ঢাকা শনিবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২৪

অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ নিয়ে কেন কাউন্টডাউন

মো. সায়েম ফারুকী

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৬, ২০২৪, ১০:৪১ পিএম

অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ নিয়ে কেন কাউন্টডাউন

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

যুদ্ধবিধ্বস্ত না হলেও দুর্নীতি আর লুটপাটে বিধ্বস্ত এবং অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর দেশকে ধ্বংসস্তূপ থেকে টেনে তুলতে দায়িত্ব নেওয়া প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছেন উপদেষ্টা পরিষদের ২৪ সদস্য। দেশ গঠনে তাদের একটু সময় দেওয়া বাঞ্ছনীয় নয় কি? অধৈর্য হলে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে রাষ্ট্রের। ভেস্তে যেতে পারে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সুফল। ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে সাড়ে ১৫ বছরের ফ্যাসিস্ট সরকারের ধ্বংস করা গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা ও ভঙ্গুর অর্থনীতি সচল করার উদ্যোগ। গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির পাশাপাশি নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাজ করতে সময় দেওয়া না হলে ঘুরেফিরে আবারও সেই স্বৈরাচারেরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে।

জুলাই ৩৬ অথবা ৫ আগস্ট, বাংলাদেশে একটি নতুন ইতিহাস রচিত হয়েছে। অভ্যন্তরীণভাবে স্বাধীন হয়েছে ফ্যাসিবাদী-স্বৈরাচারের হাত থেকে। ভোটারবিহীন লোকদেখানো নির্বাচন করে দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিল অসংখ্য প্রাণের বিনিময়ে। ডিজিএফআই, র‌্যাব, বিজিবি ও পুলিশকে দিয়ে গুম-খুন আর নির্যাতনের মধ্য দিয়ে গদি ঠিক রেখেছিলেন গণঅভ্যুত্থানে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা। প্রাথমিকভাবে এই গণঅভ্যুত্থান ঘটানোর পুরো কৃতিত্বই দিতে হবে শিক্ষার্থীদের। কোটামুক্ত বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন একসময় রূপ নেয় এক দফায়, অর্থাৎ সরকার পতনে। তখন তাদের এই আন্দোলনে যুক্ত হন অভিভাবক, শিক্ষক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীসহ সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ। যুক্ত হন আওয়ামী লীগবিরোধী সব রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরাও।

শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন শেষে পেশায় যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে ‘নিয়োগ কোটা’য় চরম অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছিল। সেই অনিশ্চয়তা কাটাতে কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলন একসময় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়। শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক এই ছোট্ট দাবি না মেনে শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী, নেতাকর্মীরা নানাভাবে তকমা লাগানোর চেষ্টা করেছিলেন। পুলিশের পাশাপাশি ছাত্রলীগ লেলিয়ে দেওয়ার পর সারা দেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। একের পর এক হত্যার শিকার হন শিক্ষার্থীরা। কোটা আন্দোলন থেকে শিক্ষার্থীরা ওবায়দুল কাদেরসহ তিন মন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে সোচ্চার হন। আন্দোলন দমাতে সারা দেশে পুলিশ-ছাত্রলীগের নৃশংসতা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ছাত্র-জনতার এই আন্দোলন সরকারপতনের এক দফায় রূপ নেয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সড়কে লাশের সারি দীর্ঘ হতে শুরু করে। শহিদ সাঈদ-মুগ্ধর মতো হাজারো শিক্ষার্থী-জনতার রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ।

অবশেষে আসে কাক্সিক্ষত সেই দিন জুলাই ৩৬ বা ৫ আগস্ট। সমস্ত অহংকার চূর্ণ হয় গণতন্ত্র ধ্বংস করা শেখ হাসিনার। ছোট বোনকে সঙ্গে নিয়ে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার হাত থেকে বাঁচতে পদত্যাগের পর পালিয়ে যান ভারতে। রাষ্ট্রের অচলাবস্থা কাটাতে নোবেল বিজয়ী বাংলাদেশের অহংকার ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় আন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

