দিন হাজিরার চাকরি করেও কোটিপতি বনে গেছেন এসিল্যান্ডের ড্রাইভার শামীম হোসেন। একসময় ভ্যান-রিকশা ও লেগুনা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা ব্যক্তি নামে-বেনামে গড়েছেন অঢেল সম্পদ।
পৈতৃক সুত্রে পাওয়া আধা শতক সম্পত্তির মালিক শামীম তিন বছরেই কামিয়েছেন কোটি টাকা। বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলা ভূমি অফিসে দুর্নীতির সাম্রাজ্যের অঘোষিত আরেক সেনাপতি নাইটগার্ড এনামুল হক। তিনি ২০১৫ সালে ভূমি অফিসে চাকরি পান। তবে রাতে অফিস পাহারায় তাকে দেখা যায় না। তার স্থলে টাকা দিয়ে রাখেন ভাড়া করা গার্ড। কারণ সকাল হলেই এনামুলের হাতে যায় ঘুষের টাকা। নাইটগার্ডও বনে গেছেন কোটিপতি। এসিল্যান্ডের মতোই তার অফিসার আচরণ।
জমির খারিজ, শ্রেণি পরিবর্তন, অছিয়তনামা দলিলসহ নানা কাজে প্রতিদিন লাখ টাকা ইনকাম করেন এসিল্যান্ডের ড্রাইভার ও নাইটগার্ড। অভিযোগ রয়েছে, সার্ভেয়ার এবং শিবগঞ্জের ১১টি ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তারাও এসিল্যান্ডের নামে ঘুষের টাকা গ্রহণ করে নাইটগার্ডের হাতে দেন। এরপর বিশেষ চিহ্ন স্বাক্ষর করা ফাইল পাঠানো হয় এসিল্যান্ডের টেবিলে। নাইটগার্ডের মাধ্যমেই প্রতিদিন লেনদেন হয় অন্তত ১০ লাখ টাকা- এ অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শিবগঞ্জ উপজেলার মোকামতলা মুরাদপুরের বাসিন্দা শামীম হোসেন পাঁচ বছর আগে লেগুনা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তার বাবা দেলোয়ার হোসেন ছিলেন দিনমজুর। সংসারে অভাবের কারণে একসময় ভ্যান-রিকশাও চালিয়েছেন শামীম। পৈতৃক সুত্রে চারভাই পেয়েছেন দুই শতক জায়গা। ভাগে আধা শতক জায়গার মালিক হন শামীম। পাঁচ বছর আগে তার হাতে আসে জাদুর কাঠি। উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) গাড়ির ড্রাইভার হিসেবে চুক্তিভিত্তিক দিন হাজিরা চাকরি করেই শামীম এখন কোটিপতি। স্থানীয়দের কাছে তিনি এসিল্যান্ড নামেই পরিচিত। ড্রাইভার শামীম মোকামতলা মুরাদপুর এলাকার মহাসড়ক সংলগ্ন সর্বোচ্চ মূল্যের তিন শতক জায়গার ওপর কোটি টাকায় ফ্ল্যাট বাড়ি করেছেন। পাশেই কিনেছেন আরও সাড়ে ১০ শতক জায়গা। এসিল্যান্ডের গাড়িতেই পরিবার নিয়ে ঘুরে বেড়ান। পাঁচ তারকা হোটেলেও শামীমকে সময় কাটাতে দেখা যায়।
সম্প্রতি বগুড়া প্রেসক্লাবে শিবগঞ্জ উপজেলার এসিল্যান্ডের ড্রাইভার শামীম হোসেনের বিরুদ্ধে জমি খারিজের নামে টাকা নেওয়ার ব্যাপারে ভুক্তভোগীর সংবাদ সম্মেলনের পর ভূমি অফিসের লাগামহীন দুর্নীতির বিষয়টি প্রকাশ্য হয়। একটি জমির খারিজের জন্য ৪০ হাজার টাকা নেওয়ার অভিযোগ করা হয়। বেকায়দায় ফেলে স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেওয়া, জমি দখল ও অবৈধভাবে বালু উত্তোলন কাজে চাঁদা নেন শামীম। এমনকি খাস পুকুর এবং হাটের সরকারি জায়গা দখলের কাজেও কর্তার নামে টাকা নেন।
এসিল্যান্ডের ড্রাইভার হওয়ার সুযোগে দুর্নীতি করে ফ্ল্যাট বাড়িসহ নামে-বেনামে ৫/৭ বিঘা জমি কিনেছেন। গত ২০ অক্টোবর বগুড়া প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে এ অভিযোগ করেন শিবগঞ্জ উপজেলার শংকরপুর গ্রামের বিধবা স্বপ্না খাতুন।
অভিযোগ রয়েছে, একটি জমির খারিজ বা নামজারি করতে সরকার নির্ধারিত খরচের জন্য ১১শ টাকা ভাউচার হাতে ধরিয়ে দিয়ে দলিলভেদে ৮ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নেয় সিন্ডিকেট। ভূমি অফিসে প্রতিদিন ৮০ থেকে অন্তত ১০০টি জমির খারিজের কাজ নিয়ে যান সেবাপ্রার্থীরা।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, একটি জমির খারিজের জন্য ১০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। ১০০টি জমির খারিজে দুর্নীতির হিসাব দাড়ায় ১০ লাখ টাকা। সাব-রেজিস্ট্রি অফিসেও তাদের সক্রিয় সিন্ডিকেট রয়েছে। দুর্নীতির এই সাম্রাজ্যের দুই সেনাপতি হলেন উপজেলা ভূমি অফিসের নাইটগার্ড এনামুল হক এবং এসিল্যান্ডের ড্রাইভার শামীম হোসেন। তারা কাগজের একপাশে বিশেষ চিহ্ন স্বাক্ষর করে এসিল্যান্ডের টেবিলে পাঠায়। কর্মকর্তা কোনো কিছু জিজ্ঞেস না করেই কাজ সম্পন্ন করে দেন। ঘুষ দিলে আর কোনো ঝামেলা হয় না, মন্তব্য করেন ভুক্তভোগীরা।
