চট্টগ্রামে মাদকের খুচরা বিক্রি এবং ব্যবহার দিন দিন বাড়লেও মারাত্মকভাবে কমেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক মাদক উদ্ধার। মাদক উদ্ধারে পুরোপুরি হতাশ করেছে মাদকদ্রব্য অধিদপ্তর চট্টগ্রামও। যেখানে পত্রিকার পাতা খুললেই বানের মতো মাদক ঢোকার খবর পাওয়া যায় সেখানে গত ৪ মাসে চট্টগ্রামে মাদক উদ্ধারের চিত্র অত্যন্ত রুগ্ন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের পট পরিবর্তনের পর মাদক সরবরাহ চেইনে ব্যাপক পরিবর্তন এবং মাদক ব্যবসায়ীদের ঘনঘন রুট পরিবর্তনের কারণে মাদক উদ্ধারে আশানুরূপ সফল হতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি), জেলা পুলিশ, রেলওয়ে পুলিশ, র্যাব-৭, মাদকদ্রব্য অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মেট্রো এবং মাদকদ্রব্য অধিদপ্তর চট্টগ্রাম দক্ষিণ-সরকারের এই ৬ প্রতিষ্ঠানে গত ৪ মাসে (নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি) ৯৩১টি মাদকের মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছে এক হাজার ২৬৭ জন।
উদ্ধার হয়েছে ৭ লাখ ৫০ হাজার ৭৬৯ পিস ইয়াবা, গাঁজা ৭ হাজার ৫৬৭ কেজি, ফেনসিডিল ৯৯ বোতল, চোলাই মদ ৮ হাজার ৭৪১ লিটার, বিদেশি মদ ৭৬ বোতল ২৬ লিটার, হুইস্কি ৫ বোতল, বিয়ার ৯০ বোতল, ক্রিস্টাল আইস ৪৭৫ গ্রাম এবং ৯৪ গ্রাম হেরোইন।
চট্টগ্রামে মাদকের চেইনরুট নিয়ে দীর্ঘ বছর অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করছেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান মোহাম্মদ সেলিম জাবেদ। তার করা বেশ কয়েকটি প্রতিবেদনের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে অভিযানও চালিয়েছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং মাদকদ্রব্য অধিদপ্তর।
মাদকের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পণ্যের জোগান বাড়লে দাম কমেÑ এটা স্বাভাবিক তথ্য। চট্টগ্রামে আগে প্রতিপিস ইয়াবা বিক্রি হতো ৩০০ টাকায় আর এখন হচ্ছে ৮০ থেকে ৯০ টাকায়। তা হলে আমরা কীভাবে বলি চট্টগ্রামে মাদক সরবরাহ কমেছে?
তিনি আরও বলেন, যেখানে পুলিশের একটি পয়েন্ট থেকে লাখ লাখ পিস ইয়াবা উদ্ধার হওয়ার কথা সেখানে গত ৪ মাসে ইয়াবা উদ্ধারের এই পরিসংখ্যান অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। তিনি আরও বলেন, সরকারি পট পরিবর্তনের পর থেকে পুলিশ নিষ্ক্রিয়। যে কারণে অন্যান্য অপরাধের মতো চট্টগ্রামে মাদকের সরবরাহ আগের থেকে অনেক বাড়লেও কমেছে উদ্ধারের হার।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, নভেম্বর-২০২৪ থেকে ফেব্রুয়ারি-২৫-এই চার মাসে সিএমপিতে মাদকের মামলা হয়েছে ৪৬৭টি; আর গ্রেপ্তার হয়েছেন ৫৭৬ জন। উদ্ধারের তালিকায় রয়েছে ইয়াবা ২ লাখ ৯৮ হাজার ২৯২ পিস, গাঁজা ২৮৬ কেজি, ফেনসিডিল ৭৩০ বোতল, বেদেশি মদ ৪৬ ক্যান ও ৬ লিটার, চোলাই মদ ১ হাজার ১৮১ লিটার, হুইস্কি ৫৫ বোতাল, ক্রিস্টাল আইস ৪৭৫ (র্যাব কর্তৃক উদ্ধার), হেরোইন ৯৪ গ্রাম, বিয়ার ৭০ ক্যান।
