স্বামী মোফাজ্জল হোসেনের মৃত্যুর চার মাস যেতে না যেতেই আরও একটি শোকের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে নাজমা বেগম। তিন সন্তানের মধ্যে সবার বড়ো ছেলে বাক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী জুলহাস। তাকে নিয়ে মা নাজমা বেগমের যত চিন্তা। হঠাৎ করে আরও একটি মহা চিন্তা যুক্ত হলো বিধবা নাজমা বেগমের।
স্বামী মারা যাবার পর টাকার অভাবে ছোট ছেলে মবিন কে ঢাকার উত্তরায় একটি কম্পিউটারের দোকানে কাজে পাঠায়। এখানেই ঘটে বিপত্তি, গত ১৮ জুলাই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সারা দেশ যখন উত্তাল। মিছিলে মিছিলে রাজপথ ছিল
প্রকম্পিত। এ অবস্থায় কিশোর মবিন আর দোকানে থাকতে পারেনি। সকাল ১১টায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সাথে মিছিলে যোগ দেন। মিছিলটি একপর্যায়ে উত্তরা থানার দিকে গেলে থানার ভিতর থেকে শুরু হয় গুলি। এক পর্যায়ে একটি বুলেট তার বাম কানের উপর দিয়ে ঢুকে ডান কানের উপর দিয়ে বেরিয়ে যায়। পাশাপাশি পুলিশের ছর্রা গুলিতে তাঁর মাথা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মবিন। এরপর থেকে বিভীষিকাময় প্রতিটি সময় পার করছেন কিশোর মুবিন ও তাঁর পরিবার।
শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলার শিধলকুড়া ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের বড় শিধলকুড়া গ্রামের মৃত মোফাজ্জল হোসেন ও নাজমা বেগম দম্পতির তিন ছেলের মধ্যে সবার ছোট ছেলে মবিন (১৭)। বাবার মৃত্যুর পরে মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে ও প্রতিবন্ধী ভাইটি কে সুখে রাখতে উত্তরার রাজলক্ষ্মীর পাশে ৩ নাম্বার সেক্টর ২ নাম্বার রোডের ২৭ নাম্বার প্লটে লতিফ এম্পোরিয়ামের মো: ওয়াসিম তালুকদারের ইজি কম্পিউটার সেন্টারে চাকরি নেয়।
কোটা বিরোধী আন্দোলনে গিয়ে পুলিশের গুলিতে দুই চোখ ও ডান কান নষ্ট হয়ে যায় মবিনের। ধারদেনা করে প্রায় দুই লাখ টাকা খরচ করে চোখের চারটি অপারেশন করিয়ে রীতিমত পথে বসে গেছে তার পরিবার। সামনে তাঁর আরও দুটি অপারেশন করাতে হবে যার খরচ হবে প্রায় লাখের মতো। কোথায় পাবে বিধবা নাজমা বেগম এতগুলো টাকা? স্বামীর রেখে যাওয়া ভাঙ্গাচুরা ঘর আর ভিটেমাটিই এখন তাঁর শেষ ভরসা।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায় নাজমা বেগম তার ছোট ছেলে মো: মবিন ধরে ঘরের বাইরে বের করছে। পাশাপাশি তার দু`চোখ বেয়ে পানি পরছে। মায়ের কান্নার শব্দ শুনলে অন্ধ মবিনও তার চোখের পানি ধরে রাখতে পারে না। বড়ো ভাই প্রতিবন্ধী জুলহাস একা একা হাসে আর কি যেন একটা বলার চেষ্টা করে।
বাড়িটিতে ঢুকতেই হাতের বাম দিক একটি নতুন কবরের দেখা মিলে। এটা মূলত মবিনের বাবার কবর। বাড়ির চারপাশ ছেঁড়া পলিথিন ও সিমেন্টের বস্তা দিয়ে মোড়ানো। কারন তাঁর মা নাজমা বেগম এই বাড়িতে কোরআন ও হাদিসের তালিম করে।
কথা হয় কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে দুই চোখ ও এক কান হারানো মবিনের সাথে। তিনি নিজের মুখে বর্ননা দেন তাঁর সাথে ঘটে যাওয়া নিষ্ঠুরতম ঘটনার।
