ঢাকা শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪
আত্মগোপনে তিনভাই, দুদকের মামলা

বগুড়ায় দাপুটে দুলুর ইশারায় কোটি টাকা লুটপাট

বগুড়া থেকে নজরুল ইসলাম দয়া ও মহিউদ্দিন

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৬, ২০২৪, ০৩:৩৯ পিএম

বগুড়ায় দাপুটে দুলুর ইশারায় কোটি টাকা লুটপাট

ছবি : রূপালী বাংলাদেশ

বগুড়ায় আওয়ামী লীগের অঘোষিত রাজতন্ত্রের সেনাপতি বনে যাওয়া আসাদুর রহমান দুলু ছিলেন দাপুটে নেতা। জেলা পরিষদের সদস্য পদ দখল করে সেই চেয়ারকে ভাবতেন জাদুর কাঠি। উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা লুটপাট করে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

এছাড়া, নিজের দুই ভাইকে একই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও সভাপতির চেয়ারে বসিয়ে কামিয়েছেন কোটি টাকা। এলাকাভিত্তিক নেতাকর্মীদের কাঁধে ভর করে প্রভাব বিস্তার এবং নিয়ন্ত্রণ করতেন দুর্নীতির সাম্রাজ্য। অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এরই মধ্যে তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

সূত্র জানায়, বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক একেএম আসাদুর রহমান দুলু দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন। তিনি শাজাহানপুর উপজেলার কুন্দইশ গ্রামের মৃত বেলায়েত আলীর ছেলে এবং বগুড়া শহরের ফুলদীঘি এলাকার জাহানারা মঞ্জিলে বসবাস করেন। তিনি জেলা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যানের চেয়ারও দখল করেছিলেন।

অভিযোগ রয়েছে, আসাদুর রহমান দুলু জেলা পরিষদের বিভিন্ন প্রকল্পের বরাদ্দের টাকা নামমাত্র উন্নয়ন কাজ দেখিয়ে লুটপাট করেছেন। পরিষদের বরাদ্দের অর্থায়নের বিষয়টি গোপন রেখে আওয়ামী লীগ ও নিজের নামে চালিয়ে দিতেন। শাজাহানপুর উপজেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, নানা স্থাপনা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার সংস্কার কাজের অর্ধেকের বেশি টাকা চলে যেতো দুলুর পকেটে।

প্রকল্পের কাজে নামমাত্র সংস্কার ও রঙ করে উন্নয়ন বাস্তবায়ন দেখাতেন বলে অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয়রা। ঈদ ও পূজায় বস্ত্র বিতরণ এবং নানা আর্থিক সহায়তার নামে অতিরিক্ত ভাউচার দেখাতেন। বিভিন্ন সহায়তা পেয়েছে নিজ দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। মহামারি করোনাকালেও বিভিন্ন সামগ্রী বিতরণের ছবি তুলে জেলা পরিষদে অতিরিক্ত ভাউচার দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন মোটা অঙ্কের টাকা। জেলা পরিষদের টাকায় নিজে স্বাবলম্বী হলেও সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন সাধারণ মানুষ।

স্থানীদের অভিযোগ, শাজাহানপুর উপজেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বাণিজ্যের টাকা নিজেই ভাগাভাগি করতেন আসাদুর রহমান দুলু। তার দুর্নীতির সাম্রাজ্যের সেনাপতি ছিলেন নিজের ভাই আতাউর রহমান এবং চাচাতো ভাই আব্দুল্লাহ আল মতি। পুকুর দখল, জমি দখল ও লুটপাটের কাজে এলাকাভিত্তিক দলীয় নেতাকর্মীরা ছিল বেপরোয়া। প্রতিটি হাট-বাজারে অবৈধ হাসিল আদায় ও বাসস্ট্যান্ডে যানবাহনে চাঁদাবাজির টাকার ভাগ যেতো দুলুর পকেটে। বাস, ট্রাক, সিএনজি ও ইজিবাইকের টোল আদায়ের নামে চাঁদা তুলতো পাতি নেতারা। তাদের থাবা থেকে ভ্যান-রিকশা চালকরাও রেহায় পায়নি।

