ঢাকা শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

পালিয়েছে ধামরাইয়ের ১৩ ইউপি চেয়ারম্যান

মো. সজল আলী, ধামরাই

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৪, ০৫:৪৯ পিএম

পালিয়েছে ধামরাইয়ের ১৩ ইউপি চেয়ারম্যান

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

উপজেলার ১৬ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের মধ্যে ১৩ জনই হত্যা মামলার আসামি হয়ে পালিয়ে  রয়েছেন। এতে প্রতিদিন হাজারো সাধারণ মানুষ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ঢাকার ধামরাইয়ে কলেজছাত্র আফিকুল ইসলাম সাদ নিহতের ঘটনায় সাবেক দুই এমপি বেনজীর আহমদ ও এম এ মালেক এবং পৌর মেয়র আলহাজ গোলাম কবিরসহ ৬২ জন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর নামে মামলা হয়েছে। বাদ পড়েনি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরাও।

উপজেলার কুশুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও কুশুরা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি নূরুজ্জামান। সাবেক এমপি আলহাজ বেনজীর আহমদের আপন ভগ্নিপতি। দলীয় প্রতীক নৌকা নিয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পাশ করেন। প্রতিপক্ষ কাউকে মাঠে থাকতে দেননি। একমাত্র চেয়ারম্যান নূরুজ্জামান সাবেক এমপির ভগ্নিপতি হওয়ায় প্রভাব খাটিয়ে ২৫টি প্রকল্পে প্রায় ৬০ লাখ টাকা অনুদান নিয়েছেন। একটি ইউনিয়ন পরিষদের নামেই বার বার প্রকল্পের নাম পরিবর্তন করে হাতিয়ে নেন এ টাকা। প্রকল্পের নামে কিছু কাজ করে বাকিটা নাকি চেয়ারম্যানের নিজের পকেট ভারী করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কারণ অসংখ্য কাঁচা রাস্তার কোনো কাজই তিনি করেননি। পরিষদের ইউপি সদস্যরা ছিল তার কাছে নির্যাতিত। চেয়ারম্যান আফিকুল ইসলাম সাদ হত্যা মামলার ৩৪নং আসামি। আত্মগোপনে থাকায় পরিষদে সেবা স্থগিত রয়েছে।

উপজেলার বাইশাকান্দা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান মিজান। তিনি ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এবং সাবেক এমপি বেনজীর আহমদের একান্ত কাছের লোক। বেনজীর আহমদের প্রভাব খাটিয়ে যা ইচ্ছে তাই করতেন তিনি। আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। এলাকার তেমন কোনো উন্নয়নে কাজ করেননি। নামে মাত্র রয়েছে  নানা প্রকল্প। এমনও প্রমাণ রয়েছে একটি রাস্তার নামে দুইবার প্রকল্পের টাকা পাশ হয়েছে কিন্তু ওই মাটির রাস্তার কোনো কাজই হয়নি। ভোগান্তির স্বীকার হয়েছেন হাজারো মানুষ। তিনি সাদ হত্যা মামলার ৭নং আসামি।

উপজেলার সানোড়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক খালেদ মাসুদ খান লাল্টু। সাবেক এমপি বেনজীর আহমদের অত্যন্ত কাছের লোক বলে পরিচিত। এমপির পৃষ্ঠপোষকতা একচেটিয়া ঠিকাদারি ব্যবসা করে গেছেন। রয়েছে একাধিক ইটভাটা এবং আলিশান বাড়ি। চলাচলের জন্য রয়েছে ব্যক্তিগত গাড়ি। সবসময় বেশ কিছু দলীয় লোক পোষণ করতেন। তিনি নাকি চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে রয়েছেন নাকি আত্মগোপনে এ নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা। তিনি সাদ হত্যা মামলার ১০নম্বর আসামি।

উপজেলার কুল্লা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান লুৎফর রহমান। কোনোদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন না। ইউপি চেয়ারম্যান হওয়ার আগেই মানুষের কাছে আতঙ্ক ছিল লুৎফর চেয়ারম্যান। ইউপি চেয়ারম্যান হওয়ার পর জনগণ দেখেন তার আসল চেহারা। রয়েছে একাধিক ইটভাটা। জোরপূর্বক অন্যের জমির মাটি কাটাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। নিরীহ মানুষের বাড়ি দখল এমনকি মানুষের হাত পা ভেঙে দেয়ার প্রমাণ রয়েছে। এ নিয়ে মামলার আসামিও হয়েছেন। সাবেক  এমপি বেনজীর আহমদের আস্থাভাজন ছিলেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেও বেনজীর আহমদের আস্থাভাজন বলে পাশও করে যান। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত আফিকুল ইসলাম সাদ হত্যা মামলার ৪৫ নম্বর আসামি হয়ে বর্তমানে আত্মগোপনে রয়েছেন। অপরদিকে সেবা বঞ্চিত হচ্ছে ইউনিয়ন বাসিরা।

