ঢাকা: শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিল সর্বস্তরের জনগণ। যেই স্বপ্নে থাকবে খাদ্য নিরাপত্তা, ন্যায্যমূল্যে পণ্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তা। কিন্তু, সিন্ডিকেট আর অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে এসব পণ্য।
বদলেছে সরকার তবে বদলায়নি বাজার সিন্ডিকেট। এখনো তাদের সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রাজধানীর সবচেয়ে বৃহত্তম পাইকারি আড়ত কারওয়ান বাজারে চলছে চাঁদাবাজি।
ঢাকা মহানগর যুবদল উত্তরের সদস্য সচিব সাজ্জাদুল মিরাজের মদদে তেজগাঁও থানা যুবদলের বহিষ্কৃত সদস্য সচিব আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে কারওয়ান বাজার কয়েকটি স্পটে ভাগ করে চাঁদা আদায় করা চলছে।
যুবদলের বিভিন্ন ইউনিটের নেতারা লাইনম্যান হিসেবে চাঁদা তুলছেন। রাত পোহালেই এই সিন্ডিকেটের পকেটে ঢুকছে অর্ধ কোটি টাকা। চাঁদা দিতে অস্বীকার করলেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধসহ ব্যবসায়ীদের শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলা-মামলায় গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ১০ হাজার থেকে শুরু করে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হচ্ছে বলেও জানান ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর নেতারা আত্মগোপনে চলে গেলে সরব হয় যুবদলের নেতারা। বর্তমানে তাদের নেতৃত্বেই কারওয়ান বাজারে চাঁদাবাজি চলছে। সেই সঙ্গে চাঁদার পরিমাণও বেড়েছে কয়েকগুণ। প্রকাশ্যে না হলেও তারা নীরবে চাঁদা তুলছে। চাঁদা বন্ধ হলে এবং নির্বিঘ্নে ব্যবসা করতে পারলে পণ্যের দাম কম থাকবে বলে জানান ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। তারা বাজারে চাঁদাবাজি বন্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নজরদারি বাড়ানোর অনুরোধ করেন।
সরেজমিন কারওয়ান বাজার ঘুরে ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে বেরিয়ে এসেছে চাঁদাবাজির এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য। কারওয়ান বাজারে প্রতিদিন অন্তত ৫ হাজার পাইকারের আনাগোনা রয়েছে। পণ্য কেনা, পরিবহনে লোড-আনলোড করা, ভ্যানগাড়িতে পণ্য নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই গুণতে নির্দিষ্ট পরিমাণের চাঁদা। শুধু তাই নয়, পণ্য কিনে ট্রাকে লোড করার জন্য একটি স্থানে সেগুলো রাখার জন্য চাঁদা দিতে হয়। চাঁদাবাজদের দাপটে ব্যবসায়ীরা অস্থির হলেও তাদের কাছে জিম্মি বলে নীরবে চাঁদা দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ফলে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও চাঁদাবাজরা তাদের রাজত্ব দিন দিন বড় করেই চলছে।
সাধারণত প্রতিদিন কারওয়ান বাজারে আসা ট্রাকপ্রতি চাঁদা তোলা হয় ১শ’ থেকে ৩শ’ টাকা করে। প্রতিরাতে কারওয়ান বাজারে অন্তত ৪শ’ ট্রাক পণ্য নিয়ে ঢোকে। গড়ে ২০০ টাকা করে চাঁদা ধরলে এক রাতে ট্রাক থেকেই চাঁদা ওঠে ৮০ হাজার টাকা। ট্রাক থেকে পণ্য নামিয়ে যেসব ভ্যানে তোলা হয় সেগুলোকে চাঁদা দিয়ে হয় ৫০ টাকা করে। কারওয়ান বাজারে বর্তমানে ৭শ’ ভ্যানগাড়ি রয়েছে। গড়ে প্রতিরাতে ৪শ’ ভ্যানগাড়ি চালু থাকলে এ খাত থেকে চাঁদা আসে ২০ হাজার টাকা। বিভিন্ন আড়ৎ থেকে মালামাল কিনে সেগুলো আবার পিকআপে লোড করতে হলে পাইকারদের চাঁদা গুণতে হয়। ৫ হাজার পাইকার প্রতি রাতে ১০০ টাকা করে চাঁদা দিলে তার পরিমাণ রীতিমতো পাহাড় হয়ে দাঁড়ায় ৫ লাখ টাকা।
সড়ক ও ফুটপাতে ভাসমান দোকানদারের কাছ থেকেও আদায় করা হয় মোটা অঙ্কের চাঁদা। সড়ক ও ফুটপাতে প্রতি রাতে এক হাজারের বেশি সবজির অস্থায়ী দোকান বসে। সকাল পর্যন্ত এগুলো চালু থাকা এসব দোকানের জায়গাগুলোও চাঁদাবাজদের নিয়ন্ত্রণে। ফলে দোকান বসাতে হলেও তাদের চাঁদা দিতে হয়। ব্যবসায়ীদের তথ্য অনুযায়ী, তিন ফুট আয়তনের ভাসমান দোকানের জন্য চার হাজার ও ছয় ফুটের দোকানের জন্য মাসে ১০ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়। এ ছাড়া দোকানের জায়গা (ফুটপাত) বরাদ্দ পেতে অগ্রিম দিতে হয় অবস্থানভেদে ৫০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত। মাসিক ভাড়া ছাড়াও প্রতি রাতে বসার জন্য এসব অস্থায়ী দোকানদারদের আরও ৫শ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়।
