ঢাকা মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর, ২০২৪

ক্ষমতার দাপটে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন সাবেক ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী রাসেল

শহিদুল ইসলাম, গাজীপুর

প্রকাশিত: অক্টোবর ২২, ২০২৪, ০৪:০৬ পিএম

ক্ষমতার দাপটে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন সাবেক ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী রাসেল

ছবি : রূপালী বাংলাদেশ

বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম আহসান উল্লাহ মাস্টার। তিনি ছিলেন গাজীপুর-২ (গাজীপুর সদর ও টঙ্গী উপজেলা) আসনের সংসদ সদস্য (এমপি)। ২০০৪ সালের ৭ মে টঙ্গীতে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সম্মেলন বক্তব্য দিচ্ছিলেন তিনি। এসময় সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন আহসান উল্লাহ মাস্টার। আহসান উল্লাহ মাস্টার নিহতের পরে ওই আসনে দেওয়া হয় উপ-নির্বাচন। পরে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয় নিহত আহসান উল্লাহ মাস্টারের ২৬ বছর বয়সী ছেলে জাহিদ আহসান রাসেলকে।

তখন থেকেই ওই আসনে নির্বাচিত আহসান উল্লাহ মাস্টারের ছেলে জাহিদ আহসান রাসেল। এর আগে তাকে কোনদিন রাজনীতির মাঠে দেখা যায়নি। এরপর ধীরে ধীরে তার চাচা মতিউর রহমান মতিকে সাথে নিয়ে গড়ে তোলেন একটি সিন্ডিকেট। বাবার ইমেজ ব্যবহার করে মানুষের সহানুভতি নিয়ে নিরবে করেছেন দুর্নীতি। তার স্ত্রী ছাড়াও পরিবারে মাসহ অন্যান্যদের সাথে তার ছিলনা সু-সম্পর্ক। চাচা মতিউর রহমান মতিকে সাথে নিয়ে একক আধিপত্য বিস্তার করে গড়েছেন সম্পদে পাহাড়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সাবেক যুব ও ক্রিড়া প্রতিমন্ত্রী, গাজীপুর- ২ আসনের এমপি জাহিদ আহসান রাসেল আওয়ামী সরকার টিকবে না এমন খবর পেয়ে ৪ আগস্ট কানাডা চলে যান। কানাডায় তাঁর রয়েছে নিজস্ব বাড়ি ও মার্কেট। রয়েছে  আমেরিকায় খামারবাড়ি এবং ব্রাহমান জাতের গরুর খামার। বাংলাদেশে রাসেল সম্পদ গড়েছেন শশুর বাড়ির আত্মীয় স্বজনের নামে। এর মধ্যে উত্তরায় একটি প্লট ১৮ নম্বারে ও ১০/১১ নাম্বারে বহুতল বাড়ি রয়েছে। টঙ্গীর কাঠালদিয়া রাজউকের শিল্প প্লট শশুরের  নামে। এছাড়াও নামে-বেনামে দেশের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে তার সম্পদ।

‘মোহাম্মদ এগ্রো’ নামে তাঁর গাজীপুরের বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি গরুর খামার রয়েছে। যা রাসেলে শশুরের নামে চলতো। বেশিরভাগ জায়গা খাস জমি দখল করছেন। গরুর খামারের যে সেডগুলো তিনি করেছেন সব মালামাল নিয়েছেন গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের সাবেক ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর কিরণ এবং কাউন্সিলর নুরুল ইসলাম নুরুর মাধ্যমে। সিটি করপোরেশনের বৈদ্যুতিক খুটি দিয়ে তিনি বানিয়েছেন খাম্বা। এতে তিনি কয়েক কোটি টাকার মালামাল নিয়েছেন সিটি করপোরেশন থেকে।

