ঢাকা রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

নিষেধাজ্ঞার পরও নোট-গাইডের রমরমা বাণিজ্য!

উৎপল দাশগুপ্ত
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২৫, ০১:১৪ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

চলতি শিক্ষাবর্ষের প্রায় দুই মাস পার হতে চললেও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) বিনা মূল্যের প্রাথমিক ও  মাধ্যমিক শ্রেণির প্রায় সাত কোটি পাঠ্যবই এখনো ছাপানো হয়নি।

এতে শতভাগ শিক্ষার্থী এখনো মূল বই না পেলেও সহায়ক বইয়ের নামে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের দশম শ্রেণির নোট-গাইড বই দেদার  বিক্রি হচ্ছে রাজধানীর বাংলাবাজারে।

তবে ‘পাঠ্যবই ছাপা শেষ না হওয়া পর্যন্ত’ নোট-গাইড বই ছাপার বিষয়ে সরকারের কঠোর অবস্থান ও পুস্তক প্রকাশক সমিতি ও পুস্তক বাঁধাই সমিতির সহযোগিতার কারণে মাধ্যমিক স্তরের ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির পাঠ্য বইয়ের নোট-গাইড বই এখনো বাজারে আসেনি।

এতে বই বাণিজ্যের ভরা মৌসুমেও ক্রেতার খরা বাংলাবাজারের বইয়ের দোকানে। বাংলাবাজার ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

রাজধানীর কলেজিয়েট স্কুলের এক অভিভাবক মরিয়ম আখতার গত বৃহস্পতিবার বাংলাজারের মল্লিক টাওয়ারের ঢাকা টাউন লাইব্রেরিতে আসেন তার সপ্তম শ্রেণিপড়ুয়া সন্তানের জন্য নোট-গাইড বই কিনতে।

কিন্তু দোকানি জানান, বাজারে  মাধ্যমিক স্তরের ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির নোট-গাইড বই এখনো বের হয়নি। আগামী সপ্তাহে অর্থাৎ মার্চ মাসের শুরুতে এসব বই পাওয়া যাবে।

তবে বিভিন্ন প্রকাশনীর প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির নোট-গাইড বের হয়েছে। দামও বেশ চড়া। এ ছাড়া মাধ্যমিক স্তরের দশম শ্রেণির নোট-গাইড বাজারে আসলেও এই দোকানে দেখা যায়নি।

৩৮ নম্বর বাংলাবাজারে পাঞ্জেরি প্রকাশনীর বুক স্টলে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে একই চিত্র। সেখানেও প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির নোট-গাইড বিক্রি হচ্ছে। এই প্রকাশনীর মাধ্যমিক স্তরের দশম শ্রেণির বইয়ের নোট-গাইডও পাওয়া যাচ্ছে এখানে।

‘একের ভিতর সব’ নামে ১০ খণ্ডের এই নোট-গাইডের দাম ৪ হাজার ২০০ টাকা। এ ছাড়া লেকচার পাবলিকেশনের মাধ্যমিক স্তরের দশম শ্রেণির নোট-গাইডও ‘একের ভিতর সব’ নামে বাজারে পাওয়া যাচ্ছে।

দাম কম হলেও গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এই প্রকাশনীর দশম শ্রেণির নোট-গাইডের ৮ খন্ড বাজারে আসায় ক্রেতার চাহিদা বেশি দেখা গেছে পাঞ্জেরি প্রকাশনীর দশম শ্রেণির নোট-গাইড বইয়ের প্রতি।

এ ছাড়া ইন্টারেনেট প্রকাশনীর প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির নোট-গাইড ও আদিল ব্রাদার্সের একই শ্রেণির নোট গাইড ‘একের ভিতর সব’ নামে বাংলাবাজার বইপাড়ার প্রায় সব দোকানেই পাওয়া যাচ্ছে।

