ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০২ জানুয়ারি, ২০২৫

শূন্য থেকে শত শত কোটি টাকার মালিক

তরিক শিবলী

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৩০, ২০২৪, ০১:২১ এএম

শূন্য থেকে শত শত কোটি টাকার মালিক

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে উত্তরা এলাকায় সক্রিয় ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা আফসার উদ্দিন খান। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তিনিও আত্মগোপনে গেছেন। এলাকাবাসী জানান, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আগের সিটি করপোরেশনের মেয়র ও কাউন্সিলরদের ক্ষমতাচ্যুত করার আগেই সেবা কার্যক্রম বন্ধ রেখে জনতার ভয়ে পালিয়ে যাওয়া আফসার শত শত কোটি অবৈধ টাকার মালিক। মাত্র ১০-১২ বছরে অবৈধ পন্থায় জিরো থেকে হিরো বনে গেছেন। একাধিক মার্কেট, বাড়ি, ফিলিং স্টেশন, চাইনিজ রেস্টুরেন্ট, ক্যাসিনো ব্যবসাÑ কী নেই তার! সবকিছুই সম্ভব হয়েছে ওয়ার্ড কাউন্সিলর হওয়ার বদৌলতে। অর্ধশত ক্যাডার বাহিনীর বহর নিয়ে চলাফেরা করেতেন।

স্থানীয় সূত্রের দাবি, সাবেক কাউন্সিলর আফসার উদ্দিন খান দখল-চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি-ক্যাসিনো ব্যবসাসহ নানা অপকর্মে জড়িত। রাজউকের ও ব্যক্তিমালিকানাধীন প্লটে মার্কেট বানানো, দখলবাজি, ফুটপাত ও পরিবহন চাঁদাবাজিসহ জুয়া ও ক্যাসিনো কারবার থেকে প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের টাকা তোলার অভিযোগ উঠেছে সাবেক সরকারদলীয় নেতা ও কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে।

সূত্র আরও জানায়, বৃহত্তর উত্তরার দখল-চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন ক্লাবে পরিচালিত জুয়া ও ক্যাসিনো কারবারে নিয়মিত ভাগ পেতেন। উত্তরার তিনটি ক্যাসিনো কারবারের সঙ্গে আফসার উদ্দিনের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টরের ভিবা চাইনিজ রেস্টুরেন্টের ওপরের তলার ক্যাসিনো, হাউজ বিল্ডিং গাজীপুর ক্লাব ক্যাসিনো ও ১ নম্বর সেক্টরের পূবালী ব্যাংকের ওপরে পরিচালিত ক্যাসিনোর পরিচালনাকারী প্রায় সবাই তার অনুসারী। তিনটি ক্যাসিনোই তার ওয়ার্ডে অবস্থিত। নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, উত্তরার আজমপুরে বিডিআর বাজারে কাঁচাবাজার বসিয়ে প্রতি মাসে অর্ধকোটি টাকা ভাড়া আদায় করতেন আফসার উদ্দিন। ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাহাবুদ্দিন বাজারটি দেখভাল করেন। আজিমপুরে ব্যক্তিমালিকানাধীন ২০ কাঠার প্লট দখল করে গাড়ির যন্ত্রাংশ বিক্রির মার্কেট নির্মাণ করেছেন এই কাউন্সিলর। এটি পরিচালনা করেতেন শ্রমিকনেতা মাজেদ।

এ ছড়া আব্দুল্লাহপুরে পানি উন্নয়ন বোর্ডে বিভিন্ন জায়গায় প্রায় ছয়টি মার্কেট নির্মাণ করেছেন। পরিচালনায় আছেন শ্যালক ও যুবলীগের কয়েকজনসহ স্থানীয় জামাই ফারুক। সোনারগাঁও জনপথ রোর্ডে রাজউকের প্রায় ২০ বিঘা জমি দখল করে বানানো হয়েছে ফার্নিচার বাজার। পরিচালনা করেন জজ মিয়া ও যুবলীগের সোহেল। ৯ নম্বর সেক্টরে লেকের পাড়ে ফার্নিচার মার্কেট পরিচালনা করে স্থানীয় ছাত্রলীগ।

উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজের সামনে জুট কাপড়ের ব্যবসার মার্কেট নিয়ন্ত্রণ করেন আফসার উদ্দিনের অনুসারী রাসেল। ওই প্লট বিএনপির এমপি পদপ্রার্থী সৌদিপ্রবাসী জামাল উদ্দিনের থেকে দখল করা। উত্তরা আব্দল্লাহপুরের পরিবহন চাঁদাবাজি, যা রাজধানীর মধ্যে তৃতীয় বড় পরিবহন চাঁদাবাজির স্পট। এটি নিয়ন্ত্রণ করেন শ্রমিকনেতা নূরু। এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রতি মাসে কয়েক কোটি টাকা উপার্জন করেন কাউন্সিলর আফসার। এসব অর্থে গত সাত বছরের ব্যবধানে গড়েছেন অঢেল সম্পদ এবং বিলাসী জীবন যাপন করছেন। ১০ কাটা জমির ওপর গড়ে তোলা হয়েছে ১৩ তলার খান টাওয়ার। যার বাজারমূল্য আনুমানিক ৩০০ কোটি টাকা। ৯ নম্বর সেক্টরের ১০ নম্বর রোডে পাঁচ কাঠার ও আবদুল্লাহপুরে দুটি ছয়তলা বাড়িসহ তিনটি প্লট, যার মূল্য ১০০ কোটি টাকা।

কিন্তু আফসার উদ্দিন খান এর হলফনামায় নিজের এবং স্ত্রীর পরিসম্পদ ও আয়ের বিবরণীতে অস্থাবর সম্পদ বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে নগদ টাকা আছে যথাক্রমে ৪০ লাখ ১ হাজার ৬১৯ এবং ৮৩ লাখ ৫৮ হাজার। বৈদেশিক মুদ্রার ঘরে উভয়ের ক্ষেত্রে ক্রস চিহ্ন দেওয়া আছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমাকৃত অর্থের পরিমাণ যথাক্রমে ১৩ লাখ ৪৫ হাজার এবং ১০ লাখ ২২ হাজার টাকা। বন্ড, ঋণপত্র, স্টক এক্সচেঞ্জ তালিকাভুক্ত ৯ কোম্পানির শেয়ার (অর্জনকালীন মূল্য) নিজের ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা।

পোস্টাল, সেভিংস সার্টিফিকেটসহ বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্রের বা স্থায়ী আমনতের বিনিয়োগ বিষয়ে উভয় ঘরে ক্রস চিহ্ন দেওয়া আছে। বাস, ট্রাক, মোটরসাইকেল ইত্যাদি বিষয়ে উভয়ের ঘরে ক্রস চিহ্ন দেওয়া আছে। স্বর্ণ ও অন্যান্য মূল্যবান ধাতু ও পাথর নির্মিত অলংকারাদি নিজ নামে ১০ হাজার টাকা (অর্জনকালীন মূল্য) এবং স্ত্রীর নামে ৫০ তোলা স্বর্ণ উল্লেখ করা হয়েছে। ইলেকট্রনিক সামগ্রী (অর্জনকালীন মূল্য) যথাক্রমে ১ লাখ ও ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা।

আসবাবপত্র যথাক্রমে ১ লাখ ১০ হাজার ও ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
পারিবারিকভাবে বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত থাকলেও ২০০৮ সালে ভোল পাল্টে আওয়ামী লীগে আসেন আফসার উদ্দিন খান। তার বাবা ও ভাই একসময় শান্তি কমিটির নেতা সুলতান চেয়ারম্যানের রাজনীতি করতেন। পরিবারের বড় ভাই আশ্রাফ আলী জোট সরকারের সময় উত্তরা এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতেন। সময়ের ব্যবধানে ছোট ভাই আফসার আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী কাউন্সিলর হন। ঢাকা-১৮ আসনের সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের ছত্রছায়ায় থেকে কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর এলাকায় স্বঘোষিত ডন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। আন্দোলন দমাতে আওয়ামী লীগে সক্রিয় থাকায় জনতার ভয়ে তারা সবাই পালিয়েছেন।

আরবি/জেডআর

Link copied!