দৈনন্দিন জীবনের সব ক্ষেত্রেই লেগেছে নতুনত্বের ছোয়া, গড়ে উঠেছে অত্যাধুনিক মানের সেলুন, জেন্টস পার্লার। এসব সেলুনে চলছে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। এর মাঝেও সারিয়াকান্দি উপজেলার পৌর বাজার, কুতুবপুর, বড়িকান্দি, পাকুল্লা, হাসনাপাড়া হাটবাজারে নিম্ন আয়ের মানুষের চাহিদা মেটাতে আজো টিকে আছে আবহমান বাংলার সেই চিরচেনা পিঁড়িতে বসা সেলুন।
স্বভাবগতভাবেই মানুষ সুন্দরের পূজারি। ছেলেদের সৌন্দর্যের অনেকটাই বহন করে চুল-দাড়িতেই। তাই সৌন্দর্যবর্ধনে নরসুন্দর বা নাপিতদের কদর ও প্রয়োজনীয়তাও অনেক বেশি। রূপসজ্জা এক সময় শুধু মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও আধুনিক যুগে মেয়ে, ছেলে উভয়ের ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য। ফলে মেয়েদের বিউটি পার্লারের পাশাপাশি নগরে গড়ে উঠেছে ‘জেন্টস পার্লার’ যা শুধুমাত্রই ছেলেদের। ছেলেদের রূপসজ্জা মানেই নিজেকে আরেকটু ব্যক্তিত্বপূর্ণ করে গড়ে তোলা। কারণ তাদেরই তো তুলনামূলক ঘরের বাইরে বেশি ঘোরাফেরা করতে হয়। তাই ত্বকে রোদ-বৃষ্টিসহ রাস্তার ধুলাবালি আর নানা ধরনের রোগ-জীবাণুর সরাসরি সংস্পর্শে ক্ষতিকর প্রভাবটা পুরুষদের ওপরই বেশি পড়ে। তাই আজকাল ছেলেদের পার্লারগুলোর চাহিদাও বাড়ছে। এই সব জেন্টস পার্লারে রয়েছে পুরুষদের রূপসজ্জার জন্য বিভিন্ন ধরনের প্যাকেজ সুবিধা। এদের মধ্যে হেয়ার কাটিং এবং বিয়ার্ড শেভিং সবচেয়ে পরিচিত। তাছাড়া রয়েছে বিভিন্ন ধরনের শ্যাম্পুর সাহায্যে চুল ধোয়া, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে এন্টি ড্যানড্রাফ শ্যাম্পু, হারবাল শ্যাম্পু, সুগন্ধি শ্যাম্পু প্রভৃতি। অন্যদিকে আরামদায়ক বডি ম্যাসাজ, স্পা, স্টীম বাথ প্রভৃতিরও সুযোগ রয়েছে এসব পার্লারে। জেন্টস পার্লারগুলো গ্রাহক প্রিয়তার জন্য আয়োজন করে বিবিধ সেবার।
যেমন- ওয়েটিং রুম ব্যবস্থা, যেখানে সময়কাটানোর জন্য রয়েছে রঙ্গীন টেলিভিশন, এছাড়াও থাকে পত্রিকা ও ম্যাগাজিন, থাকে কিডস জোন। চুল কাটতে আসা শিশু কিংবা অভিভাবকদের সাথে আসা শিশুদের জন্য এই জোন। সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে জেন্টস পার্লারগুলো সর্বতোভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রীত।
আনাচেকানাচে আধুনিক ছেলেদের সেলুনে ভিড় বেড়েই চলেছে। আর এই আধুনিকতার ছোঁয়ায় কারণে বর্তমানে সারিয়াকান্দি উপজেলায় হাট-বাজার, গ্রামগঞ্জের ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দর বা নাপিত সম্প্রদায়ের পিঁড়ি বা টুলে বসিয়ে চুল ও দাড়ি কাটার দৃশ্য এখন বিলুপ্তির পথে।