মবিন বলেন, প্রতিদিনের মতো ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার সকালে কাজের জন্য দোকানে যায়। দোকানে ঢোকার কিছু সময় পরেই কোটা সংস্কার আন্দোলনের মিছিল বের হয়। তখন মবিন দোকান বন্ধ করে ছাত্রদের সাথে মিছিলে যোগ দেন। মিছিলটি উত্তরা থানার সামনে গেলে, থানা থেকে মিছিলটি লক্ষ্য করে এলোপাথাড়ি গুলি ছোড়তে থাকে পুলিশ। পুলিশের ছররা গুলিতে তাঁর মাথা ঝাঁঝরা হয়ে যায় এবং একটি বুলেট তাঁর বাম চোখের উপরের দিক দিয়ে ঢুকে ডান দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। তখন সে মাটিতে পরে যায়। কয়েকজন আন্দোলনকারী তার গায়ে থাকা গেঞ্জি খুলে মাথা বেধে প্রথমে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে চক্ষু বিজ্ঞান হাসপাতাল হয়ে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়।
মবিনের মা নাজমা বেগম বলেন, ওর বাবা মরার চার মাসের মাথা আল্লাহ আমাকে আরও একটা শাস্তি দিল। আমার বড়ো ছেলেটা প্রতিবন্ধী ওর দেখা শোনা করতেই হিমশিম খাই। এখন আবার ছোট ছেলে পুলিশের গুলিতে চোখ দুটি নষ্ট হয়ে যায় এবং ডান কানেও শুনে না। আমি এখন দুই প্রতিবন্ধী নিয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াব।
অভাবের সংসারে কষ্ট করে মেঝো ছেলে কে আইএ পাশ করাইছি এখন সরকার যদি আমার এই ছেলেকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে তাহলে হয়তো দুমুঠো খেয়ে বাঁচতে পারবো।
মবিনের ভাই নাজমুল হুদা পলাশ বলেন, গত ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার আমি বাসাতেই ছিলাম। সকাল ১১: ৩০ মিনিটে আমার মোবাইলে ফোন আসে। আমাকে বলে আপনি কি মবিনের ভাই পলাশ। আমি হ্যা বলতেই তিনি বলেন আপনি দ্রুত সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চলে আসুন আপনার ছোট ভাই মবিন পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে হাসপাতালে আছে। আমি তখন দ্রুত সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে গিয়ে অনেক খোঁজা খুঁজি করে আমার ভাই কে পাই। তখন ওর সমস্ত মাথা সাদা কাপড়ে মোড়ানো। চেহারার দিকে তাকাতেই আমার হৃদয় আঁতকে উঠল। আমার সাথে থাকা খালাতো ভাই আমাকে সান্ত্বনা দিল। এরপর ডাক্তার বললেন ওকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গেলে ভালো চিকিৎসা হবে। তখন এম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেল নিয়ে যাই। ওখানে বেশ কয়েক দিন চিকিৎসা শেষে চোখের অপারেশন করাতে ভিশন আই হাসপাতালে নিয়ে যাই। ওখানেও ওর বেশকয়েকটি অপারেশন হয়।
ভিশন আই হাসপাতালে আমাদের এক লাখ বিশ হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। এখন আমাদের কাছে ওর চিকিৎসার জন্য কোন টাকা নেই। শুধু বাবার রেখে যাওয়া টিনের ঘর ও একটু জমি শেষ সম্বল। এটা বিক্রি করে দিলে আমার মা ও তিন ভাই মিলে খোলা আকাশের নিচে থাকা ছারা উপায় নেই। এখন সরকার ও দেশবাসী যদি আমার ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য সহায়তা করে, তাহলে আমাদের অনেক উপকার হয়।
প্রতিবেশী নূরুল ইসলাম সরদার বলেন, কিছু দিন আগে মবিনের বাবা মারা যায়। এখন ও আন্দোলনে গিয়ে দুই চোখ ও একটা কান হারায়। ওদের জায়গায় জমি বলতে বাড়ি ও ঘরই আছে। সরকার যদি এ পরিবারকে একটু সহায়তা করে তাহলে ওঁরা বেচে থাকতে পারবে।
মবিনের মামা নূর মোহাম্মদ হাওলাদার বলেন, অল্প কিছু দিন আগে ওর বাবা মরে যায়। একটা প্রতিবন্ধী ছেলেসহ তিন সন্তান নিয়ে কোনরকম সংসার চলছিল। হঠাৎ করে ওর ছোট ছেলে মবিন আহত হয়ে প্রতিবন্ধী হয়ে ঘরে পরে আছে।
মেঝো ভাগিনা একটা বেসরকারি কোম্পানিতে ড্রাইভার হিসেবে কাজ করে স্ত্রী ও মা ভাইদের নিয়ে চলতে কষ্ট হয়। আমরাও গরীব মানুষ ওদের যে একটু সহায়তা করবো তা-ও পারি না। সরকার যদি দয়া করে আমার ভাগিনা কে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে তাহলে আমার বোনটা একটু ভালো থাকতে পারবে।
আপনার মতামত লিখুন :