কক্সবাজারের রামুতে বাঁকখালী নদীর দুই তীরে বৃহস্পতিবার বিকেলে সমবেত হয়েছিল অন্তত দশ হাজার মানুষ। উদ্দেশ্য ‘কল্প জাহাজ’ ভাসানো উৎসব উপভোগ করা।

২০০ বছর ধরে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ নদীর এই অংশে স্বর্গের জাহাজ ভাসানোর উৎসব পালন করে আসছে। উৎসবটা সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতির সেঁতু বন্ধনে পরিণত হয়। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ ছাড়াও আসেন হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের বিপুলসংখ্যক মানুষ। তবে সবার প্রার্থনা ছিল, জগতে সব সংঘাত দুর হোক, সকল প্রাণী সুখি হোক।

ফানুস উৎসবের বর্ণিল আয়োজনে আকাশ রাঙানোর পর এবার প্রবারণায় কল্পজাহাজ ভাসানোর আনন্দে মেতেছেন বৌদ্ধ সম্প্রদায়। অপূর্ব কারুকাজে তৈরী একেকটি দৃষ্টিনন্দন জাহাজ নৌকায় বসিয়ে ভাসানো হচ্ছে নদীতে।জাহাজগুলো যাচ্ছে নদীর এপার থেকে ওপারে। সেই জাহাজে চলছে শত শত প্রাণের বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস। শুধু তাই নয়,নদীর দুইপাড়েও উৎসবে আনন্দে মেতেছে হাজারো নরনারী।

বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) কক্সবাজারের রামুর বাঁকখালী নদীর পূর্ব রাজারকুল ঘাটে আয়োজন করা হয় শত বছরের ঐতিহ্যবাহী কল্প জাহাজ ভাসানো উৎসব। দুপুরে শুরু হওয়া এ উৎসব বিকেল গড়াতেই বর্ল হয়ে ওঠে হাজারো দর্শনার্থীর অংশগ্রহণে।

বৌদ্ধদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে যুগ যুগ ধরে বাঁকখালী নদীতে কল্প জাহাজ ভাসা উৎসবের আয়োজন হয়ে আসছে। এবার ভাসানো হয় পাঁচটি কল্প জাহাজ।
কক্সবাজার শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে রামু উপজেলা সদর পার হয়েই বাঁকখালী নদীর ঘাট। বিকেল ৩টায় এ ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, লোকে লোকারণ্য নদীর দুই পাড় গান-বাজনা, কীর্তন ও ফানুস ওড়াউড়িতে মেতে উঠেছে বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ। পাঁচ থেকে ছয়টি কাঠের নৌকার ওপর বসানো হয়েছে একেকটি কল্প জাহাজ। আবার ইঞ্জিন নৌকাও দেখা গেল দুটি জাহাজে। পানিতে ভাসছে মোট পাঁচটি কল্প জাহাজ। মূলত বাঁশ, কাঠ, বেত ও রঙিন কাগজে রঙের কারুকাজে জাদি,হাঁস,ময়ুর,হাতিসহ বিভিন্ন প্রাণীর অবয়ব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এসব কল্প জাহাজ।চমৎকার নির্মাণ শৈলী আর বৈচিত্র্যে ভরা প্রতিটি জাহাজই যেন নিজস্ব স্বকিয়তার ভরপুর।

এসব ভাসমান জাহাজে চরছে বৌদ্ধ কীর্তন চলছে। কেউ নাচছে,কেউ গাইছে আবার কেউ ঢোল, কাঁসাসহ নানা বাদ্য বাজাচ্ছে। শিশু কিশোরদের আনন্দ-উচ্ছ্বাস দেখে মনে হবে এখনই যেন বাঁধ ভাঙবে!
আয়োজকেরা জানালেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার অংশগ্রহণকারী জাহাজের সংখ্যা কম। সরকার পরিবর্তনের পর বিভিন্নস্থানে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা নিয়ে অনেকে নিরাপত্তা নিয়ে শংকিত ছিলেন। যে কারণে অনেক গ্রামে এবার জাহাজ তৈরী করা হয়নি।

রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের আবাসিক প্রধান প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন, প্রায় দুইশ বছর আগে থেকে এ জাহাজ ভাসা উৎসবের প্রচলন হয় পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারে। সে দেশের মুরহন ঘা নামক স্থানে একটি নদীতে মংরাজ ম্রাজংব্রান প্রথম এ উৎসবেরর আয়োজন করেন। শতবছর ধরে রামুতে মহাসমারোহে এ উৎসব হয়ে আসছে।
তিনি বলেন, মহামতি বুদ্ধ রাজগৃহ থেকে বৈশালী যাওয়ার সময় নাগ লোকের অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন নাগেরা চিন্তা করলেন বুদ্ধপূজার এই দুর্লভ সুযোগ তারা হাতছাড়া করবে না। সঙ্গে সঙ্গে নাগলোকের পাঁচশত নাগরাজ পাঁচশত ঋদ্ধিময় ফণা বুদ্ধপ্রমুখ পাঁচশত ভিক্ষুসংঘের মাথার ওপর বিস্তার করল।

এইভাবে নাগদের পূজা করতে দেখে দেবলোকের দেবতারা, ব্রহ্মলোকের ব্রহ্মরা বুদ্ধকে পূজা করতে এসেছিলেন। সেইদিন মানুষ, দেবতা, ব্রহ্মা, নাগ সবাই শ্বেতছত্র ধারণ করে ধর্মীয় ধবজা উড্ডয়ন করে বুদ্ধকে পূজা করেছিলেন। বুদ্ধ সেই পূজা গ্রহণ করে পুনরায় রাজগৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। সেই শুভ সন্ধিক্ষণ হচ্ছে শুভ প্রবারণা দিবস।
মূলত চিরভাস্বর এই স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য বাংলাদেশের বৌদ্ধরা বিশেষ করে রামুর বৌদ্ধ সম্প্রদায় প্রবারণা পূর্ণিমায় বাঁকখালী নদীতে দ স্বর্গের জাহাজ ভাসিয়ে প্রবারণা উদ্যাপন করে।

বৃহস্পতিবার বিকেল তিনটার দিকে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্ঠা ড. সুকোমল বড়ুয়া। উদযাপন পরিষদের সভাপতি মিথুন বড়ুয়া বোথামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন কক্সবাজার-৩ আসনের সাবেক সাংসদ ও বিএনপি`র কেন্দ্রীয় কমিটির মৎস্যজীবি বিষয়ক সম্পাদক লুৎফর রহমান কাজল।
আপনার মতামত লিখুন :