ঢাকা শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪

পশ্চিম ধরাধরপুর মসজিদকে তবারক আলী ওয়াকফ এস্টেট থেকে মুক্ত করার দাবি

সিলেট ব্যুরো

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৯, ২০২৪, ১০:৩২ পিএম

পশ্চিম ধরাধরপুর মসজিদকে তবারক আলী ওয়াকফ এস্টেট থেকে মুক্ত করার দাবি

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার ধরাধরপুরস্থ পশ্চিম ধরাধরপুর জামে মসজিদটি ‘কথিত’ হাজী সৈয়দ তবারক আলী গং ওয়াকফ এস্টেট থেকে মুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন মসজিদ কমিটির সদস্যরা।

শনিবার সিলেট প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানানো হয়। এতে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন মসজিদ কমিটির সেক্রেটারী গোলাম মোস্তফা কামাল।

লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘আমাদের গ্রামে বিদ্যমান শত বছরের অধিককাল পূর্বে প্রতিষ্ঠিত মসজিদটি পশ্চিম ধরাধরপুর জামে মসজিদ নামে যুগ যুগ ধরে পরিচিত এবং একটি কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছিল। ২০১০ সালের নভেম্বরে সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলা ওয়াকফ পরিদর্শকের কার্যালয় থেকে মসজিদ পরিচালনা কমিটিকে প্রদত্ত চিঠিতে ‘ইসি নম্বর ১৩৭৬৪ ধরাধরপুর জামে মসজিদ ওয়াকফ এস্টেট’ বলে উল্লেখ করা হয়। এতে কমিটির সদস্যবর্গ ও গ্রামবাসী বিস্মিত হন।

পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সে সময়ে সরকারের উপসচিব পদে কর্মরত একই গ্রাম নিবাসী সৈয়দ মাহবুব-ই-জামিলের তদবিরে ওয়াকফ অফিস থেকে এই চিঠি দেওয়া হয়েছে।

আরও জানা যায় যে, এই মসজিদকে কথিত ‘সৈয়দ তবারক আলী এস্টেট’-এর আওতাধীন বলে ওয়াকফ্ এস্টেটের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সৈয়দ মাহবুব-ই-জামিল একজন উচ্চপদস্থ সরকারি আমলা বিধায় এবং গ্রামে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকার স্বার্থে গ্রামবাসী তখন জোরালো কোনো প্রতিবাদ করা থেকে বিরত থাকেন। ২০১০ সালের ১০ ডিসেম্বর পশ্চিম ধরাধরপুর জামে মসজিদ পরিচালনা কমিটির সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় সৈয়দ মাহবুব-ই-জামিলকে পশ্চিম ধরাধরপুর জামে মসজিদ কমিটির মোতাওয়াল্লী নির্বাচিত করা হয়। সৈয়দ মাহবুব-ই-জামিল পশ্চিম ধরাধরপুর জামে মসজিদের মোতাওয়াল্লী নির্বাচিত হওয়ার পর নানা রকম ছলছাতুরী ও জালিয়াতির মাধ্যমে মসজিদের নাম-পরিচিতি পরিবর্তনের বিভিন্ন চক্রান্ত শুরু করেন। তিনি পশ্চিম ধরাধরপুর জামে মসজিদের মোতাওয়াল্লী নির্বাচিত হলেও ২০১০ সালের ২১ ডিসেম্বর ঢাকাস্থ ওয়াকফ প্রশাসকের কাছে প্রদত্ত চিঠিতে নিজেকে ‘ধরাধরপুর জামে মসজিদ ওয়াকফ্ কমিটি’-র মোতাওয়াল্লী বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু উক্ত চিঠির এক স্থানে ব্র্যাকেটের মধ্যে ‘হাজী সৈয়দ তোরাব আলী গং ওয়াকফ এস্টেট’ লিখেছেন। তার এই চিঠির উত্তরে বাংলাদেশ ওয়াকফ প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ২০১০ সালের ২৩ ডিসেম্বর প্রদত্ত চিঠিতে তাকে ‘হাজী সৈয়দ তবারক আলী গং ওয়াকফ এস্টেট এর ১৭ সদস্য বিশিষ্ট পরিচালনা কমিটি’-র মোতাওয়াল্লী বলে উল্লেখ করা হয়।’

