।

প্রতিবছর কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে অবৈধভাবে সরকারি জায়গায় তৈরি করেন গরুর হাট। আশপাশের যত ট্রাক আছে সব ট্রাক তার সামনে ওরা জোর করে প্রবেশ করান তার হাটে। এই সংবাদ প্রকাশ করতে গিয়ে এক সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। উত্তরা পশ্চিম থানায় এ বিষয়ে অভিযোগ করা হয়, কিন্তু সেই সময় এই অভিযোগ কোনো আমলে নেয়নি তৎকালীন পুলিশ প্রশাসন।

আরবি/জেডআর

Link copied!