নোট-গাইডের এসব বইয়ের প্রচ্ছদ পৃষ্ঠায় প্রায় একই ধরনের লেখা রয়েছে ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড প্রণীত ২০২৫ সালের পাঠ্যবই অনুযায়ী রচিত পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা সহায়ক বই’।

পাঞ্জেরি প্রকাশনী আবার তাদের বইয়ের আকর্ষণ বাড়াতে পঞ্চম শ্রেণির বইয়ের কোণায় লিখে দিয়েছে ‘ট্যালেন্টপুল বৃত্তি ও অ+ প্রত্যাশীদের জন্য’।

এসব বইয়ের বাইরে রয়্যাল সায়েন্টিফিক পাবলিকেশনের উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের বিজ্ঞানবিভাগের নানা বিষয়ের বই, কনফিডেন্স পাবলিকেশনের দশম শ্রেণির ইংরেজি গ্রামার ও ব্যাকরণ বই, দিগদর্শন প্রকাশনীর স্নাতক স্তরের বই, আল-ফাতাহ প্রকাশনীর মাদ্রাসা স্তরের বই ও ফুলকুঁড়িসহ বিভিন্ন প্রকাশনীর কিন্ডারগার্টেন স্তরের বই বিক্রি হচ্ছে বাংলাবাজারের বিভিন্ন দোকানে।

পাশাপাশি নোট-গাইডসহ বিভিন্ন বই বস্তাবন্দি করে কুরিয়ারের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠানোর প্রস্তুতিও দেখা গেছে বিভিন্ন প্রকাশনীর দোকানে।

সাধারণত শিক্ষাবর্ষের শুরুর দিক জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতেই জমজমাট হয়ে ওঠে বাংলাবাজারসহ দেশের ছোট-বড় সব ধরনের লাইব্রেরি।

প্রথম থেকে দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের জন্য নোট-গাইড বা প্রকাশকদের ভাষায় সহায়ক বই বিক্রিকে কেন্দ্র করেই জমজমাট হয়ে ওঠে বই বাজার।

কিন্তু চলতি শিক্ষাবর্ষের প্রায় দুই মাস পার হতে চললেও ভরা মৌসুমেও বাজারে ক্রেতার সমাগম তেমন দেখা যায়নি। দুই একজন ছাড়া বেশির ভাগ ক্রেতাই ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির বইয়ের নোট-গাইড খুঁজছেন। না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন। রাজধানীর বাংলাবাজারে পাইকারি ও খুচরা দু’ভাবেই বই বিক্রয় হয়।

পাইকারিভাবে এখান থেকে বই নিয়েই চলে রাজধানীর নীলক্ষেতসহ বিভিন্ন এলাকার বইয়ের ব্যবসা। মাধ্যমিক স্তরের চারটি শ্রেণিসহ ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী বই না থাকায় খুচরা বিক্রির সঙ্গে পাইকারিতেও প্রভাব পড়েছে।

অন্যান্য বছরের মতো এবার ভরা মৌসুমওে নোট-গাইডের বাজার জমে না ওঠার কারণ সম্পর্কে জানা গেছে, মাধ্যমিক স্তরের শতভাগ শিক্ষার্থী এখনো এনসিটিবির বিনা মূল্যের পাঠ্যবই পায়নি।

সরকারের নির্দেশনা রয়েছে, যতক্ষণ পর্যন্ত পাঠ্যবইয়ের কাজ চূড়ান্তভাবে শেষ না হবে ততদিন প্রকাশকরা নোট-গাইড বই ছাপাতে পারবেন না।

শুধু নির্দেশনাই নয়, এ বিষয়ে এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি এবং বাংলাদেশ পুস্তক বাঁধাই ব্যবসায়ী সমিতির সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করে নোট-গাইড ছাপা বন্ধের বিষয়ে শক্ত অবস্থানের কথা জানিয়ে দেয়।

পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন সংস্থা নোট-গাইড বই ছাপায় এমন প্রেসগুলোতে আকস্মিক অভিযানও চালাচ্ছে।

এ ছাড়া পাঠ্যবই ছাপা নির্বিঘ্ন করার লক্ষ্যে এবার ডিসিদের ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ ও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনারও নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

সব মিলিয়ে সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে অন্যান্যবারের মতো এবার একচেটিয়াভাবে নোট-গাইড বই ছাপাতে সাহস পাচ্ছেন না প্রকাশকরা।

এদিকে এখনো এনসিটিবির প্রায় সাত কোটি বই ছাপানো বাকি, তারপরও বাজারে প্রাথমিকের সব শ্রেণি ও মাধ্যমিকের দশম শ্রেণির নোট-গাইড পাওয়া যাচ্ছে। এটা কীভাবে হচ্ছে, সে সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রাথমিক স্তরের সব শ্রেণির ও মাধ্যমিক স্তরের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা (যারা ২০২৬ সালে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় অংশ নিবে) প্রায় সব বই পাওয়ায় এই বইগুলোর নোট-গাইড ছাপা হয়েছে।

তবে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা এখনো বই না পাওয়ায় এসব শ্রেণির সহায়ক বই বাজারে দেওয়া হয়নি।

এনসিটিবির পরিকল্পনা অনুযায়ী চলতি মাসের মধ্যে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির সব বই দেওয়া চূড়ান্ত হলে আগামী মাসের প্রথম থেকেই ওই সব শ্রেণির নোট-গাইডও পাওয়া যাবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে। 

সৃজনশীল মেধা বিকাশ নিশ্চিত করতে ২০০৮ সালে হাইকোর্ট বিভাগের এক আদেশে নোট বইয়ের পাশাপাশি গাইড নিষিদ্ধ করা হয়।

এরপর প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের সব শ্রেণির ‘একের ভেতর সব’ নাম দিয়ে তৈরি করে সহায়ক বই ছাপিয়ে বাজারজাত ও বিক্রি করা হচ্ছে। 

২০২২ সাল থেকে নতুন কারিকুলাম চালু হওয়ার পর নোট ও গাইড বই বাণিজ্যের সুযোগ কমে আসে।

কেননা ওই কারিকুলামে শিক্ষার্থীদের প্রথাগতভাবে পরীক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। এর ফলে গত দুুই বছর নোট-গাইড নিয়ে বাণিজ্য কম হয়েছে।

চলতি বছর থেকে নতুন করে সৃজনশীল প্রশ্নে পরীক্ষা পদ্ধতি চালু হওয়ায় অভিভাবকদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে নোট-গাইডের বাণিজ্যিক চাহিদাও বেড়ে গেছে আগের মতো।

পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি এবং সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর দাবি, বর্তমানে এই সমিতির সদস্য রয়েছেন প্রায় ২৬ হাজার।

আরও প্রায় ১০ হাজার সমিতির সদস্য হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। প্রকাশনা শিল্পের পুরোটাই প্রায় রাজধানীনির্ভর।

তবে বগুড়া থেকেও কিছু প্রকাশনা বের হয়। তবে এসব প্রকাশনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য হয় নোট-গাইড বই কেন্দ্র করে।

সার্বিকভাবে নোট-গাইডসহ অন্যান্য প্রকাশনার সঙ্গে প্রায় বিশ লাখ পরিবার জড়িত।

এর মধ্যে রয়েছে, মালিক-প্রকাশক, প্রেস, বাইন্ডার ও মুদ্র্রণের সঙ্গে জড়িত একাধিক পেশাজীবী ও সারা দেশে বই বিক্রির জন্য ৩৫ থেকে ৪০ হাজার লাইব্রেরি ও এতে কর্মরত কর্মচারী।

এনসিটিবির পাঠ্যবই ছাপা দেরি হওয়ার কারণে প্রকাশনা শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের একটি শ্রেণির নোট-গাইড পাওয়া গেলেও ব্যবসার অবস্থা ভালো নয়।