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশে চার মাসে মাদকের মামলা হয়েছে ৩২৬টি; আর গ্রেপ্তার ৪৩৬ জন। ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৪১০ পিস, গাঁজা ১৪৯ কেজি, ফেনসিডিল ৪২৪ বোতল, বেদেশি মদ ৮ ক্যান ও ২০ লিটার, বিয়ার ২০ ক্যান। চট্টগ্রাম রেলওয়ে পুলিশে মাদকের মামলা হয়েছে ২৬টি; আর গ্রেপ্তার ২৩ জন। ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে ১২ হাজার ৩৮০পিস, গাঁজা ৪৪ কেজি।
মাদকদ্রব্য অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মেট্রো অঞ্চল ৯৯ মামলায় গ্রেপ্তার ১০৭ জন; আর উদ্ধারের তালিকায় রয়েছে ইয়াবা ৩২ হাজার ৯৭৫ পিস, গাঁজা ৩ হাজার ৫৮৬ কেজি, বেদেশি মদ ৮ বোতল। মাদকদ্রব্য অধিদপ্তর চট্টগ্রাম দক্ষিণে নভেম্বর থেকে জানুয়ারি তিন মাসে মাদকের মামলা হয়েছে ১১২টি; আর গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১২৪ জনকে।
৩ মাসে উদ্ধারের তালিকায় রয়েছে ইয়াবা ৪৬ হাজার, ৬৮৮ পিস, গাঁজা ৩ হাজার ৫০৬ কেজি, বিদেশি মদ ১২ বোতল আর চোলাই মদ ৮০ লিটার।
নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি- চার মাসে ৮০টি মামলায় মাদকসহ ৭৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। উদ্ধার করা হয়েছে ইয়াবা ৭৪ হাজার ৬১০ পিস, ফেনসিডিল ২ হাজার ৩৮৬ বোতল, বিদেশি মদ ১৬১ বোতল এবং আইস উদ্ধার হয়েছে ৪৭৫ গ্রাম। মাদক মামলার আসামিসহ উদ্ধারকৃত মাদক পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে র্যাব।
মাদক উদ্ধারের হার কমে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন র্যাব-৭ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল অধিনায়ক মাহবুবুল আলম এবং মাদকদ্রব্য অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের সহকারী পরিচালক (এডি) কাজী দিদারুল আলম। র্যাব-৭ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল অধিনায়ক মাহবুবুল আলম বলেন, পট পরিবর্তনের পর মাদক সরবরাহের চ্যানেলে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আগে যে রুটে মাদক পরিবহন হতো এখন রুটে হয় না।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, ধরেন একটি মোবাইলের নম্বর ধরে আমরা একজনের পিছু নিয়েছি। নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই সে সিমসহ মোবাইলটি ফেলে দেবে। নতুন সিমসহ নতুন একটা মোবাইল ব্যবহার শুরু করে। এই যে মোবাইলটা ফেলে দিল- এখানেই কিন্তু আমাদের টেকনোলজি আটকে গেল- আটকে গেলাম আমরা। সোর্সের ওপর নির্ভর করে আমাদের আবার নতুন করে অভিযান শুরু করতে হয়। যোগ করেন তিনি।
মাদকদ্রব্য অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের সহকারী পরিচালক (এডি) কাজী দিদারুল আলম বলেন, ঢাকা-কক্সবাজার ট্রেনপথ চালু হওয়ার পর সড়কপথে মাদক পাচার কমে গেছে। যে কারণে আমাদের উদ্ধারের হারও কমেছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, আইনি জটিলতার কারণে আমরা চাইলেও ট্রেন থামিয়ে কিংবা চলতি পথে ট্রেনের বগিতে তল্লাশি চালাতে পারি না। জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, মাদক উদ্ধারে মহাসড়কে টহল বাড়ানোসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে জেলা পুলিশ। একইসঙ্গে মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরকেও আমরা বিভিন্নভাবে সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করছি।
আপনার মতামত লিখুন :