ঢাকা শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
বান্দরবানে থানচি সীমান্তে খাবারের অভাব

বাঁশ কোড়ল খেয়ে জীবন চালাচ্ছে কয়েকহাজার মানুষ

আকাশ মারমা মংসিং, বান্দরবান

প্রকাশিত: আগস্ট ২৭, ২০২৪, ০১:১১ পিএম

বাঁশ কোড়ল খেয়ে জীবন চালাচ্ছে কয়েকহাজার মানুষ

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

বান্দরবানের থানচি উপজেলার দুর্গম এলাকা মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী ঘেষা পাড়াগুলোতে দেখা দিয়েছে খাদ্যাভাব। ঘরে নাই চাউল, অর্থসহ নানা সাংসারিক অর্থ যোগান। বন্যার কারণে জুমের ফলন ক্ষতি হওয়ায় পর্যাপ্ত ফসল পাননি ওই এলাকার বাসিন্দারা। যার কারণে ৬৪ পরিবারের খাদ্যশস্য না থাকায় বাঁশ কোড়ল খেয়ে জীবনযাপন করছেন কয়েকহাজার মানুষ।  

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, থানচি সদর  থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে ১নং রেমাক্রী ইউনিয়ন। সেখানে মায়ানমার সীমান্তর্বর্তী ঘেষা দুর্গম এলাকাতে বসবাস করছে মেনহাক পাড়া, বুলু পাড়া, তাংখোয়াই পাড়া, য়ংডং পাড়ায় প্রায় ৬৪টি পরিবার। তাদের প্রধান উৎস জুম চাষ। জুম চাষ করে সেসব পরিবারের খাদ্যে যোগান জোগায়। কিন্তু বন্যার কারণে জুমের ফলন ক্ষতি হওয়ায় সেসব দুর্গম এলাকাগুলোতে ৯টি গ্রামে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। তাদের ঘরের নেই কোন ধান ও চাউল কিংবা অর্থ। বছর পেরোনোর আগে গত মে মাস থেকে তাদের খাদ্য সমস্যা দেখা দিয়েছে। এরপর থেকে বিভিন্ন মানুষ থেকে ধার দেনা করে কোন রকম খেয়ে বেঁচে আছে। খাদ্য যোগান দিতে  প্রতিদিন জঙ্গল থেকে বাঁশ কোড়ল খুজে সিদ্ধ করে দিনের পর দিন পার করছেন। ফলে প্রতিদিন ১ পট চালের সঙ্গে বাঁশ কোড়ল সিদ্ধ দিয়ে প্রতিনিয়ত জীবন সংগ্রাম চালাতে হচ্ছে সেসব বাসিন্দাদের।

সীমান্তর্বর্তী বাসিন্দারা জানান, সীমান্তর্বর্তী পাড়াগুলোতে যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম নদীপথ। এই নদীর পথ ছাড়া সেসব এলাকাতে যাওয়া কোন উৎস নাই। তাদের একমাত্র খাদ্যের প্রধান উৎস জুম চাষ। জুমের ধান ও ফলন ভালো হলে পরিবারের অভাব কিছুটা কমে। আর ফলন ক্ষতি হলে বছর জুড়ে দেখা দেয় খাদ্যের অভাব। ঘরের কিছু অর্থ থাকলেও  সাঙ্গু নদীর পানি বাড়ার ফলে সদর বাজারে যেতে পারছেন নাহ। কেননা  বর্ষা মৌসুমে নদী পথে পণ্য আনা নেওয়ার খরচও দ্বিগুন বেশি। এমন দুর্ভোগের দিনে প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের প্রতি পাশে দাঁড়ানো আহ্বান জানান সীমান্তর্বর্তী বসবাসকারী।

সীমান্তর্বর্তী এলাকার আদাপাড়ার বাসিন্দা ঙৈলিং ম্রো বলেন, এখানে প্রায় আটটি গ্রামের শতাধিক মানুষ সরকার কিংবা প্রশাসন বলেন কোন জায়গা থেকে সহযোগিতা পাচ্ছি নাহ। এই বছরে বন্যার কারণে জুমের ধান নষ্ট হয়ে গেছে‍‍` এতে আমাদের খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। প্রায় তিন মাস থেকে বাঁশ কোড়ল খাচ্ছে গ্রামবাসীরা। আমি নিজের চোখে দেখছি। সরকার থেকে কিছু পায় না।

