ঢাকা: বিগত আওয়ামী লীগের পুরো ১৫ বছর ক্ষমতার জোরে কেরানীগঞ্জে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা সিদ্দিকর রহমান ওরফে গলাকাঁটা সিদ্দিক এবার দল বদল করে আবারো তার পুরানো রুপে ফিরেছেন। স্থানীয়দের নানাভাবে ম্যনেজ করে পুনরায় শুরু করেছেন তার ভূমি দখল ও নির্যাতনের সাবেকী কার্যক্রম। ৫ আগষ্ট পালিয়ে যাওয়ার পর সম্প্রতি কেরানীগঞ্জে ফিরেছেন মূর্তিমান আতংঙ্ক গলাকাঁটা সিদ্দিক। তার ফিরে আসায় স্থানীয় অনেকেই বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বানচাল করতে গালকাঁটা সিদ্দিক ও তার বড় ছেলে সাব্বির আহম্মেদ তাদের সন্ত্রাসী বাহিনীসহ নিজেরা উপস্থিত থেকে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে ছাত্র-জনতার উপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। তাদের গুলিতে তারানগর ইউনিয়নের রিয়াজ উদ্দিন নামে এক ব্যাক্তি মৃত্যুবরণ করেন। এরপর বিক্ষুদ্ধ জনতার হাত থেকে বাঁচতে গণঅভ্যুত্থনের পরই বাপ-ছেলে কেরানীগঞ্জ ছেড়ে পালিয়ে যান।
সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, মূলত কেরানীগঞ্জের আওয়ামী লীগ দলীয় পলাতক সাবেক সংসদ সদস্য এ্যাড. কামরুল ইসলামের আশ্রয়-প্রশয়েই উত্তর কেরানীগঞ্জে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন সিদ্দিক। কামরুলের প্রশয়ে এমন কোন অপকর্ম নেই যা তিনি করেননি। বিশেষ করে কেরানীগঞ্জের আটিবাজার, তারানগর ও বড় মনোহরিয়ায় তার চাঁদাবাজী, মাদক ব্যবসা ও অন্যের জমি দখলে সন্ত্রাসীদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন এক বিশাল সিন্ডিকেট। তার অপকর্মে কেউ বাধা হয়ে দাড়ালে সে আর রক্ষা পেতনা। এসব কারণে সিদ্দিক ও তার বড় পুত্র সাব্বিরের বিরুদ্ধে কেরাণীগঞ্জ মডেল থানাসহ বিভিন্ন থানায় প্রায় ৩২টি মামালা রয়েছে।
স্থানীয়রা জানায়, কেরানীগঞ্জের মৃত বোরহান উদ্দিনের ছেলে আবু বকর সিদ্দিকই এখন গলাকাঁটা সিদ্দিক। তার অপকর্মে কেউ বাঁধা হয়ে দাড়ালে ধরে এনে গলা কেটে দিয়ে পৈত্রিক নামের সাথে উপাধী হিসেবে যুক্ত করেছেন ‘গলাকাটা সিদ্দিক’। এ নামেই এখন ব্যাপক পরিচিতি তার। শেখ হাসিনার পলায়নের দিনই পালিয়ে গেলেও সম্প্রতি স্থানীয় একাধিক প্রভাবশালী ব্যাক্তিদের ম্যানেজ করে আবারো এলাকায় ফিরে পুরানো ব্যবসায় ফেরার চেষ্টা করছেন সিদ্দিক।
কয়েকটি এলাকা ঘুরে জানা গেছে, আবু সিদ্দিক ওরফে গালকাঁটা সিদ্দিকের পুরো পরিবার এক সময় মুসলিম লীগের অনুসারী ছিলো। পরবর্তীতে জাতীয় পার্টিতে যোগদান করলেও ২০০৯-এ দল বদল করে আওয়ামী লীগের পালে হাওয়া দেন। তখন তার নানা অপকর্ম ফাঁস হয়ে যাওয়ায় আওয়ামী লীগ থেকে কয়েকবার সাময়িক বহিষ্কারও হন। যদিও পলাতক সাবেক সংসদ সদস্য এ্যাড. কামরুল ইসলামের প্রভাব আর অর্থের শক্তি খাঠিয়ে আবারো কেরানীগঞ্জ আওয়ামী লীগের নতুন কমিটিতে আবার ¯’ান করে নেন তিনি। দলীয় পদ ফিরে পাওয়ার পর থেকে গলাকাঁটা সিদ্দিক হয়ে উঠেন আরোও বেপরোয়া। তার অপকর্ম, চাঁদাবাজী, বেপরোয়া চলাফেরা, নৈরাজ্য ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পান না। প্রতিবাদ করলেই মারধর ও ঘরবাড়ি ভাংচুর করা হয়। দেয়া হয় মিথ্যা মামলার হুমকি।
তিন সন্তানের জনক আবু সিদ্দিক ওরফে গালকাঁটা সিদ্দিক এক সময়ের গরুর দালাল থেকে কেরাণীগঞ্জের আটিবাজার ও তার আশে পাশের এলাকায় জমি দখল, মাদক ব্যবসা ও জুয়ার আসর বসিয়ে অবৈধ অর্থ উপার্জন করেছেন। এসব অপকর্ম নির্বিগ্নে করতে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তোলেন। এই সন্ত্রাসী বাহিনী বেশ আগে থেকেই স্থানীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ব্যাবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে আসছিলো। কেউ চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তার ও তার পরিবারের ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান ভাংচুর ও ধরে নিয়ে মারধর করা হতো।
