ঢাকা-সিলেট জাতীয় মহাসড়ক ছয় লেনে সম্প্রসারণ কাজ কোথাও কাজ চলমান, কোথাও কচ্ছপ গতি। কাজ শুরুর পর দীর্ঘদিন ধরেই এমন অবস্থা। দেখার যেন কেউ নেই, বলারও না! ঠিক যেন বেওয়ারিশ। দীর্ঘদিন সংস্কার না করা এবং কাজ শুরু করে এভাবে ফেলে রাখায় স্থানে স্থানে তৈরি হয়েছে খানাখন্দ। বিশাল বিশাল খাদ। গর্ত মাড়িয়েই গন্তব্যে যাত্রীদের নিয়ে পৌঁছাতে হয় যানবাহনগুলোকে।
তবে এ পথ নতুন করে দীর্ঘ হয়নি। দূরত্ব আছে ঠিক আগের মতোই! শুধু সড়কপথ ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ায় সময় লাগছে অন্য সময়ের তুলনায় প্রায় তিনগুণ! আগে যেখানে ৪ ঘণ্টায় ঢাকা থেকে সিলেটে পৌঁছানো যেত, এখন সেখানে সময় লাগছে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা। এসব কারণে বিরক্তিকর জার্নির গন্তব্য হয়ে উঠছে সিলেট। বিমুখ হচ্ছেন সড়কপথে ভ্রমণে ইচ্ছুক যাত্রীরা। তারা এড়িয়ে চলছেন সিলেটকে। শুধু ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ায় সিলেটে পর্যটন ব্যবসা থেকে শুরু করে সবরকম ব্যবসা-বাণিজ্যে পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব। এভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ায় বাড়ছে দুর্ঘটনাও।
প্রতিদিনই খবর মিলছে প্রাণহানির। সবমিলিয়ে ভোগান্তির অপর নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে সিলেট-ঢাকা জাতীয় মহাসড়ক।
প্রায় দুই বছর ধরে এই মহাসড়কের যাত্রীরা মারাত্মক দুর্ভোগ পোহালেও কাজে গতি আসছে না। সড়ক ও জনপথ-সওজ বলছে, ছয় লেনের কাজ চলায় তারা ভাঙাচোরা মহাসড়ক মেরামতে খুব বেশি অর্থ ব্যয় করতে রাজি না। কোনোমতে জোড়াতালি দিয়ে সংস্কার চালিয়ে যান চলাচল স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা চলছে এখন। তারা চেষ্টা করছেন সংস্কারকাজে গতি আনার।
সওজ জানায়, বিভিন্ন স্থানে সড়কের পাশ থেকে স্থানীয়রা জায়গা ছেড়ে না দেওয়ায় অনেক স্থানে কাজই শুরু হয়নি। তবে এই জটও এখন ছুটতে শুরু করবে। এমনটি আশা করছে তারা। এ লক্ষ্যে সিলেটের জেলা প্রশাসক গত মঙ্গলবার সড়ক পরিদর্শন করে স্থানীয়দের পাওনা দ্রুত পরিশোধ করার প্রতিশ্রুতি দেন।
ঢাকা-সিলেট ছয়লেন সম্প্রসারণ প্রকল্পের সিলেট অঞ্চলের প্রজেক্ট ম্যানেজার প্রকৌশলী দেবাশীষ রায় দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এখন যেভাবে কাজ চলছে, এভাবে চললে যথাসময়ে শেষ করা সম্ভব হবে না। এর কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, জায়গা সংকট। প্রকল্প এলাকাগুলোতে জমির মালিকরা জায়গা ছাড়ছেন না। বিশেষ করে বাজার এলাকায়। জায়গা পেয়ে গেলে আগামী ৩ বছরের মধ্যে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব। জায়গা সংকটের কারণে আমাদের টেনে টেনে কাজ করতে হচ্ছে। এই জট খুলে গেলেই কাজে গতি আসবে।
সওজ সূত্র জানায়, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি-একনেক সিলেট-ঢাকা ৬ লেন মহাসড়ক প্রকল্পের চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। এই প্রকল্পের আওতায় নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর থেকে সিলেট পর্যন্ত ২০৯ কিলোমিটার সড়ক ছয় লেনে উন্নীতকরণ সম্প্রসারণ এবং সিলেট-তামাবিল মহাসড়কের ৫৬ দশমিক ১৬ কিলোমিটার এলাকা চার লেনে উন্নীতকরণ করার কথা।