জানা যায়, হাট-বাজারের পরিত্যক্ত খোলা জায়গায়, রাস্তার কিনারে, ফুটপাতে ছাতা ও পলিথিনের নিচে বসে বংশ পরম্পরায় পিঁড়িতে বসা সেলুনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন নাপিতরা। বিভিন্ন গ্রাম থেকে দরিদ্র লোকেরা হাটবারে চুল কাটতে এসব সেলুনে আসেন। তবে যারা আসেন তাদের অধিকাংশই বৃদ্ধ ও প্রবীণ। এসব সেলুনে চুল কাটতে ২০ থেকে ৩০ টাকা ও শেভ করতে ১০ থেকে ২০ টাকা লাগে। সারাদিন কাজ শেষে একজন নাপিত পান ৩শ থেকে ৪শ টাকা। এই টাকাতেই চলে ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়াসহ সংসারের যাবতীয় খরচ। বছর শেষে আয় বলতে কিছুই থাকে না তাদের। ফলে একটি আধুনিক সেলুন তৈরি করতে পারছেন না তারা।
সারিয়াকান্দি উপজেলার হাটবাজারে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তার পাশে ফুটপাতে পিঁড়িতে বসে সামনে কাঠের টুল নিয়ে ২ জন নাপিত লোকজনের চুলদাড়ি কাটছেন। তাদের পাশেই কাঠের তৈরি একটি পিঁড়ির উপর ছোট গামছায় চুল কাটা ও শেভ করার সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি রাখা আছে। বাগবের গ্রামের দুলাল মিয়া (৩৮) এক ব্যক্তিকে পিঁড়িতে বসিয়ে হাঁটুর কাছে মাথা নিয়ে চুল কাটছেন শমশের আলী সরদার (৬৫) নামের এক নাপিত। চুল-দাড়ি কাটার অপেক্ষায় বসে আছেন আরো কয়েকজন লোক-এমন দৃশ্য চোখে পড়ে পৌর হাটে। প্রতি শনিবার ও মঙ্গলবার হাটে পিঁড়ি নিয়ে বসেন নাপিতরা।
চুল দাড়ি কাটতে আসা ওবাইদুল এর সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, আমি ছোট থেকেই এনাদের কাছ থেকে চুল দাড়ি কাটাই। আধুনিক সেলুনে শুধু শেভ করতে লাগে ৩০-৫০ টাকা আর চুল-দাড়ি সহ ৭০ থেকে ৮০। এই সেলুনে শেভ করতে লাগে ১০ থেকে ২০ টাকা চুল কাটাতে লাগে ২০ থেকে ৩০ টাকা। আমাদের পক্ষে অতো টাকা দিয়ে আধুনিক সেলুনে চুল ও সেভ করা সম্ভব না। এখান থেকে কাটলে বেশি টাকা খরচ হয় না।
বড়িকান্দি গ্রামের চুল কাটাতে আসা সামছুল বলেন, চেয়ারে বসে চুল কাটালে লাগে ৫০ টাকা। আর এখানে লাগে ২০ টাকা। আমরা গরিব মানুষ। তাই এখানে ২০ টাকা দিয়ে চুল কাটাতে আসি। রবিবার ও বুধবার হাটে নাপিতরা বসে। তবে এখানে যারা চুল দাড়ি কাটায় তাদের সবাই গরিব ও বৃদ্ধ মানুষ বলে তিনি জানান।
হাসনাপাড়া গ্রামের নাপিত শমশের আলী সরদার বলেন, আমি পিঁড়িতে বসিয়ে প্রায় ২৫ বছর ধরে এ কাজ করছি। আগে এই পেশায় যা আয় হতো তা দিয়ে ৩ ছেলে ৩ মেয়ে নিয়ে সংসার ভালোভাবে চলত, কিন্তু বর্তমানে চুল ও দাড়ি ৪০ থেকে ৫০ টাকা করে কেটেও সারাদিনে যে টাকা পাই, তা দিয়ে সংসার চালাতে কষ্ট হয়। বর্তমানে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সব কিছুর পরিবর্তন হয়ে গেছে। চুল ও দাড়ি কাটার সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতির পরিবর্তন হয়েছে।
আধুনিক সেলুনগুলোতে এখন আর শাণ দেয়া ক্ষুর নেই। এর বদলে এসেছে ব্লেড। এসেছে শেভিং ক্রিম, ফোম, উন্নতমানের লোশন। যখন আমরা এ কাজ শুরু করেছিলাম তখন এসব ছিল কল্পনার বাইরে। আধুনিক সেলুন দেওয়ার মতো এতো টাকা হাতে নেই।
আপনার মতামত লিখুন :