অন্যদিকে  সূয়াপুর ইউনিয়ন প্রবীণ চেয়ারম্যান কফিল উদ্দিন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। শুরু থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। নিজে কোনো অন্যায়ের সাথে জড়িত না থাকলেও নানা বিষয়ে আধিপত্য বিস্তারের অভিযোগ রয়েছে তার বড় ছেলে আব্দুল হালিমের বিরুদ্ধে। তিনি একচেটিয়া ওই ইউনিয়নে ফসলি জমির মাটি ভেকু দিয়ে মাটি কেটে ইটভাটায় বিক্রি করা, অন্য মাটি ব্যবসায়ীরা তাকে চাঁদা না দিলে কোনো ব্যবসা করতে পারতেন না। সকল বিচার চেয়ারম্যানের ছেলে করত। ইউনিয়ন পরিষদ ছিল চেয়ারম্যানের ছেলের দখলে। নিজস্ব দলীয় বাহিনীও ছিল। কফিল উদ্দিন চেয়ারম্যান সাদ হত্যা মামলার ৪৬ নম্বর আসামি। সাথে ছেলে আব্দুল হালিমও মামলার ৪৭ নম্বর আসামি। বর্তমানে বাবা ছেলে দুজনই রয়েছেন আত্মগোপনে। ইউনিয়ন পরিষদের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন নাগরিকরা।

উপজেলার সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মশিউর রহমান ও নান্নার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন মোল্লা। দলীয় কোনো পদ-পদবি নেই। স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে জয় লাভ করেন। কিন্তু নান্নার  ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন মোল্লা বিএনপির হলেও সাবেক এমপি বেনজীর আহমদের চত্র-ছায়ায় ছিলেন। সাদ হত্যা মামলার ৪৩ নম্বর আসামি সদর ইউপি চেয়ারম্যান মশিউর রহমান ও ৬৪ নম্বর আসামি নান্নার ইউপি চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন মোল্লা। অথচ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পর দুজনই পরিষদে উপস্থিত থেকে অফিস পরিচালনা করেছেন।

রোয়াইল ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা কাজিম উদ্দিন এবং গাঙ্গুটিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল কাদের মোল্লা। দুজনই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। দলীয় প্রতীক নৌকা নিয়ে দুজনই জয় লাভ করেন। তবে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সরকার পতনের পর থেকেই তারা পরিষদে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু সাদ হত্যা মামলার ৫৭ নম্বর আসামি কাজিম উদ্দিন চেয়ারম্যান এবং ৩৬ নম্বর আসামি আব্দুল কাদের মোল্লা। বর্তমানে মামলার আসামি হয়ে আত্মগোপনে থাকায় ইউনিয়ন পরিষদের সকল প্রকার সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে হাজারো মানুষ। সোমভাগ ইউনিয়ন পরিষদের প্রভাবশালী চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আওলাদ হোসেন।

পরিবারের সকলেই বিএনপির সক্রিয় রাজনীতির সাথে জড়িত থাকলেও একমাত্র আওলাদ হোসেন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের সদস্য পদ ছাড়া পাননি কোনো বড় পদ। স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে দুইবারের সাবেক চেয়ারম্যান নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আজাহার আলীকে পরাজিত করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে থাকেন। কারণ সাবেক আওয়ামী লীগের এমপি হলেও বেনজীর আহমদের আশির্বাদের হাত ছিল আওলাদ হোসেনের উপর। নির্বাচনের পরই আওলাদ হোসেনের আসল চরিত্র ফুটে উঠে। প্রতিটি কল কারখানার ট্রেড লাইসেন্স নিতে দিতে হয় মোটা অঙ্কের টাকা। এছাড়াও কবর স্থান ভরাটের কথা বলে একটি কারখানা থেকে মাটি নিয়ে ইটভাটায় বিক্রির অভিযোগ রয়েছে আওলাদ হোসেনের নামে। সাদ হত্যা মামলাব ৪৪ নম্বর আসামি হয়ে বর্তমানে আত্মগোপনে রয়েছেন তিনি। 

উপজেলার যাদবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান মিজু আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত থাকলেও দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করে জয় লাভ করেন। সাবেক এমপি বেনজীর আহমদের সাথে খুব একটা বনিবনা হতো না। তবে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সাদ হত্যা মামলার ৩৩ নম্বর আসামি হয়ে তিনিও রয়েছেন পর্দার আড়ালে বালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মজিবর রহমান। যিনি আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়নে নৌকা প্রতীক নিয়ে জয় লাভ করেন। মজিবর রহমান এলাকায় একজন চিহ্নিত মাটি খেকু নামে পরিচিত। একচেটিয়া দুই ফসলি তিন ফসলি জমির মাটি কেটে ইট ভাটায় বিক্রি এমনকি নিজেরও রয়েছে একাধিক ইটভাটা। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে একক আধিপত্য বিস্তারের । তিনি সাদ হত্যা মামলার ৩০ নম্বর আসামি। তিনিও রয়েছেন আত্মগোপনে। উপজেলার আমতা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আরিফ হোসেন। নিজের বেশ প্রভাব রয়েেছ এলাকায়। চেয়ারমানে হয়ে ভাগিয়ে নেন উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতির পদ। সাবেক এমপি বেনজীর আহমদের আস্থাভাজন ছিলেন। তবে গোপনে সাবেক এমপি এম এ মালেকের অনুসারীও ছিলেন। সাদ হত্যা মামলার ২৬ নম্বর আসামি আরিফ হোসেন।উপজেলার বাসিন্দারা  বিকল্প ব্যবস্থার মাধ্যমে সেবা প্রদানের  দাবি জানান।

আরবি/জেডআর

Link copied!