জয়পুরহাটের আক্কেলপুরে চলতি মৌসুমে ৬১২০ হেক্টর জমিতে আলুচাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ। এরই বিপরীতে উপজেলায় ৯৮১০ মেট্রিক টন আলুর বীজের চাহিদা রয়েছে। হিমাগারে কৃষকের সংরক্ষিত ও বিভিন্ন কোম্পানীর মিলে মোট চাহিদার অর্ধেকেরও বেশি পরিমাণ আলুর বীজ বাজারে সরবরাহ রয়েছে। এখনো উপজেলায় আমন ধান কাটা-মাড়াই শেষ হয়নি। একারণে পুরোদমে আলুচাষ শুরু হয়নি। অথচ কৃষকেরা চাহিদা অনুযায়ী আলুর বীজ বাজারে পাচ্ছেন না। এখন বেশী ভাগই আলুর বীজ ব্যবসায়ীদের দোকান ও গুদামে আলুর বীজ নেই। কতিপয় ব্যবসায়ীরা নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে প্রতি মণে এক থেকে দেড় হাজার টাকা বেশি নেওয়ার পর দু-একদিন পর অজ্ঞাত স্থান থেকে ভোর বেলায় আবার রাতে গোপনে ভ্যানযোগে কৃষকদের কাছে আলুর বীজ পৌঁচ্ছে দিচ্ছেন। এভাবে আলু বীজের সংঙ্কট দেখিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা চলতি মৌসুমে আলুর বীজ বিক্রি করে লক্ষ- লক্ষ টাকার অধিক মুনাফা লুটে নিচ্ছেন। স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন ও কৃষি বিভাগ বিষয়টি জানার পরও ভ্রাম্যমান আদালত এক জায়গায় লোক দেখানো জরিমানাও করেছে। তবে উপজেলা প্রশাসন ও কৃষি বিভাগ বলছে, আলু বীজ নিয়ে নিয়মিত বাজার তদারকি করা হচ্ছে। অনিয়ম পেলেই ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে সংশ্লিষ্টদের জরিমানার করে সর্তক করা হচ্ছে।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে এ উপজেলায় ৬১২০ হেক্টর জমিতে আলুচাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৯৮১০ মেট্রিক টন আলুর বীজের চাহিদা রয়েছে। এখনো আমন ধান কাটা-মাড়াইয়ের কাজ শেষ হয়নি। একারণে পুরোদমে আলুর চাষ শুরু হয়নি। বাজারে যে পরিমাণ আলুর বীজ সরবরাহ রয়েছে। তাতে আলুর বীজের কোন সঙ্কট থাকার কথা নয়। কৃষি বিভাগ মাঠ পর্যায়ে আলুর বীজ নিয়ে নিয়মিত তদারকি করছে।
জেলার মধ্যে আক্কেলপুর উপজেলা কৃষি প্রধান এলাকা। আলু সহ শীত কালীন মৌসুমে সবজি চাষের জন্য বিখ্যাত। উপজেলার ১৫-২০ জন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় বিএডিসি, ব্র্র্যাক, এসিআই, ইস্পাহানী, সুপীম (হীরা) ও ইউন কোম্পানীর আলুর বীজের চাহিদা বেশি। তার মধ্যে ব্র্যাকের বীজের চাহিদা সর্বচেয়ে বেশি। ব্র্যাকের এ গ্রেডের বীজের মণ ৩১৬০ ও বি-গ্রেডের ৩০৪০ টাকা। অনান্য কোম্পানীর আলুর বীজের প্রকার ভেদে একটু দাম কম-বেশি রয়েছে। তবে ব্র্যাকসহ অনান্য কোন কোম্পানীর আলুর বীজ খুচরা দোকানে পাওয়া যাচ্ছে না। এসব খুচরা ব্যবসায়ীদের নির্ধারিত এক থেকে দেড় হাজার টাকা বেশি দিলে তাঁরা আলুর বীজ জোগাড় করে দিচ্ছেন। দোকানীরা বেশি দাম নিলেও তাঁরা কৃষকদের কোন রসিদ দিচ্ছেন না। চলতি মৌসুমে আলুর বীজের অভাবে আলুচাষ করতে পারবেন কি না শঙ্কায় রয়েছেন আলু চাষিরা।
উপজেলার হিজলী এলাকার কৃষক মো. বাবর আলী বলেন, আমার পরিবারে ১২ বিঘা জমিতে আলু আবাদ করতে প্রতি ৪০ কেজি বস্তার ওজন হলে ৫০ বস্তা বীজ প্রয়োজন। আলুর বীজের জন্য সাত-আট ধরে দিন খুচরা দোকানে ঘুরে ঘুরেও পাচ্ছি না। আলু বীজ নির্ধারিত দামে বিক্রিও হচ্ছে না। গোপনে ব্র্যাকের আলুর বীজ ৪০০০ থেকে ৪৫০০ টাকায় বিক্রি ও ভোরে এবং রাতে ভ্যানযোগে আলু পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। এবার আলুর বীজে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করেছে।
