৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারাও একই পথ ধরেছেন। ইতোমধ্যে দলটির বেশির ভাগ নেতা দেশ ছেড়েছেন। যারা পালাতে পারেননি, তাদের মধ্যে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন হাতেগোনা কয়েকজন। বাকিরা আছেন আত্মগোপনে। তারা এখনো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন দেশ ছেড়ে পালানোর। ইতোমধ্যে যারা পালিয়েছেন এবং এখনো যারা পালানোর চেষ্টা করছেন, তাদের প্রথম পছন্দ প্রতিবেশী দেশ ভারত। ভারতে পালিয়ে যেতে তাদের কাছে সবচেয়ে নিরাপদ রুট হচ্ছে সিলেট সীমান্ত।
আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে যারাই দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, তাদের বেশি সংখ্যক এই রুট ব্যবহার করেছেন। ফলে আত্মগোপনে থাকা দলটির বাকি নেতাদের আস্থার তালিকায় রয়েছে সিলেট সীমান্ত। সর্বশেষ সিলেট সীমান্ত দিয়ে দেশ ছাড়ার তালিকায় নাম লিখিয়েছেন আওয়ামী লীগ দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনিও এই রুট ব্যবহার করে ভারতে পালিয়ে গেছেন বলে আলোচনা আছে। তবে বিশ্বস্ত কোনো সূত্র থেকে এটি এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বলা হচ্ছে, গেল সপ্তাহে তিনি ভারতে পালিয়ে গিয়ে সিলেটের প্রতিবেশী আসাম রাজ্যের রাজধানী গোয়াহাটিতে অবস্থান করছেন।
গত ৫ আগস্ট আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয় আওয়ামী লীগ। ওইদিন ভারতে চলে যান সাবেক সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর আত্মগোপনে চলে যান দলটির সব কেন্দ্রীয় নেতা, সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী। তাদের বেশি সংখ্যক ইতোমধ্যে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে চলে যেতে সক্ষম হয়েছেন। গত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতা দেশ ছাড়েন। তারা বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারত পৌঁছান। বেশ কয়েকজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ভারত হয়ে ইউরোপ-আমেরিকায়ও পাড়ি জমিয়েছেন। যেখানে তাদের ব্যবসা বাণিজ্য ও আত্মীয়-স্বজন রয়েছে।
গুঞ্জন রয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এত সতর্ক অবস্থানের পরও তারা মূলত বড় অংকের টাকার লেনদেন করে এবং বিশেষ একটি মহলের সহায়তায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। সর্বশেষ ওবায়দুল কাদেরের বেলায়ও একই অভিযোগ উঠেছে। বলা হচ্ছে, একটি বিশেষ বাহিনীর সহায়তায় দালালদের মাধ্যমে বড় অংকের অর্থের বিনিময়ে তিনি সিলেট হয়ে দেশ ছাড়তে পেরেছেন।
রাজনৈতিক সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের কিছু নেতা সিলেট সীমান্ত পাড়ি দিয়ে প্রথমে যান মেঘালয়ের শিলংয়ে। পরে সেখান থেকে কলকাতায় পৌঁছান। কলকাতা থেকেই তারা তৃতীয় দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। সিলেটের সঙ্গে মেঘালয়ের স্থলবন্দর থাকলেও ক্ষমতাচ্যুত দলটির নেতারা গেছেন অবৈধ পথে। সিলেট ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা প্রথমে অবৈধভাবে ভারত যাওয়ার এই রুট আবিষ্কার করেন। অবশ্য এ রুট ব্যবহার করে সবাই যাওয়ার চেষ্টা করলেও কয়েকজন যেতে পারেননি। ধরা পড়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। একজন মেঘালয়ের পাহাড়ে প্রাণও দিয়েছেন।
সূত্র মতে, আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিয়াকত শিকদার, ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম, ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি সাদ্দাম হোসেন, সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানসহ আরও কয়েকজন গত ৭ আগস্ট থেকে ১৭ আগস্টের মধ্যে সিলেটের কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট ও জকিগঞ্জ সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে ঢোকেন।
তাদের মধ্যে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইসহাক আলী খান পান্না এভাবে ভারত যাওয়ার সময় মেঘালয়ের পাহাড়ে গত ২৪ আগস্ট অসুস্থ হয়ে মারা যান। এই রুট ব্যবহার করে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং সাবেক বৈদেশিক ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক ও সিলেট জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন খান গত ১৭ আগস্ট একসঙ্গে ভারতে যান।