দিনের বেলা প্রধান চাঁদাবাজি হয় পার্কিংয়ের নামে। পার্কিংয়ের জন্য ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ১০টি স্পট নির্ধারণ করে সেগুলো ইজারা দিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে কোনো ইজাদারাদার না থাকলেও পার্কিং ফি’র নামে ইচ্ছেমতো টাকা আদায় করা হচ্ছে। তবে সরকারের কোষাগারে জমা হচ্ছে না কোনো অর্থ। এ ছাড়াও জনতা টাওয়ার ও ক্রিসেন্ট মার্কেটের সামনে অবস্থান করা পিকআপ থেকে ১৫০ টাকা করে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। যা সম্পূর্ণ অবৈধ। পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ভবন থেকে পার্কিংয়ের নামে চাঁদা আদায় করছে এ চক্র। কয়েকটি ভবনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হোটেল লা-ভিঞ্চি প্রতি মাসে ২৫ হাজার টাকা, ওয়ান ব্যাংক প্রতি মাসে ৩০ হাজার টাকা করে পার্কিংয়ের জন্য দেয়।
যারা করছে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ: সরকার পরিবর্তনের পর ৫ আগস্ট থেকেই কারওয়ান বাজারের চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে নেয় তেজগাঁও থানা যুবদলের সদস্য সচিব আব্দুর রহমান। পরে এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলে তাকে যুবদল থেকে বহিষ্কার করা হয়। তবে থেমে থাকেনি তার অপকর্ম। যুবদল মহানগর উত্তরের সদস্য সচিব সাজ্জাদুল মিরাজের মদদে আব্দুর রহমান তার বাহিনী নিয়ে নির্বিঘ্নে চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছে। তার সিন্ডিকেটে রয়েছে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির ২৬নং ওয়ার্ডের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মিলন, ২৬নং ওয়ার্ড যুবদল নেতা ফারুক ওরফে ভাগিনা ফারুক, ইউছুফ মজুমদার, সাদ্দাম খান, ৯নং ইউনিট বিএনপি নেতা মো. মুক্তার ও মো. মিলন পাটোয়ারি।
এ ব্যাপারে আব্দুর রহমানের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি ব্যবসা করে খাই। কোনো চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত নই। আমার বিরুদ্ধে একটি স্বার্থান্বেষী মহল মিথ্যা অপপ্রচার চালাচ্ছে। যুবদল থেকে বহিষ্কারের কারণ জানতে চাইতে চাইলে তিনি বলেন, একটি টেলিভিশনে আমার বক্তব্য ভুলভাবে উপস্থাপন করায় এ ঘটনা ঘটেছে। যুবদল নেতা সাজ্জাদুল মিরাজ সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, আমি তার অধীনে রাজনীতি করি।
ব্যবসায়ীরা জানান, আব্দুর রহমানের সহযোগী ফারুক ওরফে ভাগিনা ফারুক ক্ষুদ্র কাঁচামাল আড়তের চারদিক, রাতে রাস্তার উপর বসানের আড়ৎ এবং দিনের বেলা ফুটপাত থেকে চাঁদা তুলেন। প্রতিদিন তার চাঁদা আদায়ের পরিমাণ প্রায় ৫০ হাজার টাকা। যুবদল নেতা সাদ্দাম খান প্রগতি টাওয়ারের পূর্ব পাশ হতে সিএ ভবন মেট্রো স্টেশন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করেন। মো. ইউসুফের নিয়ন্ত্রণে পেট্রোবাংলা ভবন, বিটিএমসি ভবন, জাহাঙ্গীর টাওয়ারের পিছনের গলি হতে আম্বরশাহ মসজিদ গলি পর্যন্ত ফুটপাথ। এসব এলাকায় রাতের বেলায় সবজি নিয়ে আসা ট্রাক/পিকআপ থেকে নেওয়া হয় ২ হাজার টাকা করে। প্রতিরাতে ট্রাক/পিকআপ থেকে তার আয় ২ লাখ টাকা।
যুবদল নেতা মো. মিলন নিয়ন্ত্রণ করেন আম্বরশাহ মসজিদের সামনে থেকে শুরু করে বাপেক্স ভবন, পানি উন্নয়ন ভবন, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর ও কাব্যকস সুপার মার্কেট কাঠপট্টি। আব্দুর রহমানের আরেক সহযোগী মো. মিলন পাটোয়ারির নিয়ন্ত্রণে কারওয়ান বাজারে আসা পিকআপ গাড়ি। ২৭০টি পিকআপ থেকে মাসিক ২ হাজার ৫০০ টাকা হারে আদায় হয় ৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। যুবদল নেতা জসিম ওরফে কারেন্ট জসিম কারওয়ান বাজারের দিনের ফুটপাত ও রাতে রাস্তার উপর বসানোর সকল আড়তে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে প্রতি বাতি হতে ভাড়া আদায় করে। ফলে অবৈধ এই বিদ্যুৎ সংযোগের কারণে সরকারের লাখ লাখ টাকা লোকসান হচ্ছে। কিচেন মার্কেটের পূর্ব পাশের ২ নম্বর সুপার মার্কেটের দক্ষিণ পাশ, কামার সেট ও মাছ বাজার থেকে চাঁদা আদায় করে মুক্তার হোসেন।
আপনার মতামত লিখুন :