পতিত সরকারের হাতে গুম হওয়া সিলেটের অবিসংবাদিত নেতা এম ইলিয়াস আলী আর জীবিত নেই। গুমের পর ‘রাষ্ট্রীয় হত্যা’র শিকার হয়েছেন তিনি এ কথা এখন মোটামুটি স্পষ্ট। বুধবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম আওয়ামী সরকারের গুম ও আয়নাঘর অধ্যায়ের মূল কারিগর আটক মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসানের উদ্ধৃতি দিয়ে এ তথ্য জানান। এর পরই ইলিয়াস আলীকে ফিরে পাওয়ার আশার যে আলো নিভু নিভু করছিল, তা-ও দপ করে নিভে গেল। এবার সিলেটে আলোচনায় আরেক নেতা। তিনি সিলেট জেলা ছাত্রদলের একসময়কার সহসাধারণ সম্পাদক ইফতেখার আহমদ দিনার। ছিলেন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদকও। সিলেটের রাজপথে সেই সময়কার পরিচিত মুখ তিনি।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলীর অত্যন্ত বিশ্বস্ত রাজনৈতিক শিষ্য ছিলেন এই দিনার। গুরু ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার ১৫ দিন আগে ২০১২ সালের ৩ এপ্রিল মঙ্গলবার বিকালে ঢাকা থেকে নিখোঁজ হন তিনি। ইলিয়াস আলীকেও ১৭ এপ্রিল ঠিক ‘মঙ্গলবার’ দিনেই ঢাকা থেকে গুম করা হয়। গুরু-শিষ্যের এমন গুম-নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি সারা দেশে সে সময় তোলপাড় সৃষ্টি করে।
সিলেটের রাজনৈতিক পাড়ায় এখনো বিষয়টি আলোচনার খোরাক।
এদিকে সিলেট বিএনপির লৌহমানব এম ইলিয়াস আলীর পরিণতি স্পষ্ট হওয়ার পর সিলেটজুড়ে নতুন করে আলোচনায় উঠে এসেছেন ইফতেখার আহমদ দিনার। অনেকের প্রশ্ন, গুরু ইলিয়াস আলীর মতো একই পরিণতি হয়েছে শিষ্য দিনারেরও? তবে পরিবার ও তার রাজনৈতিক সহযোদ্ধা-সহকর্মীরা ফেরার অপেক্ষায় আছেন। তারা মনে করছেন, যেহেতু দিনারের বিষয়ে এখনো কোনো সোর্স থেকে তথ্য আসেনি, সে জন্য হয়তো গেল সরকারের গুমঘর থেকে তিনি ফিরেও আসবেন।
দিনারের ছোট বোন তাহসীন শারমিন তামান্না বলেন, ‘আমার ভাই এখনো গুমঘরে আছে এই বিশ্বাস থেকে আমরা আশাবাদী তাকে রাষ্ট্র ফিরিয়ে দেবে। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর আমরা আশাবাদী হয়ে উঠেছি।
আমরা রাষ্ট্রের কাছে জানতে চাই, আমার ভাই এখন কোথায় আছে। কেমন আছে। তার ভাগ্যে কী ঘটেছে, সেটা রাষ্ট্রকে পরিষ্কার করে বলতে হবে।’ গুম কমিশন বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট আন্তরিক বলে জানান তিনি।
ইফতেখার আহমদ দিনার তার রাজনৈতিক জীবনে ইলিয়াস আলীকে গুরু বলেই মানতেন। এমনকি তিনি প্রকাশ্যে তাকে ‘গুরু’ বলেই সম্বোধন করতেন। ইলিয়াসের স্নেহের তালিকায় শীর্ষে ছিলেন দিনার। মূলত সিলেটে ‘ইলিয়াস গ্রুপের’ দেখাশোনা করতেন যে কজন, তাদের একজন ছিলেন তিনি। ইলিয়াস আলীর যে কোনো সভা-সমাবেশে অতন্দ্র প্রহরীর মতো দিনারকে তার পাশে থাকতে দেখা যেত। দিনার নিখোঁজের পরদিন থেকে তার সন্ধান পেতে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচির মাধ্যমে সিলেটের রাজপথ কাঁপিয়েছিলেন তার রাজনৈতিক গুরু ইলিয়াস আলী। কিন্তু সেই থেকে আজ পর্যন্ত দিনার জীবিত না মৃত এর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।
একাধিক রাজনৈতিক সূত্রের ধারণা, দিনার নিখোঁজ হওয়ার পর এম ইলিয়াস আলী জানতে পেরেছিলেন, কে বা কারা দিনারকে নিখোঁজ করেছে। তাদের নিয়ে তিনি ‘নির্ভরযোগ্য তথ্য’ প্রকাশও করেন। গণমাধ্যমে ইলিয়াস আলীকে উদ্ধৃত করে তখন বলা হয়েছিল, ‘বিএনপি নেতারা তাদের নিজস্ব সোর্সে নিশ্চিত হয়েছেন যে র্যাব-১-এর সদস্যরা দিনারকে গুম করেছেন।’ যদিও র্যাব-১ দিনার গুমে নিজেদের সংশ্লিষ্টতার কথা কখনোই স্বীকার করেনি। হয়তো এসব কারণেই পথের কাঁটা হিসেবে এম ইলিয়াস আলীকেও গুম করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, ২০১২ সালে সিলেট নগরীর উপশহরে ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুন হন মাহমুদ হোসেন শওকত নামের এক ছাত্রদল নেতা। এ ঘটনায় আলোচিত হন ইফতেখার আহমদ দিনার। মামলার ভয়ে প্রকাশ্য থেকে চলে যান অন্তরালে। সিলেট ছেড়ে পালিয়ে যান ঢাকায়। এই পালানোই যেন তার কাল হলো। ঢাকার উত্তরায় তার এক আত্মীয়ের বাসায় উঠেছিলেন তিনি। সেই উত্তরা থেকেই বন্ধুসহ গুম হন দিনার। ‘প্রশাসনের লোক’ পরিচয়ে গুম করা হয় তাকে। তার সঙ্গে ছিলেন ছাত্রদল নেতা ও তার বন্ধু জুনেদ আহমদও। সেই থেকে দিনার-জুনেদ নিখোঁজ। পরিবার প্রথমে দোষারোপ করেছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও দিনারের খোঁজ পায়নি। এখনো পরিবার মনে করে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সক্রিয় হলে দিনার ও তার বন্ধু জুনেদকে অক্ষত অবস্থায় ফিরে পাওয়া সম্ভব ছিল। হয়তো এখনো সম্ভব।
সে সময়ই দিনারের খোঁজে সরকারের সব মহলে ধরনা দিয়েছে তার পরিবার। পরিবারের সদস্যরা সে সময় অভিযোগ করেন, সরকার চাইলে তাদের ফিরে পাওয়া যেত। কিন্তু তারা ‘ইচ্ছাকৃতভাবেই’ কোনো সহযোগিতা করেনি। দিনারের গুমের ঘটনায় সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের শাহপরাণ থানায় একটি সাধারণ ডায়রি করেছিলেন দিনারের স্ত্রী প্রিসিলা পারভীন। দিনারের বোন তাহসীন শারমিন তামান্না তার ভাই নিখোঁজের পর গণমাধ্যমকে অভিযোগ করেছিলেন, ‘দিনারের খোঁজে সরকারের সব মহলে ধরনা দিয়েছি। তারা চাইলেই আমরা আমাদের ভাইকে ফিরে পেতাম।’
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গুম কমিশন গঠনের পর পরিবারের পক্ষ থেকে কমিশনে আবেদন করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন থেকে শুনানির জন্য ডেকে নেওয়া হয় দিনারের পরিবারের সদস্যদের। স্ত্রী প্রিসিলা পারভিন যুক্তরাজ্যে অবস্থান করায় তিনি যেতে পারেননি।
পরিবারের সদস্যরা কমিশনকে সব তথ্য-উপত্ত দিয়ে এসেছেন। এখনো কমিশন থেকে নিয়মিত তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। দিনারের বোনের স্বামী ও সিলেট জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমদ বলেন, ‘আমরা দিনারের ফিরে আসার ব্যাপারে আশাবাদী। আমরা চাই দ্রুত রাষ্ট্র আমাদের জানাবে তাদের ভাগ্যে আসলে কী হয়েছে। তারা বন্দি থাকলে দ্রুত বের করে দেবে। যতক্ষণ পর্যন্ত কমিশন থেকে নিশ্চিত করে কিছু বলবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা আশায় থাকব।’
তিনি বলেন, ‘শুধু দিনার নয়, আমরা আমাদের নেতা এম ইলিয়াস আলী, তার গাড়িচালক আনসার আলী, দিনারের বন্ধু জুনেদকেও ফেরত চাই। তাদের জন্য অপেক্ষায় আছি।’
তবে অসমর্থিত একটি রাজনৈতিক সূত্র মনে করছে, দিনারকে সম্ভবত তার গুরুর পরিণতিই বরণ করতে হয়েছে। তাকে গুমের পর হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে। শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকারের গুমঘর ও আয়নাঘর থেকে একে একে সবাই বের হয়ে এলেও ইলিয়াস আলী বা তার অনুসারী ইফতেখার আহমদ দিনার ফিরে আসেননি। ওই সূত্রের সন্দেহ, হয়তো সিলেট আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতা, যিনি একসময় দলের কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন, তার হাত থাকতে পারে। তবে ওই সময় এবং পরবর্তী সময়ে এম ইলিয়াস আলীর গুম হওয়া নিয়ে অসমর্থিত নানা সূত্র থেকে বিভিন্ন তথ্য বের হলেও দিনারকে নিয়ে কোনো সোর্স থেকে কিছুই প্রকাশ করা হয়নি।
নিখোঁজ দিনারের বাবা ও মা এখনো জীবিত, তবে অসুস্থ। বাবা সবচেয়ে বেশি অসুস্থ। তিনি সন্তানের জন্য ভেঙে পড়েছেন। দিনারের স্ত্রী প্রিসিলা পারভীন বর্তমানে ইংল্যান্ডে বসবাস করছেন। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছেন। ছেলের নাম রাইয়ান, বয়স ২০। মেয়ে মাইশা বড়, তার বয়স ২২। তারা সেখানে পড়ালেখা করছেন।
আপনার মতামত লিখুন :