ভারপ্রাপ্ত সাবেক মেয়র কিরণের সঙ্গে চুক্তি করে নগরীর সকল কাজ থেকে রাসেলকে দিতে হতো দুই শতাংশ ভাগ। অভিযোগ রয়েছে, গাজীপুরে বিভিন্ন হাইস্কুল এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সভাপতি পদ পছন্দের ব্যক্তি কাছে বিক্রি করতেন ৫ থেকে ৭ লাখ টাকায়।

মন্ত্রী হওয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থানে স্টেডিয়াম নির্মাণে জমি কেনা কিংবা মেরামত কাজের পার্সেনটেন্স আদায় এবং ঠিকাদার হিসেবে রাখা হতো তার আরেক চাচা সাবেক কাউন্সিলর মরহুম নুরুল ইসলামকে। গাজীপুরে সকল ঝুট ব্যাবসা, চাদাঁবাজি, দখলদারি, মাদক ব্যবসায়, পদ বাণিজ্য ছিল রাসেলের চাচা মতিউর রহমান মতি নিয়ন্ত্রণে। যাকে গাজীপুরে সবাই চিনে মতি কাকা নামে।

এমপি রাসেল শশুরের নামে গরুর ফার্ম দিয়ে করেছেন নিরব চাঁদাবাজি। ঈদুল আযহায় বাধ্য করতো নেতা-কর্মীদের শ্বশুরের  ফার্ম থেকে গরু কেনার জন্য। এরপর যে গরুর দাম এক লাখ সেখানে নেয়া হত দুই লাখ। বিষয়টি সবাইকে মেনে নিতে হতো মন্ত্রী ও মতির ভয়ে। এছাড়া তার বাবার মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানের খরচ কোনদিনই তিনি বহন করেননি। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতারা গরু পাঠাতো সেটা দিয়েই হতো দোয়া মাহফিল। মন্ত্রীর নজরে আসার জন্য আহসান উল্লাহ মাস্টারের মৃত্যুবার্ষিকীতে রাত ১২টার পর থেকেই শুরু হতো কবরে ফুল দেয়া।

এক লাখ পিস ইয়ার চালান নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে একটি অডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হলে ২০২১ সালের ২৮ এপ্রিল গ্রেপ্তার হন তৎকালীন টঙ্গী কলেজ শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি মো. রেজাউল করিম। শূন্য থেকে কোটিপতি বনে যাওয়া রেজাউল ছিলেন গাজীপুর-২ আসনের এমপি জাহিদ আহসান রাসেলের ছায়াসঙ্গী।

২০১৮ সালে গাজীপুর নগরীর শীর্ষ ১০ মাদক ব্যবসায়ী তালিকা তৈরি করে সরকারের একটি সংস্থা। ওই তালিকায় শীর্ষ ১০ জনের সবাই ছিলেন টঙ্গীর। তাদের মধ্যে ছাত্রলীগ নেতা সরকার মশিউর রহমান বাবু, হুমায়ুন কবীর বাপ্পীসহ ৭ জনই ছিলেন ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও কৃষকলীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতা। যাদের সবাই ছিলেন রাসেলের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। শুধু রেজাউল বা শীর্ষ ১০ নন, মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে রাসেলের সু-সম্পর্কের বিষয়টি ছিল ওপেন সিক্রেট।

জানা যায়, উপ-নির্বাচনে এমপি হয়ে আমরা ‘বিরোধী দল’ এমন অজুহাতে প্রথম দুই বছর এলাকার কোন উন্নয়ন কাজ করেননি রাসেল। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর ফের এমপি হয়েও কোন কাজ না করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সংস্কার না করায় ভেঙ্গে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে নগরীর বিভিন্ন সড়ক। ২০১৩ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশনে উন্নীত হলে এমপির কাজ করার সুযোগ নেই অজুহাতে হাতগুটিয়ে ছিলেন তিনি। এমনকি নিজের হায়দারাবদ এলাকার পৈত্রিক বাড়ি এবং টঙ্গীর নোয়াগাঁওয়ের বাসায় যাওয়ার রাস্তাটিও করতে পারেননি। হাটু সমান কাঁদাপানি পেরিয়ে এলাকার লোকজনকে যাতায়ত করতে হতো।