সাবেক ইউপি সদস্য মো. আব্দুর রতন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, কয়েক দিন থেকে দোকানে দোকানে ধন্না দিয়েও এক বস্তা আলুর বীজ কিনতে পারিনি। গত বছর এসময় আলুর বীজ প্রতি বস্তা দাম ছিল ২০০০থেকে ২৫০০ টাকা করে। এবার দাম বেশি হওয়া সত্ত্বেও আলুর বীজ পাচ্ছি না।
আক্কেলপুর কলেজ বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী ও বীজ ডিলার ভাই-ভাই ট্রের্ডাসের মালিক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমি চলতি মৌসুমে জয়পুরহাটে ব্র্যাক বীজ ডিলারের কাছে ৬০০ বস্তা আলুর বীজের চাহিদা দিয়ে টাকা জমা দিয়েছিলাম। এ পর্যন্ত ডিলার আমাকে মাত্র ৩৬৩ বস্তা আলুর বীজ দিয়েছে। আমি ইস্পাহানী, সুপীম (হীরা) ও বি এ ডি সির বীজ ডিলার। সুপীম (হীরা) ১৯টন ও ইস্পাহানী ৩৫টন এবং বি এ ডি সি ৪টন বীজ পেয়েছিলাম। বর্তমানে আমার ঘরে এক বস্তাও আলুর বীজ নেই। কয়েক দিন থেকে কৃষরা বীজ কিনতে এসে ঘুরে ঘুরে যাচ্ছেন। তিনি নির্ধারিত দামে আলুর বীজ বিক্রি করেছেন বলে দাবি করেছেন।
খুচরা ব্যবসায়ী আব্দুর রশিদ বাবু রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমি কলেজ বাজার ভাই-ভাই ট্রের্ডাসের মালিক আব্দুর রাজ্জাককে সুপীম (হীরা) ৭৫০ বস্তা ও ব্র্যাকের ৩০০ বস্তা আলুর বীজের জন্য চাহিদা দিয়েছিলাম। রাজ্জাক আমাকে হীরা ২০০বস্তা আলুর বীজ দিয়েছে। ক্ষেতলাল উপজেলার পাঠান পাড়া এলাকার আলু বীজ ব্যবসায়ী গোলাম আজমকে ৫০০ বস্তা ব্র্যাকের ও ইউন বীজের জন্য টাকা দিয়েছিলাম। তার মধ্যে মাত্র ২০০ বস্তা ইউন কোম্পানীর আলু বীজ দিয়েছে। বাকি ৩০০ বস্তার টাকা আজও ফেরত পাইনি। চাহিদা অনুযায়ী আলুর বীজের সরবরাহ কম। একারণে চাহিদামতো আলুর বীজ সরবরাহ করা যাচ্ছে না।
ব্র্যাক সীডের টেরিটরি সেলস কর্মকর্তা মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, জয়পুরহাট জেলায় ১৪ জন ডিলার রয়েছে। ডিলারেরা ১৫ হাজার মেট্রিক টন আলুর বীজের চাহিদা দিয়েছিলেন। এরই বিপরীতে ৬ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন আলুর বীজ সরবরাহ করা হয়েছে। নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কেউ বেশি দাম বিক্রি করলে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মো. ইমরান হোসেন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, উপজেলার তিলকপুর, রায়কালী, গোপীনাথপুর, কলেজ বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে আলুর বীজের বাজার মনিটরিং করা হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন মনিটরিংএ সহযোগিতা করছে। কলেজ বাজারের খুচরা বীজ ব্যবসায়ী মোঃ দুলাল হোসানকে আলু বীজের দাম বেশি নেওয়ায় ২হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী আলুর বীজ সিন্ডিকেট করে অধিক মুনাফা লুটছেন। বাজার মনিটরিং অব্যহত রয়েছে। এ উপজেলায় ১৯ জন বি এ ডি সির ডিলার রয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মনজুরুল আলম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি দামে আলুর বীজ বিক্রি ও মজুদ রয়েছে মর্মে অভিযোগ পাওয়া যায়। অভিযোগের ভিত্ততে সেইসব স্থানে যাওয়া হলে কোনো আলামত পাওয়া যাচ্ছে না। বাজার তদারকি করা হচ্ছে। আমি ঢাকায় বি এ ডি সি বীজ বিভাগে আক্কেলপুর উপজেলায় আলু বীজের সংকটের কথাও বলেছি।
আপনার মতামত লিখুন :