এর মধ্যে সিলেট-ঢাকা মহাসড়ক প্রকল্পের মেয়াদ ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রকল্পের প্রায় চার বছর চলে গেলেও এখন পর্যন্ত প্রকল্পের মাত্র ১১ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে জমি অধিগ্রহণ জটিলতা প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সূত্র জানায়, সিলেট অঞ্চলের যেখানে অধিগ্রহণ হয়েছে, ওই এলাকাগুলোর জমির মালিকদের অর্থ কর্তৃপক্ষ থেকে যথাসময়ে প্রদান করা হয়নি। জমির মূল্য না পেয়ে কেউই দখল ছাড়ছিলেন না। সে জন্য এ বছরের প্রথম দিকে সরকার সড়ক ও জনপদ বিভাগ থেকে জেলা প্রশাসকের কাছে ৭০০ কোটি টাকা দিয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন সিলেটের জেলা প্রশাসক রাসেল হাসান দলিলের বালাম বইয়ের পাতা চুরি হওয়ায় চেক করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছিলেন। বালাম বই চুরি নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন একাধিক মন্ত্রী। জেলা প্রশাসক সড়ক বিভাগকে জমি বুঝিয়ে না দেওয়ায় কাজের টেন্ডার দিতে পারেনি। পরবর্তীতে চাপের কারণে জেলা প্রশাসক জমি অধিগ্রহণ শুরু করেন।
বর্তমানে মহাসড়কটির বিভিন্ন স্থানে একপাশ বন্ধ রেখে সম্প্রসারণ কাজ চলছে। বেশ কয়েকটি স্থানে চলছে সেতু ও কালভার্ট নির্মাণকাজ। নির্মাণকাজের কারণে সড়ক সরু হয়ে যাওয়ায় প্রতিদিন সৃষ্টি হচ্ছে দীর্ঘ যানজটের। এ ছাড়া মহাসড়কের সিলেট বিভাগ অংশের বিভিন্ন স্থানে নির্মাণকাজ ছাড়াও ভোগান্তি বাড়িয়েছে মহাসড়কের খানাখন্দ। বিভিন্ন স্থানে সড়ক দেবে গেছে। কোথাও তৈরি হয়েছে বড় বড় গর্তের। আবার কোথাও পিচ সরে গিয়ে নিচের পাথর বের হয়ে এসেছে। এসব কারণে যানবাহনের গতি কমে আসায় যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। বাড়ছে দুর্ঘটনার সংখ্যাও।
সূত্র জানায়, মহাসড়কের সিলেট অংশের হবিগঞ্জের মাধবপুর থেকে অলিপুর পর্যন্ত প্রায় ১৫ কিলোমিটার সড়ক এবং সেতু ও কালভার্ট সম্প্রসারণ কাজ চলছে। সিলেটের ওসমানীনগর, বালাগঞ্জ ও দক্ষিণ সুরমার কয়েকটি স্থানে সড়ক সম্প্রসারণের কাজ চলছে। কিন্তু কাজে ধীরগতি থাকায় দুর্ভোগ থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না যাত্রীরা। মহাসড়কের সিলেট অংশের শতাধিক স্থানে খানাখন্দ ও ভাঙা থাকায় অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই চলাচল করতে হচ্ছে যানবাহনকে।
তবে মহাসড়কজুড়ে খানাখন্দ থাকলেও সওজ সংস্কারকাজে খুব বেশি জোর দিচ্ছে না। তারা পুরোনো সড়কে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ে না গিয়ে যানবাহান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে যতটুকু সংস্কার প্রয়োজন কেবল ততটুকু করছে। এজন্য অনেক জায়গায় ইট বসিয়ে সড়ক যোগাযোগ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে।
এদিকে সড়কের অবস্থা বেহাল হওয়ায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে দুর্ঘটনার হারও আগের থেকে অনেক বেড়েছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সিলেট বিভাগের সড়কে ২৪টি দুর্ঘটনায় ২০ জনের প্রাণহানির মধ্যে মহাসড়কে প্রাণ ঝরেছে বেশি।
আপনার মতামত লিখুন :