৮ আগস্ট নতুন বাংলাদেশে স্বৈরাচারমুক্ত একটি সরকার যাত্রা শুরু করে। নতুন এই সরকারকে অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর, দুর্নীতি আর লুটপাটে বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে টেনে তোলার দায়িত্ব নিয়ে পথচলা শুরু হয়। নতুন এই সরকারের পথচলার মাত্র তিন মাস অতিবাহিত হয়েছে। এই তিন মাসে কার্যদিবস ছিল মাত্র ৬৬ দিন। পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবার, মন্ত্রী, নেতাকর্মী ও আওয়ামী ব্যবসায়ীদের ব্যাংক লুটপাটে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হওয়া দেশ নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে এই ৬৬ কার্যদিবসে অধৈর্য হয়ে উঠেছেন কেউ কেউ! প্রশ্ন হচ্ছে, অধৈর্য হয়ে ওঠা এসব মানুষ কোথায় ছিলেন স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরে? গণতন্ত্র ধ্বংস করে অস্ত্রের মুখে ভোটারবিহীন চার-চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো, কতটিতে বাধা দিয়েছিলেন? এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, তখন এতটা অধৈর্য ছিলেন না তারা। তাহলে কি প্রশ্নের উদ্রেক করে না, দেশকে ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে টেনে তোলার যুদ্ধে ৯০ দিনের ৬৬ কার্যদিবস কি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য যথেষ্ট?

দেশের অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার না হয়ে কোনো রাজনৈতিক দলের সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করলে হয়তো রাষ্ট্র বাঁচানোর যুদ্ধে পরাস্ত হতো। সে ক্ষেত্রে পতিত সরকার দেশকে যে অবস্থায় রেখে পালিয়েছিল, তাতে নেমে আসতে পারত দুর্ভিক্ষ। ৯০ দিনের ৬৬ কার্যদিবসের যুদ্ধে কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার সফল। এটার সঙ্গে বোধকরি কোনো বিবেকবান মানুষ দ্বিমত পোষণ করবেন না। সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলার অভ্যাস যাদের নেই, তাদের কথা আলোচনায় না আনাই ভালো। কারণ তারা বুদ্ধিজীবী নন, সাধারণ মানুষ বরং তাদের বুদ্ধিবিক্রেতা হিসেবে আখ্যায়িত করছে। তাই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টার যুদ্ধকে তারা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেন না। যদি তাদের বিবেক জাগ্রতই থাকত, তাহলে পতিত স্বৈরাচারী সরকারের সাড়ে ১৫ বছর, অর্থাৎ ৫ হাজার ৬৫৭ দিনে যা করেছে, তার তুলনায় অন্তর্বর্তী সরকারের ৯০ দিনের কর্ম নিয়ে অস্থির হতো না।

দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির শীর্ষ নেতা তারেক রহমান বারবার বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে আরও সময় দেওয়া উচিত। কারণ তাদের রাষ্ট্র সংস্কারসহ নির্বাচনি প্রক্রিয়াও সংস্কার করতে হবে। বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে রাষ্ট্রব্যবস্থায়। এরপর নির্বাচন দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার নতুন নির্বাচিত সরকারের হাতে দায়িত্ব দিয়ে বিদায় নেবে। এমন বক্তব্য আসছে বিএনপি-জামায়াতসহ অন্য রাজনৈতিক দলের কাছ থেকেও। তাই স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্নের উদ্রেক করছে, তাহলে কারা অন্তর্বর্তী সরকারের মাত্র ৯০ দিনেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছেন? আসলে কী চাইছেন তারা? তারা কি পতিত স্বৈরাচার সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে যা ঘটেছে, তা দেখেননি। তারা কি বাংলাদেশে ছিলেন না? দুর্নীতি আর লুটপাটে বিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তুলতে প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে উপদেষ্টা পরিষদকে অবশ্যই পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে। এ ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। দলমত-নির্বিশেষে তাদের সহযোগিতা করা প্রয়োজন। তা না হলে ছাত্র-জনতার এত বড় অর্জন ভেস্তে যেতে পাওে, যা দেশবাসীর কাছে মোটেই কাম্য নয়। রাজনৈতিক দল ও গণতন্ত্রকামী জনসাধারণের ইচ্ছার মতো আমারও একই মত, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে দেশ গঠনে তথাকথিত বিরোধিতার নামে বিরোধিতা না করে প্রয়োজনমতো সময় দেওয়া ও সার্বিক সহযোগিতা করা হোক।
 

আরবি/জেডআর

Link copied!