এখনো গুমোট হাওয়া সিলেটে। সর্বত্র আতঙ্ক ও ভয়। একই সাথে রয়েছে ক্ষোভ ও নিন্দা। যখন সারা সিলেটের মানুষ গাজায় ইসরায়েলের চলমান গণহত্যায় ক্ষুব্ধ ও ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহমর্মী, তখন প্রতিবাদ মিছিল থেকে নগরে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, আগুন, তাণ্ডব, লুটপাটকে ভালো চোখে দেখছেন না কেউ।
তারা মনে করছেন, এর পেছনে কারো উদ্দেশ্য ও ইন্ধন রয়েছে। তাদের সন্দেহের তীর সরাসরি ৫ আগস্টের পরাজিত শক্তির দিকে। বলছেন, পালিয়ে থাকা ফ্যাসিস্টরা হয়তো এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সিলেটকে অস্থিতিশীল করতে চাইছে।
সিলেট বিএনপির নেতারাও তাই মনে করছেন। তারাও বলছেন, কারো ইন্ধন ছাড়া শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও মিছিল থেকে দুর্বৃত্তরা এটা করতে পারে না।
তারা যেকোনো মূল্যে অরাজকতা রোধ ও দায়ীদের চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান। বিএনপি নেতারা ব্যবসায়ীদের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়ে নির্ভয়ে ব্যবসা পরিচালনার আহ্বান জানান।
গত সোমবার ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের গণহত্যার প্রতিবাদে ডাকা বিক্ষোভ মিছিল থেকে সিলেটে কেএফসি রেস্টুরেন্ট, বাটা, বনফুল কনফেকশনারি, সুপারশপ ইউনিমার্ট, আলপাইন রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়।
পাশাপাশি যেখানেই কোক ও পেপসি ছিল সেখানে ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা। রাতেই দুর্বৃত্তদের কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লুটের পণ্য বিক্রির বিজ্ঞাপন দেয়। এই সূত্র ধরে পুলিশ এ পর্যন্ত ১৪ জনকে আটক করেছে। গত সোমবার রাতে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করে মহানগর পুলিশ।
পুলিশ বলছে, সিলেটের পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক আছে। কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জিয়াউল হক বলেন, কাউকে আরজকতা করতে দেওয়া হবে না। জড়িতদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। আর যাতে কোনো অঘটন না ঘটে সে জন্য আমরা সতর্ক রয়েছি।
তবে সাহস হারিয়ে ফেলেছেন সিলেটের ব্যবসায়ীদের অনেকেই। ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলো গতকালও খুলেনি। সরেজমিনে দেখা গেছে আগের দিনের মতো লন্ডভন্ড হয়ে আছে। নগরবাসীর মধ্যেও বিরাজ করছে ভয়।
গত সোমবার ঘটনার পরপরই রাতে মহানগর বিএনপির পক্ষ ট্রাকযোগে বিভিন্ন স্থানে পথসভা করে হামলাকারীদের গ্রেপ্তার দাবি জানানো হয় এবং লুটপাট, ভাঙচুরসহ অরাজকতার তীব্র নিন্দা জানানো হয়। তারা এ সময় নগরবাসীকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান।
বলেন, দুষ্কৃতকারীরা ওঁৎ পেতে আছে। সুযোগ পেলেই ছোবল দেবে। সিলেটের সাম্প্রতিক অরাজকতা সম্পর্কে নগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান লোদী কয়েছ বলেন, আমরা সবাই গাজাবাসীর প্রতি সহমর্মী।
আমরাও তাদের জন্য রাস্তায় নেমে এসেছি। প্রতিবাদে বিক্ষোভ করছি। কেউ হয়তো এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। সুযোগ পেয়েই তারা ছোবল দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আমরা তা হতে দেব না। সিলেটবাসীকে নিয়ে অরাজকতা সৃষ্টিকারীদের প্রতিহত করা হবে।
মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এমদাদ হোসেন চৌধুরী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ভাঙচুর ও লুটপাটের নিন্দা জানিয়ে জড়িতদের গ্রেপ্তার দাবি করেন। বলেন, প্রতিবাদের ভাষাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে কিছু লোক সিলেটের সুনাম ক্ষুণ্ন করছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীসহ সকল পেশার মানুষকে সতর্ক থাকতে হবে।
ঘটনার পর রাতে সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আরিফুল হক চৌধুরী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক লাইভে এসে সিলেটবাসীকে যেকোনো উসকানিতে সাড়া না দিতে আহ্বান জানান।
দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, লুটপাট, ভাঙচুর পরাজিত শক্তির কাজ। গাজা নিয়ে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারীরা অরাজকতা করতে পারেন না। কেউ সিলেটের সুনাম ও ঐতিহ্য নষ্ট করতে চাইছে।
ব্যবসা-বাণিজ্য ও জনমনে অস্থিতিশীলতা নিয়ে আসতে চাইছে। তাদের সফল হতে দেওয়া হবে না। প্রতিহত করা হবে। তিনি ব্যবসায়ীদের নির্বিঘ্নে ব্যবসা পরিচালনা করার আহ্বান জানান। বলেন, বিএনপি আপনাদের সাথে আছে, থাকবে।
সূত্র জানায়, গত সোমবার জোহরের নামাজ শেষে সিলেটের বন্দরবাজার কোর্ট পয়েন্ট থেকে সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। বিভিন্ন ব্যানারে নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষজন কোর্ট পয়েন্টে এসে জড়ো হন।
এখান থেকে হাজারো মানুষ বিক্ষোভ মিছিল করে নগরীর চৌহাট্টা পয়েন্টে যান। সেখান থেকে বিক্ষোভরত লোকজন নয়াসড়ক এলাকায় অবস্থিত কেএফসি রেস্টুরেন্টে ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান দাবি করে ভাঙচুর করা হয়। ওই ভবনে থাকার আরও ২টি রেস্টুরেন্টেও একই ঘটনা ঘটে।
এছাড়াও দরগাহ গেট ও জিন্দাবাজার এলাকার বাটার শোরুম ও আম্বরখানা এলাকাস্থ ইউনিমার্টে ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা। এ সময় বাটার শোরুমের গ্লাস ভেঙে ভেতরে ঢুকে সেখান থেকে জুতা লুটপাট করা হয়। তাছাড়া কিছু জুতায় আগুনও ধরিয়ে দেয়া দুর্বৃত্তরা।
অপরদিকে নগরীর জালালাবাদ এলাকার ফুলকলি, চৌহাট্টাস্থ আলপাইন রেস্টুরেন্ট, আম্বরখানাসহ নগরীর বিভিন্ন এলাকার ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কোক রাখার জন্য হামলা চালানো হয়। এসব দোকান থেকে কোক, পেপসি, ফান্টাসহ বিভিন্ন পণ্য ইসরায়েলি দাবি করে ভেঙে নষ্ট করে ফেলা হয়।
একটি সূত্র দাবি করেছে, জিন্দাবাজার ও চৌহাট্টা এলাকায় সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রাহেল সিরাজের অনুসারীরা ভাঙচুর ও লুটপাট চালিয়েছে। তবে এ দাবির সত্যতা নিশ্চিত করা যায়নি।
আপনার মতামত লিখুন :