জানা গেছে, দুলুর বিরুদ্ধে তথ্য গোপন করে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ পেয়ে অনুসন্ধানে নেমেছিল দুদক। প্রাথমিক সত্যতা পেয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন আইনে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এতে ১ কোটি ৬ লাখ ১৩ হাজার ৮৯০ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও ৮০ লাখ ২৪ হাজার ৯৪০ টাকার সম্পদ অর্জনের তথ্য গোপন করার অপরাধ তুলে ধরা হয়েছে। ২০২৩ সালের ৫ এপ্রিল দুদক বগুড়ার সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. তারিকুর রহমান বাদী হয়ে মামলাটি করেন। দুদকের অনুসন্ধানে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের প্রমাণ মিলেছে।

এদিকে, দুলুর ইশারায় ও দলীয় ক্ষমতার দাপটে বগুড়ার শাজাহানপুর ডেমাজানী শহীদ মোখলেছুর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের চেয়ারে বসেন তার চাচাতো ভাই আব্দুল্লাহ আল মতি। স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতির চেয়ারে বসেন দুলুর নিজের ভাই আতাউর রহমান। স্কুলটি অনিয়ম আর স্বেচ্ছাচারীতার আতুরঘরে পরিণত হয়। বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে বালিকা ও কিন্ডারগার্টেন শাখা খুলে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দুলুর দুই ভাই প্রতিষ্ঠানের টাকা আত্মসাতের মহোৎসবে মেতে উঠেছিলেন। কর্মচারী নিয়োগে লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য, স্কুলের ৬৮টি দোকানের মাসিক ভাড়া ও এককালিন জামানতের প্রায় ৫০ লাখ টাকা, সাবেক গভর্নর লুৎফর রহমান সরকার ট্রাস্টের শিক্ষা উপবৃত্তির চার বছরের প্রায় ৫ লাখ টাকা, শিক্ষক টিউশন ফি ৪ লাখ ৫৪ হাজার টাকা আত্মসাতসহ মোটা অঙ্কের টাকা বখরা নিয়ে স্কুলের জায়গায় এক ব্যক্তিকে বাড়ি নির্মাণে সহযোগিতা করেছেন। স্কুলে শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি, বেতন ও অন্যান্য আদায়ের হিসাবে ব্যাপক গরমিলের অভিযোগ উঠায় হিসাবের রেজিস্ট্রার গায়েব করে নানা অনিয়ম দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন প্রধান শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল মতি।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের অঘোষিত রাজতন্ত্র ধ্বংস ও শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর দুলুসহ তার দুই ভাই আত্মগোপনে চলে যান। স্কুলে অনুপস্থিত থাকা প্রধান শিক্ষকের স্বেচ্ছাচারীতা, দুর্নীতিসহ নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেন স্থানীয় লোকজন ও শিক্ষার্থীরা। প্রধান শিক্ষকের পদত্যাগ দাবিতে শুরু হয় আন্দোলন। গত ২৫ আগস্ট প্রধান শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল মতিকে অপসারণ করে রেজাউল হাসানকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেন উপজেলা শিক্ষা অফিস।

শাজাহানপুর ডেমাজানী শহীদ মোখলেছুর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা জানান, প্রধান শিক্ষক ও সভাপতি নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেননি। তারা স্কুল ফান্ডের লাখ লাখ টাকা আত্মসাত করেছেন। তাদের ভাই আসাদুর রহমান দুলু আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতা হওয়ায় স্কুলে ভীতিকর পরিবেশ ছিল। শিক্ষকদের হুমকির মুখে রাখায় ভয়ে কেউ মুখ খুলতেন না।

স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটির সাবেক সভাপতি আইয়ুব আলী বলেন, তাদের ভয়ে সবাই চুপ থাকতো। হাট-বাজার থেকে শুরু করে পুকুর-জমি দখল, লুটপাট, চাঁদাবাজি, স্কুলে নিয়োগ বাণিজ্যসহ একক সাম্রাজ্য ছিল দুলুর। জেলা পরিষদের বিভিন্ন বরাদ্দের টাকা লুটপাট করেছেন। দুলুর ইশারায় তার দুই ভাই ডেমাজানী স্কুলটি ধ্বংসের মুখে নিয়ে গেছে। শিক্ষার মান ফিরিয়ে আনতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

শাজাহানপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহসিয়া তাবাসসুম জানান, ডেমাজানী শহীদ মোখলেছুর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির লিখিত অভিযোগে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনের পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

আরবি/ এইচএম

Link copied!