মোস্তফা কামাল বলেন, ‘পশ্চিম ধরাধরপুর জামে মসজিদ সরকারি রেকর্ডপত্রে কথিত সৈয়দ তবারক আলী ওয়াকফ এস্টেটের আওতাধীন নয় এবং সেসময় ধরাধরপুর জামে মসজিদ ওয়াকফ এস্টেটের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু সৈয়দ মাহবুব-ই-জামিল তার সরকারি কর্মকর্তা পদের প্রভাব খাটিয়ে নানা রকম বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি মসজিদের জন্য চাঁদা আদায়ের বইয়েও বিভিন্ন নাম ব্যবহার করেন। তিনি মোতাওয়াল্লীর দায়িত্ব লাভের পর মসজিদ পরিচালনায় স্বেচ্ছাচারিতা এবং মসজিদে ধর্মীয় বিভিন্ন কাজেও তার খেয়ালখুশি নীতি চাপিয়ে দেন।

তিনি বলেন, ‘ধরাধরপুরে একটি প্রাচীন ঈদগাহ রয়েছে। এই ইদগাহে বছরে দুটি ঈদের জামাত যুগ যুগ ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এই ঈদগাহের নাম বাঘের বাড়ি শাহি ঈদগাহ। ধরাধরপুরসহ আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের লোকজন এই ঈদগাহে ঈদের জামাত পড়ে থাকেন। পশ্চিম ধরাধরপুর জামে মসজিদে ঈদের জামাত হওয়ার কোনো নজির নেই। 

কিন্তু সৈয়দ মাহবুব-ই-জামিল ২০২৩ সালের ২১ এপ্রিল শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর মসজিদ কমিটির সদস্যদের সঙ্গে পরামর্শ না করে মসজিদে ঘোষণা করেন যে, আজ চাঁদ দেখা গেলে পরদিন ঈদগাহে নয়, মসজিদে ঈদুল ফিতরের জামাত অনুষ্ঠিত হবে। তার এই ঘোষণায় গ্রামে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়। পরে এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উদ্যোগে সালিস বৈঠকের ফলে অপ্রীতিকর ঘটনা এড়ানো সম্ভব হলেও সৈয়দ মাহবুব-ই-জামিল গ্রামবাসীকে মামলার ভয় দেখান। এমনকি তিনি বাদি হয়ে একটি এবং তার অনুগতদের দিয়ে আরও ৪টি মামলা দায়ের করেন। এই মামলাগুলোর মধ্যে দক্ষিণ সুরমা থানায় একটি মামলা পুলিশের তদন্তে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। পুলিশ এই তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার পর মামলাটি আদালত কর্তৃক নিষ্পত্তি হয়ে গেছে।’