এলাকার উন্নয়ন না করলেও রাসেল দলের মধ্যে শুরু করেন বিভাজন। ওই সময় আ ক ম মোজ্জাম্মেল হক জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং অ্যাডভোকেট মো. আজমতউল্লা খান ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। এসব নেতা থাকলেও তাকে প্রধান অতিথি করা না হলে অনুষ্ঠানে যেতেন না জাহিদ আহসান রাসেল। টঙ্গীর রেলক্রসিংয়ের ওপর উড়াল সেতুটি নির্মাণ হয় জোট সরকারের আমলে। কিন্তু তারা উদ্বোধন করে যেতে পারেনি। আওয়ামী লীগ ক্ষতায় এসে সেতুটি উদ্বোধন করে নাম দেন শহীদ আহসানউল্লাহ মাস্টার উড়াল সেতু। এমপি হিসেবে এলাকায় চোখে পড়ার মতো করেননি কোন কাজ।

এ ছাড়াও বাবা আহসানউল্লাহ মাস্টারের নামে যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আর মিনি স্টেডিয়াম ছাড়া পুরো গাজীপুরে আর একটিও ইট বসাতে না পারলেও অন্যের করা উন্নয়নে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ভিত্তিপ্রস্থর ও ফলক লাগিয়ে টাকার শ্রাদ্ধ করেছেন।

২০১৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনি যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী হন। তারপর টঙ্গীতে টেলিফোন শিল্প সংস্থার মাঠে বাবার নামে একটি মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণ কাজ শুরু করেন। যার কাজ এখনো শেষ করতে পারেনি। গাজীপুরে বাবার নামে যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ করেন। দু’একটি স্কুল করেছেন তাও বাবার নামে। পাঁচবার এমপি হয়ে দৃশ্যমান তার উন্নয়ন এ পর্যনন্তই। গত ১৬ বছরে নির্বাচনী এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভবন নির্মাণের ভিত্তি ও উদ্বোধন ফলক লাগানো ছাড়া তার তেমন উন্নয়ন কাজ নেই।

সরকারি টাকায় নির্মিত কমপক্ষে ২০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভবনের নামকরণ জাহিদ আহসান রাসেল করেছেন প্রয়াত বাবা ও নিজের নামে। তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাম বাবার নামে নামকরণ করতে চেয়েও শেখ হাসিনার কঠোর মনোভাবের কারণে পারেননি। পরে টঙ্গী সরকারি হাসপাতালের নামকরণ করনে বাবার নামে। এই নামকরণের দাবিতে কৌশল অবলম্বন করে ১৫ দিন সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করিয়ে দাবি আদায়ে বাধ্য করেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে।

দলে বিভেদ, প্রবীন ও ত্যাগীদের দূরে ঠেলে হাইব্রিডদের পুনর্বাসন করেছেন নিজেকে উজাড় করে। ত্যাগীদের নি:স্ব করে নিজ ছায়াতলে রেখে রাস্তার মানুষকে করেছেন বিত্তশালী। আওয়ামী লীগ ছাড়া সব সহযোগী সংগঠনের পদ অনুগতদের দিয়েছেন তাও টাকার বিনিময়ে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটি ও কোটি কোটি টাকার ঠিকাদরি দিয়েছেন অনুগতদের। তার সভা-সমাবেশে থাকতো মাদক ব্যবসায়িরা।  তাদের পদ-পদবিও দেন এই সাবেক মন্ত্রী রাসেল। এরকম বহু সুবিধাবাদিকে প্রতিষ্ঠা করে নেপথ্যে সুবিধা নিয়েছেন রাসেলের স্ত্রী খাদিজা রাসেল।

এই সব অভিযোগের বিষযে জানতে সাবেক ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হয়লেও তার ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। এ কারণে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

আরবি/ এইচএম

Link copied!