বাংলাবাজারের কনফিডেন্স লাইব্রেরির মো. মিজানুর রহমান বলেন, আমরা ইংরেজি গ্রামার ও বাংলা ব্যাকরণ বই প্রকাশ করি।

গত ৪ ফেব্রুয়ারি এনসিটিবি এই বইগুলোর সিলেবাস পরিবর্তন করায় নতুন করে বই ছাপানোর কাজ শুরু করতে হচ্ছে।

নোট-গাউডের ব্যবসা কেমন হচ্ছে প্রশ্নে তিনি বলেন, এই ব্যবসা এখন হাতেগোনা দুই থেকে তিনটি প্রকাশনীর কাছে সীমাবদ্ধ।

এই প্রকাশনীগুলো যদি ইচ্ছে করে সারা বাংলাদেশের অন্যান্য প্রকাশনীর ব্যবসা নিয়ে নিতে পারে। তবে এবার নোট-গাউডের ব্যবসা এখনো তেমন ভলো নয়।

অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয় একটি ইংরেজি গ্রামার বইয়ের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার নাম প্রকাশ না করার সূত্রে বলেন, এনসিটিবির পাঠ্যবই ছাপা শেষ হওয়ায় কোনো বই ছাপা যাচ্ছে না।

বিভিন্ন সংস্থার লোকজন নিয়মিত প্রেসে অভিযান চালায়। তাই আগে এনসিটিবির বই শেষ হোক, তারপর বইয়ের কাজ ধরব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

তবে মাধ্যমিক স্তরের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা যেহেতু আগামীবার এসএসসি পরীক্ষা দিবে তাই গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে ওই শ্রেণির ইংরেজি গ্রামার বই বাজারে প্রকাশ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি রেজাউল করিম বাদশা বলেন, সরকারের বই যাতে শিক্ষার্থীরা সময়মতো পেতে পারে সেজন্য গত তিন মাস ধরে প্রকাশকরা কোনো সহায়ক বই ছাপেনি।

এনসিটিবির চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলোচনায় আমরা বলেছিলাম, আগে বোর্ডের বই যাবে, তারপর অন্য বইয়ের কাজ করবে প্রকাশকরা।

তাই গত তিন মাস সহায়ক বইয়ের কোনো কাজ হয়নি। কিন্তু বাজারে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের সহায়ক বই কীভাবে পাওয়া যাচ্ছে প্রশ্নে তিনি বলেন, প্রাথমিক ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বই পেয়ে গেছে, তাই তাদের সহায়ক বই কিছু ছাপা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে সমিতির সভাপতি আরও বলেন, সামনে রোজা আসছে। এই সেক্টরে যুক্ত লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।

তবে সবকিছুর পরও শিক্ষার্থীরা যাতে নির্দিষ্ট সময়ে বই পায় সে জন্য আমরা সবরকম সহযোগিতা দিয়েছি, প্রয়োজনে আরও দেব।

অন্যদিকে বাংলাদেশ পুস্তক বাঁধাই ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান খান কচি বলেন, প্রথমত যারা সহায়ক বই বাঁধাইয়ের কাজ করছে তারা আমার সমিতির সদস্য নয়।

এ ছাড়া অনেকের হাতে কাজ নেই, সামনে  রোজা আসছে, তাই সবাই কাজ করতে চায়। তবে এনসিটিবি যখন যে কাজের দায়িত্ব দিয়েছে আমরা করে দিয়েছি।

এ বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট গ্রুপগুলোর সঙ্গে আলোচনায় আমরা স্পষ্ট বলে দিয়েছি, এনসিটিবির বই শেষ হওয়ার আগে অন্য কোনো বইয়ের কাজ চলবে না। তারপরও বই পাওয়া যাচ্ছে। আমরা বিষয়টি নজরে রেখেছি।