তিনি পশ্চিম ধরাধরপুর জামে মসজিদ কোনোভাবেই কথিত সৈয়দ তবারক আলী গং ওয়াকফ এস্টেটের আওতাভুক্ত নয় বলে দাবি করে বলেন, ‘সৈয়দ মাহবুব-ই-জামিল বিভিন্ন প্রভাব খাটিয়ে ও গায়ের জোরে এই মসজিদ তার পূর্বপুরুষের সৃষ্ট কথিত ওয়াকফ এস্টেটভুক্ত দাবি করে মসজিদটি তার দখলে রেখেছেন। তাই মসজিদটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা এবং মসজিদের আয় ও জমি যথাযথভাবে সংরক্ষণ ও ব্যয়ের জন্য পশ্চিম ধরাধরপুর জামে মসজিদ ওয়াকফ এস্টেটের তালিকাভুক্ত করার জন্য আবেদন করা হয়েছে। এই এস্টেটকে বাংলাদেশ ওয়াকফ প্রশাসকের নিবন্ধন করার জন্য ধরাধরপুর গ্রাম নিবাসী মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন রাসেল ২০২৩ সালের ৩১ জুলাই ওয়াকফ প্রশাসকের কাছে লিখিত আবেদন করেন। তার আবেদনে প্রস্তাবিত ওয়াকফ এস্টেটের জমি মোট ১ একর ৪০ শতক, বার্ষিক আয় ২ লাখ ১০ হাজার টাকা এবং বার্ষিক ব্যয় ২ লাখ ৫ হাজার টাকা উল্লেখ করা হয়। একই সঙ্গে তিনি আহমদ হোসেন রেজাকে প্রস্তাবিত পশ্চিম ধরাধরপুর জামে মসজিদ ওয়াকফ এস্টেটের মোতাওয়াল্লী করে ৩১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি দাখিল করেন। কামাল উদ্দিন রাসেল ২০২৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ওয়াকফ প্রশাসকের কাছে আরেকটি দরখাস্তে হাজী সৈয়দ তবারক আলী ওয়াকস এস্টেট বাতিল করে পশ্চিম ধরাধরপুর জামে মসজিদ ওয়াকফ এস্টেটকে অবিলম্বে তালিকাভুক্ত করার আবেদন জানিয়েছেন।

এদিকে সৈয়দ মাহবুব-ই-জামিল ওয়াকফ প্রশাসকের কাছে কয়েকটি চিঠিতে কথিত সৈয়দ তবারক আলী গং এস্টেটের নতুন কমিটি তালিকাভুক্ত করার আবেদন করেন। এ অবস্থায় ঢাকাস্থ ওয়াকফ প্রশাসকের কার্যালয় হতে বিষয়টি তদন্তক্রমে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সিলেটের জেলা প্রশাসক এবং সিলেট শহরের পূর্ব শাহী ঈদগাহস্থ সিলেট ও সুনামগঞ্জের ওয়াকফ পরিদর্শককে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

এর পরিপ্রেক্ষিতে সিলেটের ওয়াকফ হিসাব নিরীক্ষক মো. মোস্তাফিজুর রহমান ২০২৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ঢাকাস্থ ওয়াকফ প্রশাসকের কাছে দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে বলেছেন, ‘এস্টেটের আনুষাঙ্গিক কাগজপত্রাদি পর্যালোচনা ক্রমে দেখা যায়, সৈয়দ গোলাম মৌলা ২৪.০৭.১৯৫৯ সালে হাজী সৈয়দ তবারক আলী গং ওয়াকফ এস্টেটটি এ অফিসে তালিকাভুক্তির জন্য আবদেন করিলে উক্ত এস্টেটটির প্রায় ৩.৪০ একর সম্পত্তি তালিকাভুক্ত করা হয়।

দেখা যায়, পশ্চিম ধরাধরপুর জামে মসজিদের নামে ২৩ শতক জমি এসএ রেকর্ড আছে, বাকি সম্পত্তির কোনো বিবরণ পাওয়া যায়নি।’

