মাদকের থাবায় নাস্তানাবুদ একটি প্রজন্ম। শহর থেকে প্রত্যস্ত গ্রামাঞ্চল-সর্বত্রই নেশা এখন হাতের নাগালে। বিকাশ বা নগদে টাকা পাঠালেই মেলে বিভিন্ন মাদক পণ্য। এক যুগে অধিক সময় ধরে মাদকের বিস্তার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের অন্যান্য স্থানের মতই বগুড়ার ধুনট উপজেলাও যেন দিন দিন হয়ে উঠেছে মাদকের নগরী।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলার ১০ ইউনিয়নে ছড়িয়ে গেছে বিভিন্ন প্রকার মাদক। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অবাধে আসা গাঁজা, ইয়াবা, ট্যাপেন্টাডল, ফেনসিডিল ও হেরোইন সহ নানা প্রকার মাদক সর্বত্র ছড়িয়ে দিন দিন। সিরাজগঞ্জ জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা হওয়ায় মাদক ব্যবসায়ীরা ঢাকা থেকে যমুনা সেতু পার হয়ে বিকল্প বাইপাস রোড দিয়ে ঢুকে পড়ে বগুড়ার ধুনট উপজেলা সিমানায়। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা মাদক গুলো উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকার মাদক কারবারিদের সহায়তায় হাত বদলে উপজেলার বেশ কিছু জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। তবে মাদক কারবারি গ্রেপ্তার ও মাদকদ্রব্য উদ্ধার অভিযানে পুলিশের তৎপরতা থাকলেও তা খুব একটা অগ্রগতি দেখা মেলেনা। গত আগস্ট মাসের আগ পর্যন্ত যেমন মাদক বিরোধী অভিযান ছিল চোখে পড়ার মত। ৫ আগস্টের পর থেকে পুলিশ প্রশাসনের অভিযানিক খুব একটা তৎপরতা চোখে পড়েনি। মাদক কারবারিদের যাবতীয় কার্যক্রম গুলো থানা এলাকা থেকে দূরে হওয়ার ফলে সংবাদ পাওয়ার পর ঘটনাস্থলে পৌঁছার আগেই মাদক কারবারিরা পালিয়ে যায়। পুলিশ প্রশাসনের এমন কথা মানতে নারাজ স্থানীয় সুশীল সমাজের অনেকে। তারা বলছেন প্রশাসনের সৎ ইচ্ছে না থাকার কারণে বর্তমানে বেড়েছে মাদকের কারবার। তৎকালীন ওসি সৈকত হাসান দায়িত্বে থাকা কালীন দৃশ্যমান অনেক মাদক কারবারি গ্রেপ্তার হলেও বর্তমানে তেমন কোন গ্রেপ্তারই নেই।
এই উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে প্রায় ৪০টি বা তারও বেশি মাদক ক্রয়-বিক্রয় ও সেবনের স্থান বা ঘাঁটি রয়েছে। এরমধ্যে দক্ষিণ ধুনটের মথুরাপুর, গোপালনগর ও চৌকিবাড়ি এই তিন ইউনিয়নের মধ্যেই রয়েছে দুইডজনেরও বেশি ভ্রাম্যমাণ মাদক সেবন ও বিক্রয় কেন্দ্র। তারমধ্যে মথুরাপুর ইউনিয়নের অলোয়া, ধেরুয়াহাটি, মথুরাপুর, মধুপুর, গোয়াল ভাগ, পীরহাটি, শ্যামগাতী, হিজুলি, সাগাটিয়া, খাদুলি, শিমুলকান্দি, বগা জোলাগাতি, কুড়িগাঁতি, ছাতিয়ানী, গোপালনগর ইউনিয়নের মহিশুরা, রান্ডিলা, বানিয়াগাতী, বলারবাড়ি, খাটিয়ামারী গোপালনগর, চকমেহেদি, বাশপাতা, চৌকিবাড়ি ইউনিয়নে রুদ্রবাড়িয়া, ভূবনগাতী, জালশুকা, কোনাগাঁতি, বিষ্ণপুর, পাঁচথুপির কিছু অংশ উল্লেখযোগ্য। এসব এলাকার মধ্যে মথুরাপুর মাদকের রাজধানী হিসেবে পরিচিত। এর প্রায় সব স্থানেই দিনে ও রাতে মাদক বেচাকেনা ও সেবন হয়ে থাকে। উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা মাদক সেবীরা খুব সহজেই চিহ্নিত এসব মাদকের আখড়া থেকে মাদক সংগ্রহ ও সেবন করতে পারে। মাদক কারবারিরা প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় এমন অপরাধ কর্মকাণ্ড ঘটালেও এসব এলাকার মানুষজন ভয়ে কিছু বলতে পারে না। আবার কেউ পুলিশকে জানালেও তার উপর হামলার ঘটনাও ঘটে। অথবা তার কপালেই জোটে উল্টো মিথ্যা অভিযোগ। নানা অপপ্রচার চালিয়ে তাকেই মাদক কারবারি বানানোর চেষ্টা করা হয়। ফলে তারা মাদক ব্যবসায়ী ও সেবনকারীদের দ্বারা অতিষ্ঠ থাকলেও মুখ খুলতে সাহস পান না। এই উপজেলায় মাদক সহজলভ্য হওয়ার ফলে মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েছে কিশোর থেকে যুবক এমনকি বয়োবৃদ্ধরাও। ফলে চরম হতাশ ও দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ অভিভাবকমহল। উত্তর ধুনটেও প্রায় একই অবস্থা। এলাঙ্গী, কালেরপাড়া, নিমগাছী, চিকাশী ইউনিয়ন ছাড়াও পূর্বদিকে গোসাইবাড়ি, ভান্ডারবাড়ীতেও বাজার কেন্দ্রিক মাদক কারবারিদের আনাগোনা দেখা যায়। উপজেলার পূর্ব ও উত্তর এলাকার মধ্যে গোসাইবাড়ী, ভান্ডারবাড়ী স্পার এলাকা, বড়বিলা বাজার, হবির মোড় থেকে চিকাশী সড়কের ফাঁকা স্থান, চিকাশী থেকে চাপড়া সড়কের নির্জন জায়গা, ধামাচামা ইট ভাটা ও বাঙ্গালী নদীর তীর এলাকা, সোনাহাটা বাজার পশ্চিম এলাকা, নিমগাছী ক্লিনিক থেকে ঈশ্বরঘাট সড়ক, সরুগ্রাম স্কুল বাউন্ডারীর ভিতর, কান্তনগর গরু হাটের পশ্চিমে। মূল হাট থেকে হাঁসাপোটল সড়ক, বিলচাপড়ী নদীর তীরবর্তী এলাকা, এলাঙ্গী বাজার থেকে ঝাঁঝর ঘাট, সদর ইউনিয়নের চালাপাড়া, ইছামতি নদী এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে মাদক কারবারিদের সেবন ও কেনাবেচা করতে দেখা যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় অনেকেই জানান, ধুনটে মাদক এতটাই বেড়েছে যে, এটা নিয়ন্ত্রণ করা না হলে যুব সমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে। বিগত সময়ের চেয়ে বর্তমানে মাদকের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। মাদক নিয়ন্ত্রণ না হওয়ার ফলে শিক্ষার্থীসহ যুব সমাজ মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েছেন। মাদকসেবী বেশি হওয়ার ফলে এলাকায় চুরি বেড়ে গেছে। মাদক উদ্ধারে প্রশাসনের তৎপরতা কমে যাওয়ার কারণে উপজেলাজুড়ে মাদকে বিস্তার ঘটছে। তারা মাদক উদ্ধারে প্রশাসনের জোর তৎপরতা দাবি করেন। সচেতন মহলের অনেকে মনে করেন মাদক বিক্রি ও সেবন নিয়ন্ত্রণ না হলে শিক্ষার্থীসহ যুবসমাজ ধ্বংসের পাশাপাশি অভিভাবকরা হয়ে পড়বেন অসহায় ও শিক্ষা বিমুখ।
ধুনট থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সাইদুল আলম জানান, মাদকের বিরুদ্ধে ধুনট থানা পুলিশ যথেষ্ট তৎপর রয়েছে। সাধারন মানুষ সচেতন না হলে শুধু প্রশাসন দিয়ে মাদক নির্মূল করা যাবেনা। স্থানীয় সচেতন নাগরিকদের এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে অবিভাবকদের যথেষ্ট ভুমিকা রাখতে হবে। এক প্রশ্নর জবাবে তিনি বলেন আগষ্টের পর কিছু দিন প্রশাসনিক বা দাপ্তরিক কাজের কিছু স্থবিরতা ছিলো। এই সময়টাতে মাদক কারবারিরা সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। মাদকের বিরুদ্ধে পুলিশে তেমন কোন তৎপরতা নেই জনগনকে এমন ভাবনা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আমাদের কে সহযোগিতা করতে হবে। তবেই মাদকের বিরুদ্ধে সম্মিলিত একটি ঐক্য হওয়া সম্ভব।