শফিকুর রহমান চৌধুরী কয়েক দিনের মধ্যে ভারত থেকে লন্ডনেও চলে গেছেন। তার আগে ১২ আগস্ট এই রুট ব্যবহার করে সিলেট সিটি করপোরেশনের বরখাস্ত হওয়া মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। তিনিও বর্তমানে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। পরে যান সিলেট-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান হাবিব। যেদিন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে, সেই ৫ আগস্ট দুপুর ২টার পর মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সিলেট সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদ কানাইঘাট উপজেলার সীমান্ত দিয়ে দেশত্যাগ করেন। একসঙ্গে সিলেট সীমান্ত ব্যবহার করে ভারতে যান সুনামগঞ্জ-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রনজিত চন্দ্র সরকার এবং মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিধান কুমার সাহা।
এছাড়া সিলেট জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের বেশি সংখ্যক নেতা এই রুটে দেশ ত্যাগ করেন। তাদের অনেকে এখন শিলংয়ে অবস্থান করছেন। তাদের মধ্যে প্রথমে কানাইঘাট সীমান্ত দিয়ে ভারতে যান জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি নাজমুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক রাহেল সিরাজ, মহানগর ছাত্রলীগ সভাপতি কিশোয়ার জাহান সৌরভ ও সাধারণ সম্পাদক নাইম আহমদ। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন একসঙ্গে তার পরিষদের বেশ কয়জন নেতা ও নেত্রীকে নিয়ে সিলেট সীমান্ত দিয়েই ভারতে প্রবেশ করেন। সিলেট সিমান্ত দিয়ে সিলেট মহানগর যুবলীগ সভাপতি আলম খান মুক্তি, সাধারণ সম্পাদক মুশফিক জায়গীরদার, সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল লতিফ রিপন, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি আফসার আজিজ, সহসভাপতি পীযূষ কান্তি দে, এমদাদ আহমদ, সাধারণ সম্পাদক দেবাংশু দাশ মিটু, কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর আলম, রুহেল আহমদ, ছাত্রলীগের মহানগর সাধারণ সম্পাদক নাঈম আহমদও ভারতে পালিয়ে যান।
তাদের অনেকে এরই মধ্যে ভারত ছেড়ে তৃতীয় দেশেও পাড়ি জমিয়েছেন। বেশি সংখ্যক চলে গেছেন যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও দুবাইতে। যদিও তারা প্রথমে গিয়ে অবস্থান করছিলেন গোয়াহাটি, শিলং, ডাউকি, জোয়াই, করিমগঞ্জ, শিলচর, বিস্কুটসহ কয়েকটি এলাকায়। আশায় ছিলেন হয়তো দেশের পরিস্থিতি দ্রুত অনুকূলে চলে যেতে পারে। কিন্তু দিন দিন অনিশ্চয়তা বেড়ে যাওয়ায় তারা তৃতীয় দেশে স্থায়ী রাজনৈতিক আশ্রয় লাভের আশায় চলে গিয়েছেন। কেউ কেউ নিয়ে গেছেন পরিবারের সদস্যদেরও।
তাদের মধ্যে কিশোয়ার জাহান সৌরভ দুবাই হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এবং যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক মুশফিক জায়গীরদার যুক্তরাজ্যে চলে গেছেন। সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি মাসুক উদ্দিন আহমদ যুক্তরাজ্যে এবং সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন ভারতের করিমগঞ্জে অবস্থান করছেন। মহানগর ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক আবদুল আলীম তুষার কানাডায় পাড়ি জমিয়েছেন।
সিলেটের গোয়ানঘাটের তামাবিল, জৈন্তাপুরের কয়েকটি সীমান্ত, কানাইঘাটের ডোনা ও সুরইঘাট এলাকার সনাতনপুঞ্জি সীমান্ত ছাড়াও বিয়ানীবাজার উপজেলায় অবস্থিত সুতারকান্দি, গজুকাটা সীমান্ত দিয়েও অনেকে দেশ ছাড়েন। তবে যারা সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছেন তাদের আটক করতে ব্যর্থ হচ্ছে বিজিবি বা পুলিশ। এরই মধ্যে যে কয়জন ধরা পড়েছেন, তাতে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো কৃতিত্ব নেই। কানাইঘাট সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় বিচারপতি ব্যারিস্টার এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক প্রথমে ধরা পড়েন সাধারণ মানুষের হাতে। তারাই বিজিবির কাছে সোপর্দ করেন তাকে। গত ৭ সেপ্টেম্বর সিলেট সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালানোর সময় সিলেট জৈন্তাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান কামাল আহমেদকে আটক করে বিজিবি।
সূত্র জানায়, যারা পালিয়েছেন, তাদের বেশিসংখ্যককেই দালাল সিন্ডিকেটের সহায়তা নিতে হয়েছে। কেউ কেউ ভারতে ঢুকতে কোটি টাকাও দিয়েছেন। ২০ লাখের নিচে কেউ ঢুকতে পারেননি। কেউ আবার খুইয়েছেন মোটা অঙ্কের নগদ টাকা ও ডলার। অভিযোগ আছে, অনেক ভিআইপি পার হওয়ার সময় দুদেশের প্রশাসনের লোকজনের সহায়তা নিয়েছেন। যদিও এ বিষয়ে কেউ মুখ খুলতে নারাজ। দেশে আওয়ামী দোসরদের সাজানো প্রশাসন তাদের নির্বিঘ্নে দেশ ছাড়তে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়াও বড় অংকের টাকার বিনিময়ে সীমান্তে অবস্থানরত কতিপয় বিএনপি নেতা ও কতিপয় দালালদের সমন্বিত সিন্ডিকেট আওয়ামী লীগ নেতাদের পালিয়ে যেতে সহায়তা করছে।
আপনার মতামত লিখুন :