শিবগঞ্জ উপজেলার আটমুল, দেউলি, বুড়িগঞ্জ, ময়দানহাটা, রায়নগর ও সৈয়দপুর এলাকার কয়েকজন জানান, ১১টি ইউনিয়ন ভূমি অফিসে তহসিলদাররা ঘুষ না পেলে ফাইলে হাত দেয় না।
উপজেলা ভূমি অফিসে এসিল্যান্ডের ড্রাইভার আর নাইটগার্ডের হাতে ঘুষ দিলেও কাজ হয়। টাকা ছাড়া ভূমি অফিসে কোনো সেবা মেলেনা। একটি জমির খারিজে ৮-১০ হাজার দিতে হয়। সুযোগ বুঝে ২৫-৩০ হাজারও নেয়। জমির শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য খরচ বাদে ঘুষ দিতে হয় ৩ হাজার টাকা। অছিয়তনামা দলিলের ঘুষ ৬ হাজার টাকা এবং প্রতি একর জমির জন্য ১ হাজার থেকে ১৫শ টাকা ঘুষ নেয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আটমুল এলাকার দুই ভুক্তভোগী জানান, এসিল্যান্ড নিজে ঘুষ গ্রহণ করেন না। তার মাধ্যম হলো নাইটগার্ড। একটি জমির খারিজের জন্য সরকারি খরচ ১১শ টাকার স্থলে ৮-১০ হাজার টাকা নেন এসিল্যান্ডের ড্রাইভার শামীম ও নাইটগার্ড এনামুল। টাকা না দিলে কাজ হয় না, যেকারণে মানুষ তাদের কাছেই যায়। তারা প্রতিদিন অনন্ত ৬০ থেকে ৭০টি খারিজের ঘুষ নেয়।
ইউনিয়ন ভূমি অফিস ছাড়াও উপজেলা ভূমি অফিসে যাওয়ার পর একটি জমির খারিজ বাদ সরকারি ফি ১১শ টাকা, এসিল্যান্ডের নামে ৪ হাজার টাকা, সার্ভেয়ারের নামে ১৫শ এবং ২ হাজার টাকা ড্রাইভার অথবা নাইটগার্ডকে দিতে হয়। অফিসের এক কর্মচারী জানান, সিন্ডিকেটের নিয়মে তারা একটি কাজে ২শ` টাকা পেলেও কর্তার আড়ালে প্রতিদিন কামাচ্ছেন লাখ টাকা।
এক ভুক্তভোগীর অভিযোগ, খতিয়ানে নামের করণিক বা অক্ষর সংশোধনের জন্য আবেদন/মিসকেস করতে গেলে ভূমি অফিসের সহকারী আব্দুল মোমিন ১২ হাজার টাকা দাবি করে। ১০ হাজার টাকা দেওয়ার পর কাজ হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ঘুষের টাকা কয়েকভাগে লেনদেন হলেও একজনের কাছে জমা হয়। টাকা জমার দায়িত্বে থাকেন ভূমি অফিসের নাইটগার্ড। এসিল্যান্ডের ড্রাইভার বা ইউনিয়ন তহসিলদাররা ঘুষ নিয়ে নাইটগার্ডের হাতে পৌঁছে দেন। তার মাধ্যমেই ঘুষ নেন কর্মকর্তা। এমটিই জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মচারী ও ভুক্তভোগীরা।
বগুড়া প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে এসিল্যান্ডের ড্রাইভারের বিরুদ্ধে ওঠা সকল অভিযোগ অস্বীকার করে গত ২১ অক্টোবর শিবগঞ্জে পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করা হয়। সেখানে শামীম হোসেন দাবি করেন, পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া জমি ব্যতিত তার কোন সম্পত্তি নেই। রূপালী বাংলাদেশ প্রতিবেদকের কাছে এসিল্যান্ডের ড্রাইভার শামীম ১৩ শতক জায়গা কেনার কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, বাবার সম্পত্তির ভাগে আধা শতক পেয়ে সেখানে আরও আড়াই শতক জায়গা কিনেছেন। মাঠে দুই ভাই মিলে নিয়েছেন ২১ শতক জমি। সেখানে শামীমের ভাগে সাড়ে ১০ শতক।
অন্যদিকে ভূমি অফিসের নাইটগার্ড এনামুল হকের মুঠোফোনে কল দিয়ে পরিচয় জিজ্ঞেস করতেই তিনি বলে ওঠেন, `কি কাজ! কাজের কথা বলেন। কাজের জন্য কল দিয়েছেন, পরিচয় দিয়ে কি করবেন!` তবে সাংবাদিক জানার পর তিনি পরিচয় দিয়ে বলেন, খারিজের জন্য কর্মকর্তার নামে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ ভিত্তিহীন। আমি কিছু বলবো না, স্যারকে কল দেন।
শিবগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. তাসনিমুজ্জামান বলেন, সেবাপ্রার্থীরা আবেদন নিয়ে ভূমি অফিসে সরাসরি আমার কাছে আসবে। কোনো দালাল বা মাধ্যমে গিয়ে কেউ প্রতারিত হলে আমি কি দোষী? ড্রাইভার শামীম বা নাইটগার্ডের কাছে তারা কেন যায়। আমার নাম ভাঙিয়ে টাকা নেওয়ার ব্যাপারে সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
আপনার মতামত লিখুন :