ঢাকা শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

‘সুরক্ষা কর্ণার’ এ সুরক্ষিত থাকুক আমাদের শিশুরা

আক্কেলপুর (জয়পুরহাট) প্রতিনিধি

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১১, ২০২৪, ০৫:০৬ পিএম

‘সুরক্ষা কর্ণার’ এ সুরক্ষিত  থাকুক আমাদের শিশুরা

মনজুরুল আলম। ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

মালিহার মাসিক বা পিরিয়ড একসময় তার জন্য উদ্বেগ ও লজ্জার কারণ ছিল, কিন্তু যখন থেকে তার স্কুলে বিনামূল্যে স্যানিটারি প্যাড বিতরণ এবং পিরিয়ডের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া শুরু হয়েছে, তারপর থেকে এটা আর তার কাছে লজ্জার বা লুকানোর মতো নিষিদ্ধ কোন বিষয় নয়। মালিহার স্কুল জয়পুরহাট জেলার আক্কেলপুর উপজেলায়।

১১বছর বয়সী মালিহা বলেন, “আমি এক সময় পিরিয়ড চলাকালে স্কুলে যেতে বিব্রত বোধ করতাম। আগে স্যানিটারি ন্যাপকিন পাওয়া বা সেগুলো ব্যবহারের পর অপসারণের কোনো জায়গা ছিল না। এখন এমনকি আমি পিরিয়ডের সময়ও স্কুল কামাই দেইনা।’’

পিরিয়ড মেয়ে থেকে নারীতে রূপান্তরিত হওয়ার পথে একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অংশ, তা সত্ত্বেও বাংলাদেশে এই বিষয়টি নিয়ে খুব কমই খোলামেলা কথা হয়। ২০১৮ সালের জাতীয় হাইজিন বা স্বাস্থ্যবিধি সমীক্ষা অনুসারে, মাত্র ৫৩ শতাংশ স্কুলগামী কিশোরী তাদের প্রথম পিরিয়ড হওয়ার আগে এ সম্পর্কে জানতে পারে।

মাসিক স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে কোনো দিকনির্দেশনা না পাওয়ায় বা স্যানিটারি প্যাড কেনার মতো টাকা না থাকায় অনেক মেয়েকেই তাদের নিজেদের মতো করে বয়ঃসন্ধিকালীন সময় পার করতে গিয়ে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। তাছাড়া, বিশেষ করে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে স্যানিটারি ন্যাপকিনকে বিলাসপণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এমনকি স্যানিটারি ন্যাপকিন সাশ্রয়ী হলেও মেয়ে ও নারীরা সেগুলো কেনা থেকে বিরত থাকে। কারণ ফার্মেসি ও দোকানগুলোতে সাধারণত পুরুষ কর্মীরাই থাকেন।

পিরিয়ড ব্যবস্থাপনায় সমস্যা স্কুল উপস্থিতির ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কিশোরী পিরিয়ড চলাকালে প্রতি মাসে কয়েকদিনের জন্য স্কুল কামাই দেয়। অনেকেই শ্রেণিকক্ষে বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে এটি করে।