‘বাংলাদেশ ওয়াকফ প্রশাসকের কার্যালয়ে সিলেটের জেলা প্রশাসক গত ১০ জুন যে প্রতিবেদন দিয়েছেন, তাতে তিনি বলেছেন, ‘হাজী সৈয়দ তবারক আলী গং কর্তৃক ১৯২৪ সালে রেজিস্ট্রি দলিলমূলে নিয়ামতপুর ও ধরাধরপুর মৌজার ১ হাল ৩ কেদার ৫ জষ্টি ভূমি ওয়াকফ করে দেন। বর্ণিত ওয়াকফ দলিলে কোনো দাগ খতিয়ান নেই। হাজী সৈয়দ তবারক আলী ওয়াকফ এস্টেট সংশ্লিষ্টদের দাবি-ধরাধরপুর মৌজার মসজিদের নামে রেকর্ডভুক্ত ভূমি তাদের ওয়াকফ এস্টেটভুক্ত। কিন্তু ১৯২৪ সালের দলিলে দাগ উল্লেখ না থাকায় প্রকৃতপক্ষে উক্ত ভূমি হাজী সৈয়দ তবারক আলী ওয়াকফ এস্টেটভুক্ত কি না, তা নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয়নি।’

জেলা প্রশাসক তার প্রতিবেদনে আরও বলেন, ‘এসএ এবং আরএস জরিপে হাজী সৈয়দ তবারক আলী ওয়াকফ এস্টেটের নামে ১৯২৪ সনের দলিলে ওয়াকফকৃত ভূমির কোনো রেকর্ড প্রণীত না হওয়ায় সংশ্লিষ্ট দাবিদারগণকে এখতিয়ার সম্পন্ন দেওয়ানি আদালতে শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে।’

মোস্তফা কামাল বলেন, ‘সৈয়দ মাহবুব-ই-জামিল নিজেও স্বীকার করেছেন যে, পশ্চিম ধরাধরপুর জামে মসজিদটি তার অনেক আগের পূর্বপুরুষের নামে কথিত ওয়াকফ এস্টেটের আওতাধীন নয়। ২০২৩ সালের ৭ মে ওয়াকফ প্রশাসকের কাছে প্রদত্ত একটি আবেদনের শুরুতেই তিনি বলেছেন, কথিত ‘ওয়াকফ এস্টেটের আওতাধীন মসজিদ (৫২ শতক) ছাড়াও ৪২৮ শতক জমি কাগজে-কলমে আছে। আমাদের পূর্বপুরুষ ব্রিটিশ শাসনামলে এই সম্পদ ওয়াক্ফ করেন। আমাদের পরিবার দেশ বিভাগের পর গ্রামের পঞ্চায়েতের নিকট মসজিদের দায়িত্বভার ছেড়ে দেন।’ তার পরিবার যেখানে মসজিদের দায়িত্বভার গ্রামবাসীর কাছে ছেড়ে দেয়, সেখানে তিনি দলিলপত্র ছাড়াই মসজিদটি কুক্ষিগত করে রেখেছেন।’

মোস্তফা কামাল বলেন, ‘আমাদের একমাত্র দাবি হচ্ছে, আমাদের গ্রামের প্রাচীন জামে মসজিদকে কথিত ওয়াকফ এস্টেট তথা সৈয়দ মাহবুব-ই-জামিল চক্রের কবল থেকে রক্ষাকল্পে প্রস্তাবিত পশ্চিম ধরাধরপুর জামে মসজিদ ওয়াকফ এস্টেটকে যেন অবিলম্বে ওয়াকফ প্রশাসনের নিবন্ধিত করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন মসজিদের সহকারী মোতাওয়াল্লী মো. হোসাইন আহমদ, মো. ফজলে এলাহী ও মো. কুতুব উদ্দিন, যুগ্ম সম্পাদক মো. আব্দুল খালিক, কোষাধ্যক্ষ মো. মুহিবুর রহমান মুহিন, সদস্য এডভোকেট জাকির হোসেন জিতু, মো. জাহাঙ্গীর আলম চিকন, মো. আজিজুর রহমান, মো. তাজ উদ্দিন, বাবুল আহমদ, মো. আব্দুল জব্বার, রায়হান আহমদ কয়েছ, রুহুল আমীন, আক্তার হোসেন, আব্দুল মুকিত, বাচ্চু মিয়া, শামছুর রহমান শমছু ও মো. শফিকুল ইসলাম।

আরবি/জেডআর

Link copied!