শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবার পর থেকে চলমান পরিস্থিতিতে আত্মগোপনে চলে গেছেন যশোর জেলা ও উপজেলার আলোচিত আওয়ামী লীগের নেতারা।
এদিকে নেতৃত্ব শূন্য সংকটময় এ দিনগুলোতে বাড়িঘরে হামলা-ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনায় চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তাদের কর্মী-সমর্থকরা। দলীয় একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সবশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদে জেলার ৬টি সংসদীয় আসনের সব কয়েকটিতে আধিপত্য ছিল আওয়ামী লীগের। তবে শেখ হাসিনার পতনের পর তাদের কেউ পালিয়ে গেছেন বিদেশে। কেউবা রয়েছেন আত্মগোপনে। শুধু এমপিরাই নয়; জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের প্রায় সব নেতাকর্মীই রয়েছেন আত্মগোপনে। তাদের ফোনও বন্ধ রয়েছে। এ কারণে কারও বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
বিভিন্ন সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যশোর-১ (শার্শা) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শেখ আফিল উদ্দিনের কোনো খোঁজ মিলছে না। বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করে তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। ৫ আগস্টের পরের দিন সুযোগ বুঝে যশোর ছেড়েছেন। তবে বর্তমানে তিনি কোথায় আছেন তার কোন খবর কেউ দিতে পারছে না। তার বিরুদ্ধে জমি দখল মারপিটের মামলা হয়েছে যশোর আদালতে। দুদক থেকে সম্পদের হিসেব চাওয়া হয়েছে। তার জুট মিলে হামলা চালিয়ে ভাংচুরও করা হয়।
যশোর-২ (চৌগাছা-ঝিকরগাছা) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ডা. তৌহিদুজ্জামান তুহিনের নিকটতম কয়েকজন অনুসারীর কাছ থেকে জানা যায়, দেশের চলমান অস্থিরতা শুরু হওয়ার পর তিনি এলাকা ছেড়ে ঢাকাতে চলে যান। পরে আর এলাকায় ফেরেননি। তিনি ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালের ডাক্তার।
এদিকে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী যশোর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদেরও খোজঁ মিলছে না। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, তিনি ৪ আগস্ট ঢাকা থেকে যশোর এসে বিকেলে দলীয় একটি বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নেন। পরদিন শেখ হাসিনার পতনের খবর পেয়ে ওই সময়ই তিনি হেলিকপ্টারযোগে যশোর ছাড়েন। এখনো কোন মামলা না হলেও দুদকের জালে আটকা পড়েছেন তিনি। যশোর থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় তার ব্যবহৃত কালো রঙের প্যারোডো গাড়িটি বিমানবন্দর এলাকার কলোনীপাড়ার খালপাড়ে ফেলে রেখে চলে যান।
কিন্তু সরকারের পতনের খবরে তার কাজীপাড়ার বাসায় বিক্ষুব্ধ জনতা হামলা করে ইটপাটকেল মারে।
যশোর-৪ (বাঘারপাড়া ও অভয়নগর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এনামুক হক বাবুল এলাকা ছেড়ে গোপন কোন স্থানে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। তার নিকটজনেরা জানান, বাবুল এই প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তার বিরুদ্ধে জনরোষ কিছুটা হলেও কম। তবে যেহেতু দেশে একটা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সংসদ বিলুপ্ত করা হয়েছে তাই তিনি নিজের ও পরিবারের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষায় একটু গোপনে আছেন।
যশোর-৫ আসনের (মনিরমাপুর) সাবেক সংসদ সদস্য ইয়াকুব আলী যশোরে ছিলেন। সরকার পতনের পর তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা রাতের অন্ধকারে পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকায় পাড়ি জমিয়েছেন বলে জানা গেছে। তাকে না পেয়ে বিক্ষুব্ধ জনতা তার বকচরের বাড়িতে চড়াও হয়ে ভাংচুর করেছে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে আদালতে।
যশোর-৬ (কেশবপুর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আজিজুল ইসলাম ঢাকায় গা ঢাকা দিয়েছেন। তিনি বর্তমানে কোথায় আছেন তা তার নিকটতম কেউ জানেন না। একাধিক সূত্রের মাধ্যমে তার স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারাও তার খোঁজ জানেন না বলে জানান। তার পিএসের বাড়ি থেকে সরকারি চাল আটকের খবরও আছে।
এদিকে যশোরের বহুল আলোচিত রাজনৈতিক নেতা যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি শাহীন চাকলাদার ঢাকা না বিদেশে আছেন সেটা কেউ বলতে পারছেন না। গত ৫ আগস্ট সন্ধ্যা পর্যন্ত যশোরে অবস্থান করছিলেন। এরপর তার ১৪ তলা হোটেল, বাসাবাড়ি ও দলীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্ধ জনতা ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ শুরু করলে তিনি যশোর ছেড়ে পালিয়ে যান। তার বিরুদ্ধে দুদক থেকে সম্পদের হিসাব চাওয়া হয়েছে।
এছাড়াও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন, কোতয়ালী আওয়ামীলীগের সভাপতি মোহিত কুমার নাথ, সাধারণ সম্পাদক শাহারুল ইসলাম, জেলা আওয়ামী লীগের নেতা সাবেক পৌর মেয়র জহিরুল চাকলাদার রেন্টু, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মোস্তফা ফরিদ আহমেদ চৌধুরী, শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহামুদ হাসান বিপু, পৌর কমিশনার হাজী সুমন, হিটার নয়ন, ডিম রিপন, স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা আসাদুজ্জামান মিঠু, সাধারণ সম্পাদক নিয়ামত উল্লাহসহ যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগ, ছাত্রলীগ, মহিলালীগ, যুব মহিলা লীগ, শহর ছাত্রলীগসহ উল্লেখযোগ্য কোন নেতাই নেই শহরে। এমনকি তারা কেউ নিজ নিজ বাসাবাড়িতেও নেই। দলীয় অফিস খা খা করছে। বিক্ষুব্ধ জনতার রোষানলে পড়ার ভয়ে দলের মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের বিপদের মুখে ফেলে এভাবে দলের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সব নেতাদের গা ঢাকা দেওয়াকে কর্মী সমর্থকরা বলছেন বেঈমানী।
এতোদিন যে সব নেতার নির্দেশে কর্মী সমর্থকরা অপকর্ম করেছে এখন তাদেরকে বিপদের ফেলে সেসব নেতাদের পালিয়ে যাওয়াকে কাপুরুষকতা বলছেন মাঠের কর্মী সমর্থকরা। এদের অনেকের বিরুদ্ধে হত্যা, ভাংচুর, নির্যাতনেরে মামলা হয়েছে আদালত ও থানায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন বলেন, আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার প্রতি তৃণমূলের কর্মীদের এতদিন যে আস্থা ছিল, তা এখন আর নেই। তাদের কেউই কল্পনা করতে পারেননি শেখ হাসিনা এভাবে দেশত্যাগ করবেন। এমন পরিস্থিতিতে তাদের মনোবল ভেঙে গেছে। একইসঙ্গে শেখ হাসিনা যে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হবেন, সেটাও কেউ কোনোদিন কল্পনা করতে পারেননি।
বিএনপির শার্শা উপজেলার যুগ্ম আহবায়ক আবুল হাসান জহির বলেন, ‘স্বৈরশাসক দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে জনগণকে কোনঠাসা করে রেখেছিল। ভয়ে জনগণ মুখ খুলতে পারেনি। ছাত্র-জনতা গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশটাকে আবার স্বাধীন করেছে। এ বিজয় ধরে রাখতে হলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।’
আপনার মতামত লিখুন :