কন্যা শিশুরা শিশুকাল থেকেই ইভটিজিং, যৌন হয়রানি, অপহরন ধর্ষনের ন্যায় নানা অন্যায়ের  শিকার হয়। এমনকি বিদ্যালয়ে পড়তে এসেও তাদেরকে বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশের সন্মুখীন হতে হয়।  কন্যা শিশু শিক্ষার্থীদের এরুপ সমস্যার কথা চিন্তা করে অভিভাবকেরা যেন সম্পূর্ণ চিন্তামুক্তভাবে তাদের কন্যা শিশুদের বিদ্যালয়ে প্রেরণ করতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রেখে উপজেলা প্রশাসন আক্কেলপুর  ইনোভেটিভ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে প্রতিটি বিদ্যালয়ে একটি করে স্বাস্থ্য সম্মত সুরক্ষা কর্ণার স্থাপন করে। সেখানে কন্যা শিশুর জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ  সুরক্ষা উপকরণ সংরক্ষণ করা হয়েছে এবং কন্যা শিশুদের দৈনন্দিন নানাবিধ উদ্ভুত সমস্যা সমাধানকল্পে শিশুদের  মনের কথা নামক একটি বক্স স্থাপন করা হয়েছে যাতে শিশুরা তাদের সমস্যার কথাগুলো লিখে ঐ বক্সে ফেলতে  পারে এবং প্রতি ৩/৫ দিন পর পর মনের কথা নামক বক্সটি খুলে শিশুদের সমস্যা সমাধানের জন্য প্রতিষ্ঠান প্রধান কর্তৃক মনোনীত একজন শিক্ষিকা ফোকাল পার্সন/মেন্টরিং এর দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়াও কন্যা শিশুদের শারীরিক, মানসিক ও আইনি সহায়তা প্রাপ্তির লক্ষ্যে সুরক্ষা কর্ণারে বিভিন্ন হটলাইন নম্বরসমুহ (৯৯৯, ১০৯, ১০৯২১, ১০৯৮, ৩৩৩, ১৬৪৩০, ১৬২৬৩) ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার, উপজেলা স্বাস্থ্য ও প: প: কর্মকর্তা, অফিসার ইনচার্জ, সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্টাল কর্মকর্তা, উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা, প্রতিষ্ঠান প্রধান ও সুরক্ষা কর্ণারের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষিকার মোবাইল ফোন নম্বর সম্বলিত চার্ট প্রদর্শিত রয়েছে।

প্রতিটি স্কুলে একজন শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যার দায়িত্ব হলো হাইজিন কর্নারে সবসময় স্যানিটারি ন্যাপকিন পর্যাপ্ত মজুত রাখা এবং পিরিয়ড ও পিরিয়ড-কালীন স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে ছাত্রীদের জানানো।

মালিহার স্কুলে যেসব মেয়ের আর্থিক সামর্থ্য রয়েছে তারা ‘সততা স্টোর’ থেকে স্যানিটারি প্যাড কিনতে পারে। সেখানে শিক্ষার্থীরা কারো কোনো নজরদারি ছাড়া নিজেরাই টাকার বিনিময়ে খাবার এবং নোটবুক, পেন্সিল ও কলমের মতো প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে পারে। অনেক মেয়ের জন্য এটি অন্য কাউকে জানতে না দিয়ে কোনো ধরনের অস্বস্তি ছাড়া স্যানিটারি প্যাড পাওয়ার একটি সুবিধাজনক উপায়।

হাইজিন কর্নার চালু হওয়ার পর থেকে স্কুলে মেয়েদের উপস্থিতি ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তথ্য-প্রমাণ বলছে, স্কুলে অনুপস্থিতি মেয়েদের জন্য উদ্বেগজনক পরিণতি বয়ে আনতে পারে। তারা পড়ালেখায় পিছিয়ে পড়তে শুরু করে, যার ফলে তাদের গ্রেড খারাপ হতে পারে। এটি তাদেরকে স্থায়ীভাবে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য তাদের অভিভাবকদের মত তৈরিতে যথেষ্ট। আর স্কুলের বাইরে থাকা মেয়েরা শিশু বিয়ের শিকার হওয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে থাকে।

মালিহার শিক্ষিকা  মুনমুন মোস্তারী তৃণা বলেন, “কন্যা শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষা, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, ইভটিজিং ও যৌননিপীড়িন প্রতিরোধকল্পে উপজেলা প্রশাসন আক্কেলপুর এর অভিনব  ইনোভেটিভ কার্যক্রম ‍‍`সুরক্ষা  কর্ণার ‍‍` খুবই ফলপ্রসু উদ্যোগ  এবং এই কর্নার  থাকাটা অপরিহার্য। এটি ক্লাসে মেয়েদের অনুপস্থিতি কমায়, যা মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে সাহায্য করে। অবিভাবকদের নিশ্চিন্তে  তাদের কন্যা শিশুটিকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে সহায়তা  করে।”

 

লেখক-

মনজুরুল আলম,

উপজেলা নির্বাহী অফিসার,

আক্কেলপুর, জয়পুরহাট।

আরবি/জেডআর

Link copied!