কয়েকটি এলাকার গ্রামপ্রধান কারবারি বুলু ম্রো, মেনহাত ম্রো, এবং চিংক্রা ম্রো জানান, গত বছর অতিবর্ষণের কারণে চাষিরা তেমন ফসল পায়নি। থানচির রেমাক্রী ইউনিয়নে মিয়ানমার সীমান্তর্বর্তী ১৩টি পাড়া। এর মধ্যে ৪টি পাড়ার প্রায় ৬৪টি পরিবারে খাদ্য অভাব দেখা দিয়েছে। এদের ঘরে কোনো চাল নেই। জঙ্গল থেকে বাঁশ কোড়ল সংগ্রহ করে সিদ্ধ করে তিনবেলা খাবার খাচ্ছে। বাকি ৯টি গ্রামের জুমের ধান প্রায় শেষের পথে। তাদের মধ্যে যাদের ঘরে ধান আছে তারা একজন আরেকজনকে ধান দিয়ে সাহায্য করছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সদর থেকে নৌপথে প্রায় কয়েক ঘন্টা যেতে হয়। এরপর হেটে যেতে সীমান্তে গ্রামে পৌছাতে সময় লাগে আরো ঘন্টাখানিক। সেখানে শিশুরা গ্রামে হাউ মাউ করে কাঁদতে আছে ক্ষিধের জ্বালায়। পাশে বসা মায়ের চোখে মুখের আর্তনাদ বলে দিচ্ছে তাদের প্রচণ্ড ক্ষুধা। রান্না করার মত ঘরে কিছু নেই। চাল ধার করতে বিভিন্ন গ্রামে ঘুরছে পরিবার। ঘরের ফিরে যেন সন্তানদের মুখে এক মুঠো ভাত তুলে দিতে পারেন। আবার কেউ কেউ জুমের ধান পরিপক্ব হতে না হতে নিয়ে আসছে বাড়িতে। কাঁচা ধান চুলায় সিদ্ধ দিয়ে তারপরে শুকানো হয় চুলার উপরে। পরে আবার চালের জন্য মাড়াই করতে হয় ঢেঁকিতে। 

থানচি সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান খামলাই ম্রো জানান, মিয়ানমার সীমান্তর্বর্তী ৪টি পাড়ায় ৫০-৬৪টি পরিবার বাস করে। ওই খানে ম্রো এবং ত্রিপুরারা বাস করে। তাদের অবস্থা খুবই করুণ। বাঁশ কোড়ল খেয়ে জীবনযাপন করছে। নদীতে পানির স্রোত বেশি এবং অর্থাভাব থাকায় সদরে গিয়ে চাল কেনার মতো টাকা তাদের নেই।

রেমাক্রি ইউপি চেয়ারম্যান মুই শৈথুই মারমা বলেন, খাদ্য সংকটের কথা বিষয়ে উপজেলা নিবাহী অফিসারকে অবগত করেছি। সেসব এলাকাতে একটন খাদ্যশস্যে দেয়া হবে।  পরবর্তীতে নিবাহী অফিসার জেলা প্রশাসকের সাথে কথা বলে যা করণীয় করবেন বলে জানান এই জনপ্রতিনিধি।

থানচি ইউএনও মোহাম্মদ মামুন জানান, রেমাক্রি ইউনিয়নটা অত্যন্ত দুর্গম এলাকায় অবস্থিত। লিক্রি, তাংখোয়াই পাড়াসহ আরও কিছু পাড়া নেটওয়ার্ক বিহীন। একেবারে যোগাযোগ সহজে করা যায় না। ওইখানে বেশ কিছু পাড়ায় খাদ্য ঘাটতি রয়েছে। রোববার দুটি নৌকা করে ১ টন চাল আমরা পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।

আরবি/জেডআর

Link copied!