গালকাঁটা সিদ্দিকের পুত্র সাব্বিরেরও রয়েছে সন্ত্রসী বাহিনী। তার নেতৃত্বে এই সন্ত্রাসী বাহিনী কেরানীগঞ্জম আটিবাজার, তারানগর, বাংলানগর, চন্ডিপুর ও ভাওয়ালের সাধারণ একজন ব্যবসায়ীও রেহাই পায়-নি। তার অত্যাচার থেকে বাদ যায়নি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারাও। সিদ্দিকের নিজেরও লাইসেন্সকৃত একটি অস্ত্র আছে। এক সময় এই লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছিলো। অবৈধ উপার্জিত অর্থ ও এম.পির ক্ষমতা ব্যবহার করে সেই অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিলের আদেশও স্থগিত করেন। এই আস্ত্র ব্যবহার করে নানা অপকর্ম করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয়রা বলছেন, যেমন বাবা তেমনি তার বড় ছেলে সাব্বির আহম্মেদ। বাবার ক্ষমতা এবং অবৈধ অর্থের জোরে তারানগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদ বাগিয়ে নেন। বাবার মতোই এমন কোন অপকর্ম নেই যা তিনি করেনি। গালকাঁটা সিদ্দিকের বড় ছেলে হিসেবে বাবার যত অবৈধ সন্ত্রাসী কর্মকান্ড, মাদক ব্যবসা, চাঁদা উত্তোলন, অবৈধ জমি দখল, এলাকার লোকজনের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়াসহ সব কিছুই করতো এই সাব্বির।
অবৈধ অর্থ ও পালিত সন্ত্রাসী বাহিনী এবং রাজনৈতিক পদের দলীয় প্রভাব খাঠিয়ে আটি বাজার সি,এন,জি ষ্ট্যান্ড, গরুর হাটসহ আটি বাজারের সকল ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান থেকে জোর পূর্বক চাঁদা আদায় করতো সাব্বির। রাজনৈতিক দলের প্রভাব খাটিয়ে থানা পুলিশের সহযোগিতায় বিরোধী দলের নেতা কর্মীদের গ্রেফতার করিয়ে নিজেই গ্রেফতার বাণিজ্যে কোটি কোটি টাকায় নির্মাণ করেছেন ডুপ্লেক্স বাড়ি। এছাড়াও হয়েছেন বিপুল সম্পদের মালিক।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চেয়ে সিদ্দিকের মোবাইলে কয়েকবার ফোন দিলেও তা রিসিভ করেননি। তবে তার বড় ছেলে সাব্বির আহম্মেদ মোবাইলে এই প্রতিবেদককে বলেন, আমরা আওয়ামী লীগ করে কারো উপর কখনো নির্যাতন করিনি। নিয়মতান্ত্রিকভাবে গত ১৫ বছর ব্যবসা করেছি। আমাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো সব ডাহা মিথ্যা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেয়া তথ্যে গালকাঁটা সিদ্দিক ও তার পুত্র সাব্বির আহম্মেদের বিরুদ্ধে কেরানীগঞ্জ মডেল থানাসহ বিভিন্ন থানায় প্রায় ৩০-৩২টি মামালা রয়েছে। মামলাগুলো হচ্ছে- কেরাণীগঞ্জ মডেল থানার মামলা নং- ৯(১)২০১৯। ধারা-১৪৭/১৪৮/৪৪৮/৩২৩/৩২৪/৩২৫/৩২৬/১৪৯/৩০৭/৩৮৫/৩৭৯/৩৮০/৫০৬/১০৯। পেনাল কোড ১৮৬০। ২।
কেরাণীগঞ্জ মডেল থানার মামলা নং- ৪৪ (৩)২০১৯। ধারা- ১৪৭/১৪৮/৪৪৮/৩২৩/৩২৪/ ৪২৭/৪৩৬/১৪৯/৩০৭/৩৮৫/৩৭৯/৩৮০/৫০৬/১০৯। পেনালকোড ১৮৬০। ৩। কেরাণীগঞ্জ মডেল থানার মামলা নং- ৫১ (৪)২০১৯। ধারা- ১৪৩/৪৪৭/৩২৩/৩২৬/৩০৭/৫০৬, পেনাল কোড ১৮৬০। ৪। কেরাণীগঞ্জ মডেল থানার মামলা নং- ২৩ (১১) ২০১৮। ধারা- ১৩৪/৩৪১/৩২৩/৪৩৬/৪২৭/৫০৬, পেনাল কোড ১৮৬০।
৫। কেরাণীগঞ্জ মডেল থানার মামলা নং- ৪৫ (৫) ২০১৮ ধারা-১৪৩/৩২৩/৩২৫/৩৭৯/৫০৬, পেনাল কোড ১৮৬০। ৬। হাজারীবাগ থানার মামলা নং- ৪(৫) ২০১৭। ধারা- ১৪৩/৪৪৮/৩০৭/৩২৭/৩৮০/৪২৭/৫০৬, পেনাল কোড ১৮৬০। ৭। হাজারীবাগ থানার মামলা নং- ১৭(৬)২০১৭। ধারা- ১৪৩/৩৪১/৩২৩/৩৫৪/৩৭৯/৫০৬/৩৪, পেনাল কোড ১৮৬০।
আপনার মতামত লিখুন :